চট্টগ্রামে পানি সংকট তীব্র হয়েছে। যেসব এলাকায় পানি আছে, মুখে তোলা যাচ্ছে না লবণাক্ততায়। অনেক অঞ্চলে মিলছে না ব্যবহারের পানিও। রমজানে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। নাকাল নগরবাসী ক্ষোভে ফুঁসছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত মাসের শেষ দিকে বন্দরনগরীর সুপেয় পানির উৎস কর্ণফুলী নদী ও হালদা নদে ঢুকে পড়ে সাগরের পানি। সংকটের কারণে কাপ্তাই লেক থেকে পাওয়া যাচ্ছে না মিঠা পানি। লবণাক্ততা এড়াতে জোয়ারের সময় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পানি সংগ্রহ বন্ধ রাখছে ওয়াসা। আবার গভীর নলকূপ থেকে যা উঠছে, তা মিশিয়েও কমছে না লবণের তীব্রতা। ফলে উৎপাদন কমে সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নগরীতে বিভিন্ন আকারের ৫ হাজার ৩০০ গভীর নলকূপ রয়েছে। অবৈধ নলকূপ আরও কয়েক গুণ। অবৈধভাবে ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় এসব ভবনের মালিকের তেমন সমস্যা হচ্ছে না। বাকিদের ত্রাহি দশা। অবশ্য নির্বিচারে এভাবে তোলায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর– বলছেন পরিবেশবিদরা। কর্ণফুলী নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড.

ইদ্রিস আলী বলেন, নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা বন্ধ না হলে শিগগির বড় বিপর্যয় নেমে আসবে।

সুপেয় পানিতে লবণের স্বাভাবিক মাত্রা লিটারে ২৫০ মিলিগ্রাম। বর্তমানে ওয়াসার পানিতে মাত্রা ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম। খোদ চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল আমিন মাত্রাতিরিক্ত লবণের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘কর্ণফুলী ও হালদা থেকে সংগ্রহ করা পানিতে লবণের মাত্রা পাওয়া যাচ্ছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম। এ কারণে আমরা জোয়ারের সময় কয়েক ঘণ্টা পানি সংগ্রহ বন্ধ রাখছি। তার পরও লবণের প্রভাব কমছে না।’

জানা যায়, কাপ্তাই লেক থেকে পানি ছাড়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ যেমন উৎপাদন হয়, তেমনি তা সাগরের পানি নদীতে ঢুকতে বাধা দেয়। বৃষ্টি হলে সাগরের পানি নদীকে তেমন লবণাক্ত করতে পারে না। এখন বৃষ্টি নেই। কমে যাওয়ায় কাপ্তাই লেক থেকে তেমন পানি ছাড়া হচ্ছে না। ফলে প্রধান উৎসের পানি লবণমুক্ত করতে পারছে না ওয়াসা। আবার গভীর নলকূপ থেকে পাওয়া পানি মিশিয়েও পানযোগ্য করা সম্ভব হচ্ছে না।

নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা হাসান মুরাদ মামুন বলেন, ‘পানি নিয়মিত পাওয়া যায়। তবে গ্রীষ্ম শুরু হলে লবণাক্ততার কারণে ওয়াসার পানি মুখে তোলা যায় না। এবারও একই সমস্যা হচ্ছে। বোতলজাত পানি কিনতে গিয়ে দিশেহারা।’

লবণমুক্ত করতে নির্বিকার ওয়াসা

বিভিন্ন উপায়ে পানি লবণমুক্ত করা যায়। জটিল এবং ব্যয়বহুল হলেও বিভিন্ন দেশে এটি হচ্ছে। দীর্ঘদিন নগরবাসী ভুগলেও কোনো উদ্যোগ নেই চট্টগ্রাম ওয়াসার। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের মানুষ। ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে লবণাক্ততার কারণে ওয়াসার পানি পান করা যায় না। একের পর এক বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে অর্থ নয়ছয় হচ্ছে। অথচ রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়ায় পানি লবণমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেই।

ভরাটের সঙ্গে নতুন আপদ শ্যাওলা

কর্ণফুলী ও হালদার তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি কাপ্তাই লেক থেকে পানি ছাড়া হচ্ছে নামমাত্র। ফলে পানির প্রবাহ কমে গেছে। স্থিতি অবস্থার কারণে নদীতে জন্ম নিচ্ছে শ্যাওলা। বিশেষ করে যেসব পয়েন্ট থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়, সেখানে শ্যাওলা থাকায় বিপাকে পড়েছে ওয়াসা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাপ্তাই হ্রদ, কর্ণফুলী ও হালদা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কর্ণফুলী ও হালদার একাংশ ড্রেজিং না করলে আগামীতে সুপেয় পানির উৎস সংকটে ভুগতে হবে।

নুরুল আমিন বলেন, ‘কাপ্তাই থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ছাড়া হচ্ছে না। এবার বৃষ্টিও কম হয়েছে। ফলে কর্ণফুলী ও হালদায় পানি চলাচলের গতি কমে প্রাকৃতিকভাবে জন্মেছে শ্যাওলা। পানি সংগ্রহে শ্যাওলা বড় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।’

কাপ্তাই লেক থেকে পানি ছেড়ে পাঁচ ইউনিটের মাধ্যমে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যে পানি ছেড়ে বিদ্যুৎ হয়, সেটিই কর্ণফুলী ও হালদার প্রাণ। কারণ কাপ্তাই লেকের পানির বাধায় দুই নদীতে ঢুকতে পারে না সাগরের পানি।

কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, পানি কমে যাওয়ায় পাঁচটির মধ্যে এখন চার ইউনিট বন্ধ। ৪০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ইউনিট চালু রাখতে যে পরিমাণ পানি ছাড়া হচ্ছে, তা সাগরের পানিকে বাধা দিতে অক্ষম। এ সময় কাপ্তাইয়ে ৯২ দশমিক ২০ মিনস সি লেভেল (এমএসএল) পানি থাকার কথা। অথচ রয়েছে ৮৮ দশমিক ৫২। এ জন্য পানি কম ছাড়ছে কর্তৃপক্ষ।

দিনে উৎপাদন কমেছে ৬ কোটি লিটার

ওয়াসার পানি সরবরাহের সবচেয়ে বড় দুটি প্রকল্প হলো– রাঙ্গুনিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প-১ ও ২। এর মাধ্যমে কর্ণফুলী নদী থেকে প্রতিদিন ২৮ কোটি লিটার পানি সংগ্রহ করা হয়। হালদা নদের মদুনাঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্প এবং মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পে প্রতিদিন ৯ কোটি লিটার উৎপাদন হয়। এর বাইরে ৫০টি গভীর নলকূপ থেকে মেলে চার কোটি লিটার। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি দিয়ে মেটানো হয় নগরবাসীর চাহিদা। কিন্তু লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দিনে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা নদী থেকে পানি সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ রাখছে ওয়াসা। এতে উৎপাদন প্রায় ছয় কোটি লিটার কমে গেছে। কমবেশি নগরীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ পানি বঞ্চিত। কোনো কোনো এলাকায় একেবারেই মিলছে না। বিশেষ করে নগরীর বাকলিয়া, বায়েজিদ, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, সরাইপাড়া, পতেঙ্গা, হালিশহর, আকবর শাহ, কাট্টলী, আগ্রাবাদ, মুরাদপুরে নিয়মিত পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

আকবর শাহ এলাকার বাসিন্দা কাজী আহমদ উল্লাহ বলেন, ‘বছরজুড়েই পানি সংকট থাকে। তবে গ্রীষ্ম শুরু হলে তেমন একটা পাওয়া যায় না। যা মেলে, তাতে প্রচুর ময়লা ও দুর্গন্ধ। এর মধ্যে নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে লবণাক্ততা।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: লবণ ক ত প রকল প লবণ র নগর র

এছাড়াও পড়ুন:

২ উপদেষ্টার গড়ি আটকে বিক্ষোভের ঘটনায় ১৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ৩

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ে দুই উপদেষ্টার গাড়ি আটকে বিক্ষোভের ঘটনায় মামলা করা হয়েছে।

বেআইনিভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে অবৈধভাবে গতিরোধ করা, সরকারি কাজে বাধা ও বিশৃঙ্খলার অভিযোগে রোববার রাতে গোয়ানঘাট থানায় ১৫০ জনকে আসামি করে এ মামলা করেন থানার এসআই ওবায়েদ উল্লাহ। মামলার পর সোমবার ভোরে তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরা হলেন- মামলার ৬নং আসামি কালিনগরের দেলোয়ার হোসেন দুলু, মোহাম্মদপুরের শাহজাহান মিয়া ও ছৈলাখেল অষ্টম খন্ডের বাসিন্দা ফারুক আহমেদ।

শনিবার সকালে জাফলং এলাকা পরিদর্শনে যান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তারা ফেরার পথে জাফলং পাথর কোয়ারি চালুর দাবিতে বিএনপির সংগঠনের নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে দুই উপদেষ্টার আটকে নানান স্লোগানে বিক্ষোভ করা হয়। ঘটনার পর গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খানকে বহিষ্কার ও জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদল সভাপতি আজির উদ্দিনকে শোকজ করেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা।

গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরকার তোফায়েল আহমদ তিনজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে সমকালকে জানান, গতকাল রাতে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে ১৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করা হয়েছে। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সদ্য বহিষ্কৃত গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খানকে। দ্বিতীয় আসামি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিন। অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- সোহেল আহমদ, ওমর ফারুক, সুমন শিকদার, দেলোয়ার হোসেন দুলু, আব্দুস সালাম ও আব্দুল জলিল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ