পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে অবিলম্বে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য ১৪টি সুপারিশ করেছে কমিশন। এর মধ্যে পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত ডোপ টেস্ট ও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা অনুমতি সাপেক্ষে যেন অধস্তন কর্মকর্তাদের ওপর অর্পণ করা যেতে পারে– সে ব্যাপারে মত দিয়েছে কমিশন।

অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা পুলিশ সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন গতকাল শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সেখানে বল প্রয়োগ ও মানবাধিকার, আটক-গ্রেপ্তার, তল্লাশি-জিজ্ঞাসাবাদ, জিডি, মামলা, তদন্ত, ভেরিফিকেশন, শিশু ও জেন্ডার সচেতনতা বিষয়সহ 

জনবান্ধব পুলিশ গড়তে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বাহিনী সংস্কারে ২২টি আইন সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে কমিশন।

মানবাধিকার ও আইনের শাসন বিষয়ে বলা হয়েছে, সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে। সংস্থার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে প্রধান যেন তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন, সে জন্য মানবাধিকার সেল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষার জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা উচিত, যা জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করবে। জবাবদিহি এবং জনবান্ধব পুলিশ গড়তে র‍্যাবের অতীত কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতাকে হতাহত করার জন্য দোষী পুলিশ সদস্যদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও হেফাজত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এ সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বাধ্যতামূলক কার্যকরিতা রয়েছে। তার পরও সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাগুলো বিধিবদ্ধ করতে আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে ফৌজদারি কার্যবিধিসহ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি-প্রবিধান সংশোধন করা যেতে পারে।
‘মিডিয়া ট্রায়াল’ বিষয়ে বলা হয়েছে, বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমের সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না।

মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ নিয়ে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর নীতিমালা অনুসরণ করে পাঁচ ধাপে বল প্রয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। চার ধাপে সব কৌশল প্রয়োগ করার পরও সংঘবদ্ধ জনতা ছত্রভঙ্গ না হয়ে মৃত্যু ঘটানোর মতো আক্রমণ, ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও করলে পঞ্চম ধাপে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে পিআরবি ও জাতিসংঘ মানদণ্ড অনুযায়ী দলগত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে দক্ষ শুটার দিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষে গুলি ছুড়ে আক্রমণকারীকে প্রতিহত, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো যেতে পারে। তবে কখনোই প্রয়োজনের অতিরিক্ত সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগ করা যাবে না।

সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, শক্তি প্রয়োগের সব ঘটনা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করতে হবে এবং তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যাচাই ও অনুসন্ধান করতে হবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে তাকে দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে। ঊর্ধ্বতনের অবৈধ আদেশকে শক্তি প্রয়োগের আইনসম্মত বৈধতা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

ক্ষমতাকেন্দ্রিক থেকে জনকেন্দ্রিক পুলিশিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক বছরের মধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ করা হয়েছে। অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশে বলা হয়েছে– জনগণ ও পুলিশের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠনে স্থানীয় থানার উদ্যোগে নিয়মিত নাগরিক-পুলিশ সংলাপ একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে। প্রতিটি এলাকায় নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনে সদরদপ্তর থেকে গত ১০ আগস্ট একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনাটি পুনর্মূল্যায়ন করে কমিটি গঠনের ব্যাপারে বিবেচনা করা যেতে পারে। মধ্যম সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশে বলা হয়েছে, পাঠ্যক্রমে এমন মডিউল অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যেখানে নাগরিক অধিকার, দায়িত্ব ও পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে। নাগরিকদের সচেতনতা ও সক্ষমতা বাড়াতে সংক্ষিপ্ত সার্টিফিকেট কোর্সের উদ্যোগ কার্যকর হতে পারে। পুলিশের একটি আলাদা ও সুসংগঠিত জনসংযোগ কৌশল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেবা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক উন্নত করতে সহায়তা করবে।

প্রতিবেদনে স্বেচ্ছাসেবী পুলিশ গঠনের ধারণাপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের ১৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের পুলিশিং কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপদ দেশ বিনির্মাণের কথা বলা হয়েছে।

আটক, গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদে স্বচ্ছতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, পুলিশের কার্যক্রমে এই ক্ষেত্রগুলোতে অস্পষ্টতা বা হয়রানির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে, যা জনমনে আস্থা নষ্ট করে। তাই এসব প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে প্রাসঙ্গিক নিয়ম ও নীতিমালা অনুসরণ করা জরুরি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। থানায় স্বচ্ছ কাচের জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ স্থাপন করতে হবে। নারী পুলিশের উপস্থিতিতে নারী আসামির জিজ্ঞাসাবাদ বাধ্যতামূলক করতে হবে। অভিযানের সময় বডি-অন ক্যামেরা ও জিপিএস ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। রাতে গৃহ তল্লাশিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা স্থানীয় প্রতিনিধি থাকতে হবে। মিথ্যা মামলায় জড়ানো পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

স্বাধীনতা ও জবাবদিহি নিয়ে বলা হয়েছে, স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো তৈরি করা হবে। পাশাপাশি সুষ্ঠু তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে, যাতে কোনো ধরনের অপব্যবহার বা দুর্নীতির সুযোগ না থাকে। একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে এবং এর কার্যক্রম যাতে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

থানায় মামলা, তদন্ত ও ভেরিফিকেশনের সহজীকরণ বিষয়ে বলা হয়েছে, জিডি (সাধারণ ডায়েরি) নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। মামলার এফআইআর (প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) নিতে গড়িমসি করলে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রধারীর ভেরিফিকেশন সহজ করতে হবে এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই বন্ধ করতে হবে।

যুগোপযোগী আইন ও প্রবিধানমালা বিষয়ে বলা হয়, সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত সমাজ, প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে আইন ও প্রবিধানগুলো সংশোধন ও উন্নয়ন করা জরুরি। ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক পুলিশ আইন সংস্কার করতে হবে। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে মানবাধিকার সুরক্ষায় সংশোধনী আনতে হবে। ১৯৪৩ সালের পুলিশ প্রবিধানমালার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে হবে।

দুর্নীতি প্রতিরোধ ও প্রতিকারে বলা হয়, জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করতে হলে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। মধ্য মেয়াদে পুলিশের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, নজরদারি এবং কার্যকর অভিযোগ ব্যবস্থাপনা চালু করা প্রয়োজন। থানায় সর্বদলীয় পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করতে হবে। দুর্নীতি তদন্তের জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে এবং পুরস্কার (বিপিএম/পিপিএম) প্রাপ্তির মানদণ্ড নির্ধারণে স্বচ্ছতা আনতে হবে।

বাহিনীর ভেতরের দুর্নীতি বন্ধে কমিশনের সুপারিশমালায় বলা হয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত, অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, বদলি ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাব খতিয়ে দেখতে হবে, থানার জরুরি খাতগুলোতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং থানায় কোনো ধরনের মধ্যস্থতা নিষিদ্ধ করতে হবে।

বাহিনীকে আন্তর্জাতিক মানে করে তুলতে প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে। সদস্যদের আইনি জ্ঞান, মানবাধিকার সংক্রান্ত দক্ষতা এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ আয়োজন প্রয়োজন। বিশেষ করে সাইবার অপরাধ, ফরেনসিক তদন্ত এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। 

ভৌগোলিক অবস্থানভেদে পুলিশিং ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, শহর এবং গ্রামীণ এলাকাগুলোর নির্দিষ্ট চাহিদা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শহরাঞ্চলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, আর গ্রামীণ এলাকায় অপরাধ প্রতিরোধ এবং কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমে জোর দেওয়া প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় পুলিশিং পদ্ধতিগুলোর আধুনিকীকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সেন্টার ফর পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) গঠন করতে হবে। বাহিনীতে নারী, শিশু এবং জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু আইন ২০১৩-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রতিরোধে বিশেষ ইউনিট গঠন করতে হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত করত গঠন করত ব যবস থ ক র যকর ব যবহ র র জন য ধ করত অপর ধ ন করত তদন ত ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা

মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে প্রায়ই বিজ্ঞান, স্থাপত্য বা শাসনব্যবস্থার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু এর মানবিক দিক অধরা রয়ে যায়। বিশেষ করে দরিদ্রদের প্রতি দয়া ও চিকিৎসাসেবার গল্প আড়ালে রয়ে গেছে সব সময়।

মুসলিম সভ্যতায় কীভাবে দরিদ্র ও অসুস্থদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা, আশ্রয় এবং মানসিক সান্ত্বনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা এক অপূর্ব কাহিনি।

বিমারিস্তান: দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসার আশ্রয়

মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবায় ‘বিমারিস্তান’ নামের হাসপাতাল ছিল একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। এগুলো শুধু চিকিৎসার জায়গা ছিল না, বরং দরিদ্রদের জন্য বিনা মূল্যে আশ্রয়, খাদ্য ও যত্নের ব্যবস্থা ছিল। বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত নগরে, বিশেষ করে বড় রাজধানীগুলোতে বিমারিস্তান ছিল। দামেস্কে বিমারিস্তানের নাম ছিল ‘নুরি’, বাগদাদে ‘আদুদি’।

প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহ.)

প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকের সময়, ৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি এতে চিকিৎসক নিয়োগ করেন এবং তাঁদের বেতনের ব্যবস্থা করেন। সমাজের স্বাস্থ্য রক্ষায় কুষ্ঠরোগীদের জন্য পৃথক স্থানে বিনা মূল্যে খাদ্য ও যত্ন দেওয়া হতো।

অন্ধদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা ও সাহায্যকারী নিয়োগ করা হতো। খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।’ (ইবনে আসাকির, তারিখে দিমাশক, ৪৪/১২৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

আরও পড়ুন“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”০১ অক্টোবর ২০২৫

ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালও ছিল, যা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হতো। দূরবর্তী অঞ্চলে মহামারি মোকাবিলায় ৪০টি উটের কাফেলায় চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হতো।

মিসরে প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় আহমদ ইবন তুলুনের সময়, ৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে, ফুসতাতে। এর নাম ছিল ‘বিমারিস্তান আতিক’।

এর জন্য ওয়াক্‌ফ তহবিল রাখা হয়েছিল, এবং শর্ত ছিল যে এটি শুধু সাধারণ মানুষের জন্য, সৈন্য বা দাসদের জন্য নয়। এর বার্ষিক খরচ ছিল ৬০ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)। ইবন তুলুন নিজে প্রতি সপ্তাহে এটি পরিদর্শন করতেন এবং জুমার দিনে মুসল্লিদের জন্য জরুরি সেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে ছিল ১ লাখের বেশি বইয়ের গ্রন্থাগার। (মাকরিজি, খিতাত, ২/৪০৫, দারু সাদির, কায়রো, ১৮৫৩)

সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবি বিমারিস্তান ‘নাসিরি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে মিসর ও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বিমারিস্তান ছিল মনসুর কালাউনের প্রতিষ্ঠিত বিমারিস্তান, ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। এখানে নারী-পুরুষ সবার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল, চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা ছিল না। এখানে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো।

সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। রাতের দীর্ঘ সময় রোগীদের জন্য কষ্টকর হতো, তাই ফজরের আজান দুই ঘণ্টা আগে দেওয়া হতো, যাতে রোগীরা সকালের আশায় উৎফুল্ল হয়। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।

সুস্থ হওয়ার পর রোগীদের পোশাক ও কিছু টাকা দেওয়া হতো, যাতে তারা তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে না বাধ্য হয়। এই বিমারিস্তান ২০০ জনের বেশি দরিদ্র রোগীকে বাড়িতে চিকিৎসা দিত। (মাকরিজি, খিতাত, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৭)

দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসাগ্রন্থ

মুসলিম সভ্যতার চিকিৎসকেরা লক্ষ করেন, চিকিৎসা কখনো কখনো ধনীদের কাছে ব্যবসায় পরিণত হন। তাই তাঁরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তারা নিজেরা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে বা ছোট চিকিৎসকেরা তাদের সহজে চিকিৎসা দিতে পারেন। এই গ্রন্থগুলোয় স্থানীয় ও সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতো; কারণ, ভারত বা চীন থেকে আমদানি করা ওষুধ ছিল দামি।

আরও পড়ুনইসলামে দারিদ্র্য দূরীকরণের ৮টি ব্যবহারিক উপায়০২ নভেম্বর ২০২৫

আবু বকর আর-রাজি: তিনি দরিদ্রদের প্রতি অসাধারণ দয়া দেখাতেন এবং তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করতেন। তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন: ‘বুরউ সা’আত’ (তাৎক্ষণিক চিকিৎসা) এবং ‘মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব’ (যার কাছে চিকিৎসক নেই), যাকে ‘তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন’ (দরিদ্রদের চিকিৎসা) বলা হয়।

তিনি লিখেছেন, ‘অনেক চিকিৎসক ওষুধ ও খাবারের কথা লেখেন, যা শুধু রাজাদের ভান্ডারে পাওয়া যায়। আমি সাধারণ ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে চিকিৎসার একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লিখতে চাই, যাতে সবাই এর সুবিধা পায়।’ (আল-রাজি, মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব, পৃষ্ঠা ১৫, দারুল কুতুব, বৈরুত, ১৯৮৫)

মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো।

ইবনে জাজ্জার কায়রাওয়ানি: তিনি কখনো দরিদ্রদের কাছ থেকে চিকিৎসার ফি নিতেন না। তিনি তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন গ্রন্থে লিখেছেন, ‘দরিদ্ররা স্বাস্থ্য ও রোগ–সম্পর্কিত বইয়ের সুবিধা পায় না। তাই আমি এমন একটি গ্রন্থ লিখলাম, যাতে সহজলভ্য ওষুধ দিয়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করা যায়।’ (ইবনে জাজ্জার, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ১০, দারুল ফিকর, কায়রো, ১৯৯০)

ইবনে আকফানি: তিনি গুনইয়াতুল লাবিব ফি গাইবাতিত তাবিব (চিকিৎসক না থাকলে জ্ঞানীর সম্পদ) গ্রন্থে জরুরি রোগের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য রক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন।

জামালুদ্দিন ইউসুফ মাকদিসি: তিনি ‘তিব্বুল ফুকারা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ধনীরা সুস্বাদু খাবার খায়, তাই তাদের রোগ বেশি। দরিদ্ররা সাধারণ খাবারে সন্তুষ্ট থাকে, তাই তাদের রোগ কম। কিন্তু দরিদ্ররা অসুস্থ হলে তাদের জন্য সহজ ও সস্তা ওষুধ দরকার।’ (মাকদিসি, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ৮, দারুল মারিফা, বৈরুত, ১৯৯২)

মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো। চিকিৎসকেরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে তারা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে। এই ঐতিহ্য দেখায়, ইসলামি সভ্যতা কেবল জ্ঞান বা শক্তিতে নয়, মানবিকতা ও দয়াতেও শ্রেষ্ঠ ছিল।

আরও পড়ুনআপনার মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিচ্ছেন তো২১ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ