এরশাদ সরকারের আমলে একবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে শহরে স্থানান্তরের দাবি উঠেছিল। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সেই দাবি নাকচ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, তাতে শরীর-মন ভালো থাকবে। এরপর প্রথম দফার শেখ হাসিনা সরকারের আমলেও একবার একই প্রস্তাব দিয়েছিল একটি পক্ষ।

শেখ হাসিনা ওই প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এত সুন্দর একটি ক্যাম্পাসে নাকি তাঁর নিজেরই পড়তে ইচ্ছা করে। তৎকালীন দুই সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের কথার মধ্যেই যুক্তির চেয়ে ভাবালুতা ছিল বেশি।

শিক্ষার্থীদের এক-চতুর্থাংশের জন্যও আবাসিক ব্যবস্থা না করে ২২ কিলোমিটার দূরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনার মধ্যে যেমন অদূরদর্শিতা শুরু থেকেই ছিল, তেমনি সাইকেল চালিয়ে যাওয়া বা এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সেখানে পড়তে চাওয়ার আদিখ্যেতার মধ্যেও ছিল বাস্তবতাবোধের অভাব।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে আবাসিক হলগুলোতে থাকার ব্যবস্থা আছে মাত্র ৭ হাজার জনের। বাকি ২১ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে শহর থেকে ট্রেনে-বাসে আসা-যাওয়া করেন কয়েক হাজার। এ ছাড়া আরও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে আশপাশের গ্রাম, বিশেষ করে জোবরা ও ফতেহপুরে বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন গ্রামগুলোতে যুগ যুগ ধরে শিক্ষার্থীরা বসবাস করার ফলে ছাত্রছাত্রী ও গ্রামবাসীর মধ্যে পারস্পরিক একটি সুবিধার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সন্দেহ নেই। শিক্ষার্থীরা পেয়েছেন আশ্রয়, বিনিময়ে গ্রামবাসী পেয়েছেন আর্থিক সংগতি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। ক্যাম্পাসের আশপাশে গড়ে উঠেছে প্রচুর দোকান। প্রতিদিন কয়েক হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে সরগরম ক্যাম্পাসে রিকশা-অটোরিকশা চলাচলের ফলে কেউ কায়িক শ্রম দিয়ে আয় করেছেন, কেউবা পেয়েছেন এ ক্ষেত্রে ছোটখাটো বিনিয়োগের সুযোগ।

গ্রামবাসী-শিক্ষার্থীদের বিরোধ-সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়, আগেও বহুবার ঘটেছে। সুতরাং সর্বাগ্রে শনাক্ত করতে হবে পারস্পরিক বিদ্বেষের কারণগুলো। প্রকৃত রোগ নির্ণয় না হলে শান্তি মলমের প্রলেপে তা নির্মূল হবে না।

কিন্তু এত কিছুর পরও গ্রামবাসীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটা আন্তরিক বোঝাপড়া বা মমতার সম্পর্ক কেন গড়ে উঠল না, সেটা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। শিক্ষার্থীদের সংস্পর্শে এসে গ্রামবাসীর মধ্যে নিজেদের সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার কোনো প্রবণতা যে গড়ে ওঠেনি, তার বড় প্রমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নস্তরের কর্মচারী হিসেবে স্থানীয় কয়েক শ মানুষের চাকরিবাকরি হলেও প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষক পদে যোগ দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন এই এলাকার মাত্র দু-তিনজন। প্রশাসনিক উচ্চ পদেও তাঁদের নিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে।

আরও পড়ুনচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষ, দায় ও কিছু প্রশ্ন০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

অন্যদিকে গ্রামবাসীর প্রতি শিক্ষার্থীদের কেন কৃতজ্ঞতার বোধ গড়ে উঠল না, সেটাও সবিস্ময় প্রশ্নের উদ্রেক করে বৈকি!

অধিক রাতে এক ছাত্রীর বাসায় ফিরে আসা ও বাসার দারোয়ানের (স্থানীয়) সঙ্গে তাঁর বচসা ও পরস্পরকে চড়–থাপ্পড় দেওয়ার একটি ঘটনাকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, এমনকি দোষীকে শাস্তি প্রদান করার শর্তে মিটমাট করা যেত। আশপাশের লোকজন সে রকম উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু সেদিন মধ্যরাতে গ্রামবাসীর ওপর শিক্ষার্থীদের হামলা, তাঁদের বাড়িঘর ভাঙচুর করা, এমনকি দোকানপাট লুটপাটের ঘটনাকে ন্যায্যতা দেওয়া যাবে কোনো যুক্তিতে?

একইভাবে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের নির্মমভাবে কুপিয়ে জখম করাটাও গ্রামবাসীর চরম নৃশংসতার প্রকাশ। বহু শিক্ষার্থীকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাঁরা যদি আপাতত মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে রক্ষাও পান, ভবিষ্যতে কতটা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পরিবর্তে সময়ক্ষেপণের কারণে ঘটনার ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোহীত উল আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘.

..যখনই ধোঁয়া দেখা গিয়েছিল, তার চাপায় যে আগুন আছে, সেটা সম্যক উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে বলে আমার ধারণা হয়। যত রাতই হোক প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল গিয়ে সেখানে উপস্থিত হতে পারতেন বলে আমার ধারণা।’

গ্রামবাসীর মধ্যেও উসকানিদাতা কেউ ছিলেন এ কথা ভাবা অমূলক কিছু নয়। ঘটনার পর গ্রামবাসীর সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে যেভাবে কটুবাক্য ছোড়া হয়, তা আগুনে ঘি ঢালার মতো। সংঘর্ষ দ্বিতীয় দিনে গড়ানোর পেছনে এসব উত্তেজক বক্তব্যের ভূমিকা আছে।

এ ধরনের বক্তব্যের কারণে জামায়াত ও বিএনপির দুজন স্থানীয় নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাঁদের দল থেকে। গ্রামবাসী পরিচয়ে এখানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উসকানি আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অন্যদের মধ্যে যুবলীগের একজন স্থানীয় কর্মীকেও গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।

শিক্ষার্থী-গ্রামবাসীর সংঘর্ষের রেশ এখনো কাটেনি। ক্যাম্পাসে প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। এক হাজার অজ্ঞাতনামা গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলার ফলে ভীতি-আতঙ্ক রয়েছে গ্রামে। দু-তিন হাজার ছাত্রছাত্রী এখনো ফিরতে পারেননি তাঁদের ভাড়া বাসায়। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখনো অস্থিতিশীল। এ অবস্থায় সব পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করার সৃজনশীল ও ফলপ্রসূ উদ্যোগ নিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সংলগ্ন এলাকায় জায়গাজমি কিনে বসতবাড়ি নির্মাণ করেছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। সুতরাং এখান থেকে ক্যাম্পাস স্থানান্তর যেমন কিছুতেই সম্ভব নয়, জোবরা বা ফতেহপুরবাসীকেও উচ্ছেদ করা অসম্ভব। এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের কাজটিই করতে হবে সুপরিকল্পিতভাবে। গ্রামবাসী-শিক্ষার্থীদের বিরোধ-সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়, আগেও বহুবার ঘটেছে। সুতরাং সর্বাগ্রে শনাক্ত করতে হবে পারস্পরিক বিদ্বেষের কারণগুলো। প্রকৃত রোগ নির্ণয় না হলে শান্তি মলমের প্রলেপে তা নির্মূল হবে না।

 বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও সাহিত্যিক

মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ র মব স র স স ঘর ষ

এছাড়াও পড়ুন:

কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর

বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মূলে রয়েছে কৃষি। এই কৃষির বিবর্তনের গল্প, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য যেন এক অমূল্য উত্তরাধিকার।

সময়ের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেই হারানো ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও তুলে ধরার প্রয়াসেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি জাদুঘর।

আরো পড়ুন:

জাপানের এনইএফ বৃত্তি পেলেন বাকৃবির ২০ শিক্ষার্থী

গোপনে বাকৃবি ছাত্রীদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে সাবেক ছাত্রকে দিতেন আরেক ছাত্রী

বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ঠিক সামনেই সবুজ দেবদারু গাছে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এই কৃষি জাদুঘর। প্রকৃতির কোলে যেন কৃষির ইতিহাস কথা বলে এখানে।

২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মু. মুস্তাফিজুর রহমানের হাত ধরে জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, যার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ হোসেন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম এর উদ্বোধন করেন।

নানা প্রতিবন্ধকতা ও জনবল সংকটের কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, ২০০৭ সালের ৩০ জুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁ এটি পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি দেশের কৃষি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির এক জীবন্ত সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত।

৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত এই অষ্টভুজ আকৃতির ভবনটি স্থাপত্যগত দিক থেকেও দারুণ দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে রঙিন মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম, পাশে প্রাচীন সাতটি খনার বচন। প্রবেশমুখের ঠিক পরেই দুটি অফিস কক্ষ, আর একটু ভেতরে এগোলেই দেখা যায় একটি ছাদহীন বৃত্তাকার বাগান, যা প্রাকৃতিক আলোর ছোঁয়ায় উজ্জ্বল। সেই বাগানের চারপাশেই রয়েছে সংরক্ষণশালার বিভিন্ন কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই যেন কৃষির একেকটি অধ্যায়।

জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো বীজ সংগ্রহশালা। এখানে রয়েছে ধান, গম, ভুট্টা, তিসি, চিনাবাদাম, কাউনধান, ফ্রেঞ্চ বিন, ফাবা বিনসহ নানা ফল ও সবজির বীজ। দেখা মেলে বিরল প্রজাতির তৈকর ফলের বীজ, যা একসময় আচার ও জেলি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। রয়েছে বহুল পরিচিত ভ্যান্না বীজ, যার তৈল দিয়ে কসমেটিক ও ঔষধি পণ্য তৈরি হয়।

মাটির নানা প্রকার নমুনা, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সার, এমনকি পাহাড়ি চাষাবাদের মডেলও স্থান পেয়েছে এখানে।

শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও দর্শনার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন ফসল রোগের চিত্র, আক্রান্ত বীজ, ও ব্যাকটেরিয়ার নমুনা। এ অংশের এক বিশেষ আকর্ষণ আড়াই কেজি ওজনের এক বিশাল মিষ্টি আলু, যা দর্শনার্থীদের বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

জাদুঘরের আরেক অংশ যেন এক ক্ষুদ্র প্রাণিবিজ্ঞান জাদুঘর। এখানে প্রদর্শিত আছে বুনো মহিষ, হরিণের শিং, গরু, অজগর ও গোখরা সাপের কংকাল। রয়েছে সংরক্ষিত কালো মেটো ইঁদুর, ধারাই সাপ, এবং কচ্ছপের খোল ও কঙ্কাল।

উপরে তাকালে দেখা যায় এক বিশাল প্রিজার্ভড শকুন, সে যেন আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। রয়েছে প্লাটিপাসের কংকালও, যা এক বিরল প্রাণীর বাস্তব নিদর্শন। প্রতিটি নমুনাই যেন দর্শনার্থীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কৃষি কেবল ফসল বা জমির নয়, এটি প্রকৃতি ও প্রাণের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।

গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্যও এখানে তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এক কক্ষে সাজানো আছে ঢেকি, কুলা, পানের ডাবর, হুকা, হারিকেন, কুপি বাতি, গরুর গাড়ির মডেল, এমনকি মাছ ধরার পুরোনো যন্ত্রও। রয়েছে তবলা, বেহালা, আদুরী, ক্রাম ও নাতকসহ বিভিন্ন দেশীয় বাদ্যযন্ত্র।

এক পাশে দেখা যায় ‘গিলা’, যা একসময় বর-কনের গোসল অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো। এখনকার তরুণ প্রজন্ম হয়তো নামটিও জানে না, অথচ এটি ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ।

আরো রয়েছে কৃষকের বসতবাড়ির পূর্ণাঙ্গ মডেল, যা দেখতে যেন একেবারে বাস্তব কৃষকের ঘর। এখানে দেখা যায় কৃষকের হালচাষের দৃশ্য, রান্নাঘর, ধান রাখার গোলা, গরুর খোঁয়াড় এবং গৃহিণীর সাজানো রান্নার জায়গা। যেন একবারে গ্রামের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে দেয়াল আর মডেলের মধ্যে।

প্রযুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছে পুরনো মাইক্রো কম্পিউটার, ডট প্রিন্টার, পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র, ঘাণি, ডিঙি নৌকা, কাঁঠের তৈরি গরুর গাড়ি, তালগাছের কুন্দা ও উপজাতিদের পোশাক। এক পাশে ঝুলছে হরিণের চামড়া, অন্য পাশে সাজানো উপজাতীয় কৃষি উপকরণ, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

এই উপকরণগুলো কেবল প্রযুক্তির বিবর্তনের ইতিহাস নয়, বরং কৃষির সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারার মেলবন্ধনের প্রতীক।

জাদুঘরের আরেক বিশেষ প্রদর্শনী হলো প্রাচীন থেকে আধুনিক সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এগুলো দেখে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

জাদুঘরের প্রতিটি কোণ যেন বলে, কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ। এখানকার প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি মডেল, প্রতিটি নমুনা কৃষির বিকাশ ও মানুষের সংগ্রামের গল্প বহন করে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে কৃষির অতীত ঐতিহ্য থেকে বর্তমান প্রযুক্তির রূপান্তর পর্যন্ত এক নজরে দেখতে পান।

বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “এটি দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে উপকরণসমৃদ্ধ কৃষি জাদুঘর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে এটিকে দোতলা ভবনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে কৃষি ভিত্তিক ১৪টি জেলার ঐতিহ্যবাহী কৃষি উপকরণ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে।”

তিনি আরো বলেন, “দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য ভবিষ্যতে টিকিট ব্যবস্থা চালুর কথাও ভাবা হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।”

এই কৃষি জাদুঘর শুধু কৃষি উপকরণের প্রদর্শনী নয়, বরং এটি বাংলাদেশের কৃষি সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের সম্পর্কের এক সজীব দলিল। শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের ভিড় থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এখানে আসে, তবে মুহূর্তেই যেন হারিয়ে যায় মাটির গন্ধে, কৃষকের ঘামে, বাংলার গ্রামীণ জীবনের সহজ সরল সৌন্দর্যে।

জাদুঘরটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এবং প্রতি শনিবার বন্ধ থাকে। সময় সুযোগে একবার ঘুরে গেলে দেখা মিলবে বাংলাদেশের কৃষির হাজার বছরের গল্প, যা মাটি, ঘাম, বীজ আর ঐতিহ্যের বন্ধনে গাঁথা এক অনবদ্য ইতিহাস।

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর
  • ব্রেন ক্যানসারের যে ৭টি লক্ষণ আমরা সাধারণ ভেবে এড়িয়ে যাই