চট্টগ্রামে রোজায় সুপেয় পানির হাহাকার
Published: 7th, March 2025 GMT
চট্টগ্রামে পানি সংকট তীব্র হয়েছে। যেসব এলাকায় পানি আছে, মুখে তোলা যাচ্ছে না লবণাক্ততায়। অনেক অঞ্চলে মিলছে না ব্যবহারের পানিও। রমজানে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। নাকাল নগরবাসী ক্ষোভে ফুঁসছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত মাসের শেষ দিকে বন্দরনগরীর সুপেয় পানির উৎস কর্ণফুলী নদী ও হালদা নদে ঢুকে পড়ে সাগরের পানি। সংকটের কারণে কাপ্তাই লেক থেকে পাওয়া যাচ্ছে না মিঠা পানি। লবণাক্ততা এড়াতে জোয়ারের সময় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পানি সংগ্রহ বন্ধ রাখছে ওয়াসা। আবার গভীর নলকূপ থেকে যা উঠছে, তা মিশিয়েও কমছে না লবণের তীব্রতা। ফলে উৎপাদন কমে সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নগরীতে বিভিন্ন আকারের ৫ হাজার ৩০০ গভীর নলকূপ রয়েছে। অবৈধ নলকূপ আরও কয়েক গুণ। অবৈধভাবে ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় এসব ভবনের মালিকের তেমন সমস্যা হচ্ছে না। বাকিদের ত্রাহি দশা। অবশ্য নির্বিচারে এভাবে তোলায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর– বলছেন পরিবেশবিদরা। কর্ণফুলী নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড.
সুপেয় পানিতে লবণের স্বাভাবিক মাত্রা লিটারে ২৫০ মিলিগ্রাম। বর্তমানে ওয়াসার পানিতে মাত্রা ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম। খোদ চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল আমিন মাত্রাতিরিক্ত লবণের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘কর্ণফুলী ও হালদা থেকে সংগ্রহ করা পানিতে লবণের মাত্রা পাওয়া যাচ্ছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম। এ কারণে আমরা জোয়ারের সময় কয়েক ঘণ্টা পানি সংগ্রহ বন্ধ রাখছি। তার পরও লবণের প্রভাব কমছে না।’
জানা যায়, কাপ্তাই লেক থেকে পানি ছাড়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ যেমন উৎপাদন হয়, তেমনি তা সাগরের পানি নদীতে ঢুকতে বাধা দেয়। বৃষ্টি হলে সাগরের পানি নদীকে তেমন লবণাক্ত করতে পারে না। এখন বৃষ্টি নেই। কমে যাওয়ায় কাপ্তাই লেক থেকে তেমন পানি ছাড়া হচ্ছে না। ফলে প্রধান উৎসের পানি লবণমুক্ত করতে পারছে না ওয়াসা। আবার গভীর নলকূপ থেকে পাওয়া পানি মিশিয়েও পানযোগ্য করা সম্ভব হচ্ছে না।
নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা হাসান মুরাদ মামুন বলেন, ‘পানি নিয়মিত পাওয়া যায়। তবে গ্রীষ্ম শুরু হলে লবণাক্ততার কারণে ওয়াসার পানি মুখে তোলা যায় না। এবারও একই সমস্যা হচ্ছে। বোতলজাত পানি কিনতে গিয়ে দিশেহারা।’
লবণমুক্ত করতে নির্বিকার ওয়াসা
বিভিন্ন উপায়ে পানি লবণমুক্ত করা যায়। জটিল এবং ব্যয়বহুল হলেও বিভিন্ন দেশে এটি হচ্ছে। দীর্ঘদিন নগরবাসী ভুগলেও কোনো উদ্যোগ নেই চট্টগ্রাম ওয়াসার। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের মানুষ। ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে লবণাক্ততার কারণে ওয়াসার পানি পান করা যায় না। একের পর এক বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে অর্থ নয়ছয় হচ্ছে। অথচ রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়ায় পানি লবণমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেই।
ভরাটের সঙ্গে নতুন আপদ শ্যাওলা
কর্ণফুলী ও হালদার তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি কাপ্তাই লেক থেকে পানি ছাড়া হচ্ছে নামমাত্র। ফলে পানির প্রবাহ কমে গেছে। স্থিতি অবস্থার কারণে নদীতে জন্ম নিচ্ছে শ্যাওলা। বিশেষ করে যেসব পয়েন্ট থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়, সেখানে শ্যাওলা থাকায় বিপাকে পড়েছে ওয়াসা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাপ্তাই হ্রদ, কর্ণফুলী ও হালদা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কর্ণফুলী ও হালদার একাংশ ড্রেজিং না করলে আগামীতে সুপেয় পানির উৎস সংকটে ভুগতে হবে।
নুরুল আমিন বলেন, ‘কাপ্তাই থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ছাড়া হচ্ছে না। এবার বৃষ্টিও কম হয়েছে। ফলে কর্ণফুলী ও হালদায় পানি চলাচলের গতি কমে প্রাকৃতিকভাবে জন্মেছে শ্যাওলা। পানি সংগ্রহে শ্যাওলা বড় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।’
কাপ্তাই লেক থেকে পানি ছেড়ে পাঁচ ইউনিটের মাধ্যমে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যে পানি ছেড়ে বিদ্যুৎ হয়, সেটিই কর্ণফুলী ও হালদার প্রাণ। কারণ কাপ্তাই লেকের পানির বাধায় দুই নদীতে ঢুকতে পারে না সাগরের পানি।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, পানি কমে যাওয়ায় পাঁচটির মধ্যে এখন চার ইউনিট বন্ধ। ৪০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ইউনিট চালু রাখতে যে পরিমাণ পানি ছাড়া হচ্ছে, তা সাগরের পানিকে বাধা দিতে অক্ষম। এ সময় কাপ্তাইয়ে ৯২ দশমিক ২০ মিনস সি লেভেল (এমএসএল) পানি থাকার কথা। অথচ রয়েছে ৮৮ দশমিক ৫২। এ জন্য পানি কম ছাড়ছে কর্তৃপক্ষ।
দিনে উৎপাদন কমেছে ৬ কোটি লিটার
ওয়াসার পানি সরবরাহের সবচেয়ে বড় দুটি প্রকল্প হলো– রাঙ্গুনিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প-১ ও ২। এর মাধ্যমে কর্ণফুলী নদী থেকে প্রতিদিন ২৮ কোটি লিটার পানি সংগ্রহ করা হয়। হালদা নদের মদুনাঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্প এবং মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পে প্রতিদিন ৯ কোটি লিটার উৎপাদন হয়। এর বাইরে ৫০টি গভীর নলকূপ থেকে মেলে চার কোটি লিটার। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি দিয়ে মেটানো হয় নগরবাসীর চাহিদা। কিন্তু লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দিনে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা নদী থেকে পানি সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ রাখছে ওয়াসা। এতে উৎপাদন প্রায় ছয় কোটি লিটার কমে গেছে। কমবেশি নগরীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ পানি বঞ্চিত। কোনো কোনো এলাকায় একেবারেই মিলছে না। বিশেষ করে নগরীর বাকলিয়া, বায়েজিদ, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, সরাইপাড়া, পতেঙ্গা, হালিশহর, আকবর শাহ, কাট্টলী, আগ্রাবাদ, মুরাদপুরে নিয়মিত পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
আকবর শাহ এলাকার বাসিন্দা কাজী আহমদ উল্লাহ বলেন, ‘বছরজুড়েই পানি সংকট থাকে। তবে গ্রীষ্ম শুরু হলে তেমন একটা পাওয়া যায় না। যা মেলে, তাতে প্রচুর ময়লা ও দুর্গন্ধ। এর মধ্যে নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে লবণাক্ততা।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: লবণ ক ত প রকল প লবণ র নগর র
এছাড়াও পড়ুন:
শুল্ক কমেছে, বাংলাদেশে স্বস্তি
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশের ওপর দেশটির আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসের এক ঘোষণায় এ কথা বলা হয়। বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কহার কমে প্রতিযোগীদের কাছাকাছি অবস্থানে আসার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক।
২৯ জুলাই থেকে তিন দিনের আলোচনা ও দর-কষাকষির শেষ দিন ৩১ জুলাই এ ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭০টি দেশের ওপর ১০ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসে।
পাল্টা শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ নামিয়ে আনতে বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকেও বেশ কিছু সুবিধা দিতে হয়েছে। একদিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পান গত ২১ জানুয়ারি। এর দুই মাস পর গত ২ এপ্রিল হঠাৎ বিশ্বের ৭০ দেশের জন্য বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। অনেকেই ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে একধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলে সমালোচনা করেছেন।
প্রথমে গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা হয় ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক। মাঝখানে তিন মাস স্থগিত রাখার পর ৮ জুলাই তা কমিয়ে ট্রাম্প ৩৫ শতাংশ করেন। বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ করায় মোট শুল্কহার দাঁড়াবে এখন ৩৫ শতাংশে।
দর-কষাকষির মাধ্যমে ঘোষিত শুল্কহার কমিয়ে আনাকে ঐতিহাসিক চুক্তি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের আলোচকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে আলোচনা করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন আলোচকদের মধ্যে আরও ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে বলেছে, অনেক বিষয় জড়িত থাকায় শুল্ক আলোচনার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয়টি শুধু শুল্ক কমানোর সঙ্গেই যুক্ত ছিল না; বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্যঘাটতি ও নিরাপত্তা–সংক্রান্ত মার্কিন উদ্বেগও ছিল এর সঙ্গে। সমাধানের বিষয়টি নির্ভর করছিল একটি দেশের সদিচ্ছার ওপরও।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা গতকাল প্রথম আলোকে জানান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকব এবং যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আমরা ২০ শতাংশের নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম।’
প্রতিযোগী দেশগুলোর শুল্কহারযুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
বাংলাদেশের সমান ২০ শতাংশ ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কা এবং ১৯ শতাংশ হার নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কম রয়েছে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের হারও ১৯ শতাংশ। তাইওয়ানের ওপর ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ; জাপান, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৪১ শতাংশ শুল্কহার সিরিয়ার ওপর। বেশি হার আরোপ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে লাওস ও মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ; সুইজারল্যান্ডের ওপর ৩৯ শতাংশ; ইরাক ও সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ এবং লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিচ্ছে বাংলাদেশসরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেশন পুরোপুরি মেনে চলারও অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে দেশটি থেকে দাম বেশি দিয়ে হলেও বছরে সাত লাখ টন করে গম কেনা হবে পাঁচ বছর ধরে। ইতিমধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি।
দেশটি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আগে থেকেই আমদানি করা হচ্ছে। তা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৯ থেকে ১১ জুলাই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সফল না হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে, সেসব পণ্যের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ১৭ থেকে ২৩ জুলাই সপ্তাহব্যাপী অনলাইনে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়েই তিনি বৈঠকগুলো করেন।
গত ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (প্রকাশ না করার চুক্তি) করার কারণে সরকারি প্রতিনিধিদলে অন্য কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ভেতরে-ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
সরকারের আহ্বানে সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে। এসব সভায় তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেন তাঁরা। বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ১৩ কোটি ডলারে ৩ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রায় ১০ কোটি ডলারের সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
এ ছাড়া ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ১৯ হাজার টন তুলা আমদানির সমঝোতার চুক্তি করেছে বস্ত্র খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কার্গিল ইনকরপোরেটের কাছ থেকে এশিয়া কম্পোজিট ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে ৬ হাজার টন আমদানির এমওইউ করেছে। একই দরে একই পরিমাণ তুলা আমদানির এমওইউ করেছে সালমা গ্রুপও। এ ছাড়া মোশাররফ গ্রুপ মার্কিন লুইস ড্রেফাস গ্রুপ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ৭ হাজার টন তুলা আমদানির এমওইউ করেছে।
কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ২০ শতাংশ শুল্কহার ঠিক করতে পেরেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, এটাই হচ্ছে প্রধান কারণ।’
ট্রেড ইউনিয়ন, মজুরি, শ্রমিক নিপীড়ন, মামলা—এসব বিষয় আলোচনায় উঠেছিল কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে। শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখতে জোর দিয়েছে তারা। আমরা আইএলও কনভেনশন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ জন্য শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চলছে।’
‘অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা’ওয়াশিংটনে দর-কষাকষিতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টা শুল্ক কমার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, তাতে বাংলাদেশ বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে রেহাই পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘সময়সীমার মধ্যেই জটিল আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। নইলে ৩৫ শতাংশের গুরুভার বহন করে যেতে হতো।’
খলিলুর রহমান আরও বলেন, প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান অথবা যত্সামান্য বেশি এবং ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য এখন প্রতিযোগিতামূলক থাকবে। তৈরি পোশাকশিল্প ও এর ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টার উদ্দেশে ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় তিনি (শেখ বশিরউদ্দীন) সমালোচকদের হতাশ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আল্লাহ তাঁকে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, যাতে তিনি দেশকে সেবা দিতে পারেন, হোক তা সরকারে বা বেসরকারি খাতে।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। তবে আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই, বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্যকৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির প্রথম আলোকে বলেন, একটি বিশ্বশক্তির চাপের মুখে এই সাফল্য অর্জনের জন্য সরকার ও আলোচক দলের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন। এটি সম্ভবত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে কঠিন লড়াইগুলোর একটি ছিল, যা পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন তাঁরা।