টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে আগামীকাল শুক্রবার শুরু হচ্ছে ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমা। তিন ধাপে অনুষ্ঠিত হবে এবারের ইজতেমা। প্রথম আর দ্বিতীয় পর্ব আয়োজন করছে শূরায়ে নেজাম (মাওলানা যোবায়েরপন্থিরা)। এরই মধ্যে ইজতেমা ময়দানের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।

তাবলিগ জামাতের জিম্মারা গত মঙ্গলবার ময়দানে আসা শুরু করেন। আসছেন সাধারণ সাথিরাও। তবে এবার তৃতীয় পর্বে সাদপন্থিদের ইজতেমা ঘিরে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। আগামী বছর থেকে টঙ্গীর ময়দানে মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা ইজতেমা আয়োজন করবেন না– এই শর্তে সরকার তৃতীয় পর্বের সময় নির্ধারণ করলেও বিষয়টি অনিশ্চিত। সাদপন্থিদের অভিযোগ, সরকার তাদের ওপর অনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে হেফাজতে ইসলামের প্ররোচনায়। তারা সরকারের কাছে লিখিতভাবে কোনো অঙ্গীকার করেননি।

ইজতেমার দুই পক্ষের অংশগ্রহণ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কাজী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘৩১ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইজতেমার দুটি পর্বে যোবায়েরপন্থিরা অংশ নেবেন। সাদপন্থিরা ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইজতেমা আয়োজন করবেন। আগামী বছর থেকে সাদপন্থিরা ইজতেমায় অংশ নেবেন না বলে তাদের দুই পক্ষের বৈঠকে সমাঝোতার ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

তাবলিগ জামাতের শূরায়ে নেজামের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, ‘এবার ইজতেমা সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে আমরা আশাবাদী। দেশ-বিদেশ থেকে অনেক মুসল্লির সমাগম হবে বলে আমাদের ধারণা। আমরা প্রথম দুটি পর্বে অংশগ্রহণ করব। তবে শর্ত না মানলে সাদপন্থিদের তৃতীয় পর্বের ইজতেমার নিশ্চয়তা নেই।’
মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের মিডিয়া সমন্বয়ক মোহাম্মদ সায়েম বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের ইজতেমা ৭ ফেব্রুয়ারি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ইজতেমা করার একটি বার্তা পেয়েছি। সে লক্ষ্যেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের মাওলানা মামুনুল হকদের প্ররোচনায় সরকার আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করে অনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে আগামী বছর থেকে আমাদের ইজতেমায় অংশ না নেওয়ার শর্তে তৃতীয় পর্বের সময় নির্ধারণ করেছে। কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে আমাদের না দিলে আমরাও লিখিত দেব না।’

২০১৮ সালে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রজ্ঞাপন দিয়ে দু’পক্ষের ইজতেমার সময় নির্ধারণ করা হয়। গত নভেম্বরে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শূরায়ে নেজামের আয়োজনে প্রথম পর্ব এবং ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি সাদপন্থিদের দ্বিতীয় পর্বের সময় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ১৭ ডিসেম্বর মধ্যরাতে সংঘর্ষের পর সাদপন্থিদের ইজতেমা অনিশ্চিত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সরকার ইজতেমা নিয়ে দু’পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করলেও লিখিত বা প্রজ্ঞাপন দিয়ে নতুন কোনো সময় নির্ধারণ করেনি। তবে মন্ত্রণালয় ও তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষ সূত্রে জানা যায়, শূরায়ে নেজামের অধীনে ৩১ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম ধাপ। ৩ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে তৃতীয় ধাপের ইজতেমার আয়োজন করবেন সাদ অনুসারীরা। ১৬ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বিশ্ব ইজতেমা। ১৮ ফেব্রুয়ারি মাগরিবের নামাজের পর প্রশাসনের কাছে ময়দান বুঝিয়ে দেবেন সাদ অনুসারীরা। তবে এখনও সাদপন্থিদের ইজতেমা অনিশ্চিত। 

যোবায়েরপন্থিদের দাবি, সাদপন্থিরা আগামী বছর ইজতেমায় অংশ নেবেন না– এমন শর্তে মন্ত্রণালয় তৃতীয় পর্বের সময় দিয়েছে। তারা শর্ত মানার নিশ্চয়তা না দিলে তৃতীয় পর্বের ইজতেমায় তাদের অংশগ্রহণ হবে না। সাদপন্থিরা বলছেন, মন্ত্রণালয় থেকে তাদের মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, আগামী বছর তারা ইজতেমায় অংশ নেবেন না– এমন লিখিত দিলেই এ বছর তৃতীয় পর্বের ইজতেমার সুযোগ দেওয়া হবে। তারা এখন পর্যন্ত সরকারকে লিখিত কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। 

তাবলিগ জামাতের বিশ্ব মারকাজ ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ’-এর শূরায়ে নেজামকে (পরিচালনা পর্ষদ) কেন্দ্র করে দুই পক্ষে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। শূরায়ে নেজাম ভেঙে দিয়ে নিজেকে আমির ঘোষণাকারী মাওলানা সাদ কান্ধলভির তাবলিগ জামাতের বিভিন্ন সংস্কার নিয়ে বক্তব্যে আরও বিভক্তি বাড়ে। এসবকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে ইজতেমা ময়দানে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হলেও ২০১৯ সাল থেকে শূরায়ে নেজাম ও সাদপন্থিরা আলাদাভাবে দুই পর্বে ইজতেমা পালন করছিলেন। সেই সময় থেকে ইজতেমা ময়দানে মাওলানা সাদ কান্ধলভি অনুপস্থিত ছিলেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সাদ কান্ধলভির ইজতেমা ময়দানে উপস্থিতি প্রশ্নে দুই পক্ষে আবার উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। 

গত মঙ্গলবার ইজতেমা ময়দানে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বেশির ভাগ অংশে টানানো হয়েছে চটের শামিয়ানা। তৈরি হয়েছে বয়ান মঞ্চ। বয়ান মঞ্চের কাছে বিদেশি মেহমানদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বয়ান মঞ্চের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ পাশে শামিয়ানা, শব্দ প্রতিধ্বনিরোধক বিশেষ ছাতা মাইক ও বৈদ্যুতিক বাতি লাগানো হয়েছে। মুসল্লিদের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে ময়দানের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া সেতু থেকে টঙ্গী সেতু পর্যন্ত তুরাগ নদে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা পাঁচটি পন্টুন সেতু নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া ফেরিঘাটের জেটি দিয়ে অপর একটি পন্টুন সেতু তৈরি করেছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে ময়দানের চারপাশে পুলিশ ও র‍্যাবের পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। এ ছাড়া ইজতেমা ময়দানে সিসিটিভি স্থাপন করেছে র‍্যাব। ময়দানের মাঝখানে নোয়াখালী থেকে আসা একদল মুসল্লি মঙ্গলবার নিজেদের জায়গা তৈরি করছিলেন। আবদুল্লাহ নামে একজন বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর ইজতেমা শুরুর দুই থেকে তিন দিন আগেই চলে আসি। আগে না এলে ঠিকঠাক জায়গা পাওয়া যায় না। এ ছাড়া মাঠ প্রস্তুতির কাজও করতে হয়।’ 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব শ ব ইজত ম ত য় পর ব র সময় ইজত ম য় অ শ ন ত ত য় পর ব র র ত ত য় পর ব স দপন থ র র ইজত ম র সরক র র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।

এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন। 

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।

এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। 

এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে। 

মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়। 

জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।

এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়। 

এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।

যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে। 

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই। 

অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়। 

এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।

এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। 

এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়। 

এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ