বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয় সুপারিশ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। এই কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পুরো প্রতিবেদন ৮ ফেব্রুয়ারি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে সংস্কার কমিশন বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনা, মৌলিক নীতিমালাসহ বেশ কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে।

এই সুপারিশগুলো এখন কেবল প্রস্তাবনা হিসেবে রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এগুলো চূড়ান্ত করা হবে। এরপরও সুপারিশগুলো সংলাপ ও ঐকমত্য গঠনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে—এমনটা ধারণা করা যায়। তাই এ সুপারিশগুলোর পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তবে আমি আমার আলোচনা শুধু সংবিধানের প্রস্তাবনা পরিবর্তনের সুপারিশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব।

সংবিধান সংস্কার কমিশন বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনা বাদ দিয়ে নতুন একটি প্রস্তাবনা সুপারিশ করেছে। নতুন প্রস্তাবনায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়া হয়েছে; রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং সর্বোপরি ১৯৭২ সালের গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান রচনা, সংবিধান গ্রহণ ও গ্রহণের ঘোষণা ও তারিখ বাদ দেওয়া হয়েছে। এই পরিবর্তনের তাৎপর্য কী?

প্রস্তাবনা সংবিধানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেখানে সংবিধানের মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মূলনীতিমালা লিপিবদ্ধ থাকে এবং মূল সংবিধানের পথনির্দেশনা দেয়। প্রস্তাবনা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়ার গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রয়েছে। কারণ, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল। এই দলিলের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় এবং এর মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত দেশ পরিচালিত হয়।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের তৎকালীন প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকার এটিকে অনুমোদন দিয়েছে। কাজেই এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এর সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস জড়িত। সংবিধান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়া মানে হলো পরবর্তী সময়ে তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে।

প্রস্তাবনায় রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার বিদ্যমান চারটি মূলনীতি হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এর মধ্যে গণতন্ত্র ছাড়া বাকি তিনটি মূলনীতি বাদ দিয়ে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও বহুত্ববাদ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। মূলনীতির এই ব্যাপক পরিবর্তনের তাৎপর্য কী হতে পারে?

প্রথমেই আসা যাক ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে। ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছিল।

পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে একটি অসাম্প্রদায়িক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব ধর্ম, বর্ণ ও গোষ্ঠীর মানুষ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এর ফলে অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুক্তিযুদ্ধের একটি আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করেন। তা ছাড়া রাষ্ট্রের একটি অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা করা। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার উপস্থিতি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের একটি আইনি রক্ষাকবচ। পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এ রকম আইনি সুরক্ষা দেওয়ার উদাহরণ রয়েছে।

ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার যুক্তি হিসেবে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাক্‌-সাংবিধানিক কোনো নথিতে অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ বা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার বা ১৯৭১ সালের আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত পাকিস্তানের খসড়া সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ ছিল না।

যেকোনো গণ-অভ্যুত্থান, বিপ্লব বা সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধ একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনা-আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এ অঞ্চলের সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে একত্রে এনেছিল এবং তাদের চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল।

পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরপরই ১৯৫০ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি তুলেছিলেন। ১৯৫০ সালের আন্দোলনে তিনি দুটি দাবি উত্থাপন করেছিলেন। একটি হলো বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং অপরটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। তাঁর এই চিন্তার প্রতিফলন ঘটে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। (পিটার কাস্টার্স, মাওলানা ভাসানী অ্যান্ড দ্য ট্রানজিশন টু সেকুলার পলিটিকস ইন ইস্ট বেঙ্গল, ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল হিস্টোরি রিভিউ, এপ্রিল-জুন ২০১০)

প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্যানধারণাটি বাংলাদেশে পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই ছিল। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯১৮ সালে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ সম্মেলনে বলেছিলেন, হিন্দু জমিদার এবং মুসলমান জমিদার, হিন্দু মহাজন এবং মুসলমান মহাজনের শোষণ-নিপীড়নের মধ্যে কোনো তারতম্য নেই। হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে সব দরিদ্র কৃষক একইভাবে শোষণ-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। কাজেই মুসলমান কৃষকদের শোষণের বিষয়টি সাম্প্রদায়িক নয়, এর মূলে রয়েছে জমিদারি ও মহাজনি ব্যবস্থায়। এ জন্য হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে জমিদারি ও মহাজনি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করা উচিত।

পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট গণপরিষদের প্রথম সভায় তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, পাকিস্তান হবে এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রতে্যক নাগরিক সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, ‘তোমরা স্বাধীন; তোমরা তোমাদের মন্দিরে যেতে স্বাধীন, তোমাদের মসজিদে যেতে স্বাধীন অথবা পাকিস্তান রাষ্ট্রের যেকোনো উপাসনালয়ে যেতে স্বাধীন। তোমরা যেকোনো ধর্ম-বর্ণের হতে পারো, এটা রাষ্ট্রের কোনো বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে রাজনৈতিক বিবেচনায়, ধর্মীয় বিবেচনায় নয়।’ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা তাঁর আদর্শ থেকে সরে আসেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মকে একীভূত করে ফেলেন।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার আরও একটি যুক্তি দেওয়া হয়েছে এই বলে যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের বিদ্যমান বহুত্ববাদী সমাজের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং মূলত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাবিরোধী।’ বহুত্ববাদী একটি আধুনিক ধারণা, এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে একেবারে নতুন এবং এর মর্মার্থ এখনো অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। তবে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদ পরস্পরবিরোধী নয়, বরং পরস্পরের পরিপূরক।

ধর্মনিরপেক্ষতা সব ধর্মবিশ্বাসীকে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম বা বিশ্বাস প্রতিপালনের নিশ্চয়তা প্রদান করে, যা প্রকারান্তরে সব ধর্মবিশ্বাসীর সহাবস্থান এবং বহুত্ববাদের জন্য সহায়ক। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি মানবিক মৌলিক অধিকার আর বহুত্ববাদ একটি আদর্শ বা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। আমরা অবশ্যই বহুত্ববাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই, কিন্তু ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো মৌলিক মানবাধিকার বাদ দিয়ে নয়।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের একটি বড় স্ববিরোধিতা হচ্ছে, একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, অন্যদিকে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বর্তমান বিধান বহাল রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। বহুত্ববাদের দোহাই দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার সুপারিশ স্পষ্টতই কমিশনের বর্ণিত বহুত্ববাদ ও সাম্যের বিরোধী এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।

মুক্তিযুদ্ধের মতোই ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানেও বিভিন্ন ধর্ম বা বিশ্বাসের মানুষ একত্রে ‘বৈষম্যহীন’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। তাই স্ববিরোধী যুক্তি দিয়ে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থী।

সংবিধান সংস্কার কমিশন বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনার শেষ অনুচ্ছেদে সংবিধান গ্রহণ, গ্রহণ প্রক্রিয়া, গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ, গ্রহণের তারিখ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ দিয়ে ‘জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করছি’—এমন কথা যুক্ত করার সুপারিশ করেছে। এর অর্থ হচ্ছে এই কমিশন ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান বাদ দিয়ে একটি নতুন সংবিধান গ্রহণের সুপারিশ করেছে।

এই সুপারিশ অনেকগুলো মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন ‘জনগণের সম্মতি’ কীভাবে নেওয়া হয়েছে, এই ‘আমরা’ কারা? তাদের সংবিধান গ্রহণের এখতিয়ার কোথা থেকে এল? কারা এই সংবিধান রচনা করলেন? এবং কোন তারিখে সংবিধান গ্রহণ করেছেন? প্রস্তাবনার এই মৌলিক পরিবর্তনগুলো বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, একটি নতুন সংবিধান রচনা বা গ্রহণের এখতিয়ার এই কমিশনের আছে কি না? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৭ অক্টোবরের যে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই কমিশন গঠন করেছে, সেখানে এই কমিশনের কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করিয়া সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রস্তুত করিতে’ সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করিল।

সরকারের প্রজ্ঞাপন থেকে এটা স্পষ্ট, এই কমিশনের কার্যপরিধি সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করা, বিদ্যমান সংবিধান বাদ দেওয়া বা নতুন সংবিধান রচনা বা প্রণয়ন করা নয়। বিদ্যমান সংবিধানের শেষ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের সুপারিশের মাধ্যমে সংস্কার কমিশন তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ করেছে। প্রস্তাবনা সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে বলে প্রস্তাবনা পরিবর্তনের সুপারিশ করার এখতিয়ার সংস্কার কমিশনের নেই।

কমিশন ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’কে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে; যদিও এই মূলনীতিগুলোর ব্যাখ্যা এখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এই প্রত্যয় বা ধারণাগুলো অনেক ব্যাপক; এগুলোর মর্মার্থ বহুবিধ এবং বহুমাত্রিক হতে পারে।

‘সাম্য’ ধারণাটির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আরও বহু মর্মার্থ রয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাম্য, নারী-পুরুষের সাম্য, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাম্য প্রভৃতি। ‘মানবিক মর্যাদা’ এবং ‘বহুত্ববাদ’—এই ধারণাগুলো নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার উল্লেখ করা হয়েছে।

এই ধারণাগুলো হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেখানে আমরা ক্রমান্বয়ে এবং ধাপে ধাপে সমাজকে নিয়ে পৌঁছাতে চাই। কিন্তু এগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতিমালা হতে পারে না। রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এক নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতিমালা হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিক মূল্যবোধ, রাষ্ট্র পরিচালনার ‘গাইডিং ফ্রেমওয়ার্ক’ এবং জাতির আদর্শের প্রতীক। অন্যদিকে রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্র ভবিষ্যতে পৌঁছাতে চায়।

‘বহুত্ববাদ’ একটি চমৎকার আধুনিক ধারণা, যেখানে সব ধর্ম, বর্ণ, মত-পথ, জীবনব্যবস্থা ও আদর্শের সহাবস্থানকে বোঝায়। কিন্তু আমাদের সমাজ কি এখনো এ রকম বহুত্ববাদ ধারণা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত? আমাদের সংবিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেক ব্যাপক ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমাজের বিদ্যমান আদর্শ ও মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। ‘বহুত্ববাদ’ ধারণাটি আদর্শ হিসেবে চমৎকার হলেও সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে এর নজির পাওয়া কঠিন।

সংবিধানের প্রস্তাব পরিবর্তনের ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে। সংবিধান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়া, রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতির ব্যাপক পরিবর্তন এবং প্রস্তাবনার শেষ অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে নতুন অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করলে তা আমাদের দ্বিধাবিভক্ত করতে পারে। বর্তমানে দেশ একটি ক্রান্তিকালীন সময় পার করছে। একদিকে বিপর্যস্ত অর্থনীতি, অস্থির রাজনীতি, অস্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। এ রকম অবস্থায় সংবিধান সংস্কার নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা উচিত হবে না। যে প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দল ও মতের লোকজন একমত হবে এবং জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সহজ হবে, সেই পথে অগ্রসর
হতে হবে।

গোলাম রসুল অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা।

ই-মেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র র স প র শ কর র স প র শ কর ছ স ব ধ ন গ রহণ স ব ধ ন রচন ১৯৭১ স ল র অন চ ছ দ র জন ত ক ম সলম ন ব যবস থ গ রহণ র ক ত কর আম দ র র জন য র র জন র পর প কর ছ ল র একট আদর শ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এই ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ কলোনি’ হিসেবে লুণ্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজি পাচার ও অমানুষিক নিপীড়নের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল, সে সম্পর্কে নিচে কয়েকটি নজির উপস্থাপন করছি। এগুলো জানার পর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কারোরই পাকিস্তানপ্রেমী হওয়া অযৌক্তিক। কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবিরোধী হয়, সেটাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করলে দোষণীয় নয়। কিন্তু পাকিস্তান তো এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। 

১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ, কিন্তু উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তগুলো প্রমাণ করছে, কত নির্মমভাবে পাকিস্তানের শাসকমহল পূর্ব পাকিস্তানকে (‘পূর্ব বাংলা’ থেকে যার নাম ১৯৫৫ সালে হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’) বঞ্চনা, শোষণ, লুণ্ঠন, পুঁজি-পাচার ও বৈষম্যের শিকার করেছিল—

১. প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের ৭৫-৭৭ শতাংশই আসত পূর্ব বাংলার রপ্তানি পণ্য থেকে। ওই রপ্তানি আয়ের প্রায় পুরোটাই ১৯৪৭-৪৮ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নিতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল, তখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দ করা হলেও ১৯৪৭-১৯৭১ এই ২৪ বছরের শেষে এসেও কখনোই বছরে রপ্তানি আয়ের এক-পঞ্চমাংশও পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের ভাগে পায়নি, এই ২৪ বছরের গড় বার্ষিক হিস্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।

২. ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ২৪ বছরে ওই বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর ওই ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল দাতাদেশ ও সংস্থাগুলো নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি

৩. পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল, তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতারা পেয়েছে, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা কবজা করে নিয়েছেন।

৪. ওই ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে।

৫. ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে।

৬. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানিদের অনুপাত কখনোই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি ৫ শতাংশেও পৌঁছায়নি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।

৭. ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্পকারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকি ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা নয়তো অবাঙালিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্পকারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না।

৮. মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছিল পাকিস্তানে।

৯. ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা।

১০. যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার।

১১. পাকিস্তানের তিনটা রাজধানী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের বিপুল নির্মাণ ব্যয়ের সিংহভাগই বহন করেছিল পূর্ব পাকিস্তান।

১২. ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ ও এর শাখাগুলোতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে। এ কারণে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি ১৯৭০ সালে সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে ওই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হয়েছিল। উপরন্তু আর্থিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যার সমাধানে অর্থায়ন করতে বারবার অস্বীকার করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।

স্বাধীনতা-উত্তর ৫৪ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন বারবার বিঘ্নিত হলেও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৫ সালে ২ হাজার ৭৫০ ডলার ছাড়িয়েছে, অথচ পাকিস্তানের মাত্র ১ হাজার ৫৪৭ ডলার। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য কতখানি যৌক্তিক ছিল।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার সরকারের মতো ভারতের কাছে নতজানু হবে না, সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার প্রায় তিন পাশ ঘিরে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় না রাখলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না