চট্টগ্রামে রোজায় সুপেয় পানির হাহাকার
Published: 7th, March 2025 GMT
চট্টগ্রামে পানি সংকট তীব্র হয়েছে। যেসব এলাকায় পানি আছে, মুখে তোলা যাচ্ছে না লবণাক্ততায়। অনেক অঞ্চলে মিলছে না ব্যবহারের পানিও। রমজানে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। নাকাল নগরবাসী ক্ষোভে ফুঁসছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত মাসের শেষ দিকে বন্দরনগরীর সুপেয় পানির উৎস কর্ণফুলী নদী ও হালদা নদে ঢুকে পড়ে সাগরের পানি। সংকটের কারণে কাপ্তাই লেক থেকে পাওয়া যাচ্ছে না মিঠা পানি। লবণাক্ততা এড়াতে জোয়ারের সময় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পানি সংগ্রহ বন্ধ রাখছে ওয়াসা। আবার গভীর নলকূপ থেকে যা উঠছে, তা মিশিয়েও কমছে না লবণের তীব্রতা। ফলে উৎপাদন কমে সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নগরীতে বিভিন্ন আকারের ৫ হাজার ৩০০ গভীর নলকূপ রয়েছে। অবৈধ নলকূপ আরও কয়েক গুণ। অবৈধভাবে ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় এসব ভবনের মালিকের তেমন সমস্যা হচ্ছে না। বাকিদের ত্রাহি দশা। অবশ্য নির্বিচারে এভাবে তোলায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর– বলছেন পরিবেশবিদরা। কর্ণফুলী নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড.
সুপেয় পানিতে লবণের স্বাভাবিক মাত্রা লিটারে ২৫০ মিলিগ্রাম। বর্তমানে ওয়াসার পানিতে মাত্রা ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম। খোদ চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল আমিন মাত্রাতিরিক্ত লবণের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘কর্ণফুলী ও হালদা থেকে সংগ্রহ করা পানিতে লবণের মাত্রা পাওয়া যাচ্ছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম। এ কারণে আমরা জোয়ারের সময় কয়েক ঘণ্টা পানি সংগ্রহ বন্ধ রাখছি। তার পরও লবণের প্রভাব কমছে না।’
জানা যায়, কাপ্তাই লেক থেকে পানি ছাড়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ যেমন উৎপাদন হয়, তেমনি তা সাগরের পানি নদীতে ঢুকতে বাধা দেয়। বৃষ্টি হলে সাগরের পানি নদীকে তেমন লবণাক্ত করতে পারে না। এখন বৃষ্টি নেই। কমে যাওয়ায় কাপ্তাই লেক থেকে তেমন পানি ছাড়া হচ্ছে না। ফলে প্রধান উৎসের পানি লবণমুক্ত করতে পারছে না ওয়াসা। আবার গভীর নলকূপ থেকে পাওয়া পানি মিশিয়েও পানযোগ্য করা সম্ভব হচ্ছে না।
নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা হাসান মুরাদ মামুন বলেন, ‘পানি নিয়মিত পাওয়া যায়। তবে গ্রীষ্ম শুরু হলে লবণাক্ততার কারণে ওয়াসার পানি মুখে তোলা যায় না। এবারও একই সমস্যা হচ্ছে। বোতলজাত পানি কিনতে গিয়ে দিশেহারা।’
লবণমুক্ত করতে নির্বিকার ওয়াসা
বিভিন্ন উপায়ে পানি লবণমুক্ত করা যায়। জটিল এবং ব্যয়বহুল হলেও বিভিন্ন দেশে এটি হচ্ছে। দীর্ঘদিন নগরবাসী ভুগলেও কোনো উদ্যোগ নেই চট্টগ্রাম ওয়াসার। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের মানুষ। ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে লবণাক্ততার কারণে ওয়াসার পানি পান করা যায় না। একের পর এক বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে অর্থ নয়ছয় হচ্ছে। অথচ রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়ায় পানি লবণমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেই।
ভরাটের সঙ্গে নতুন আপদ শ্যাওলা
কর্ণফুলী ও হালদার তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি কাপ্তাই লেক থেকে পানি ছাড়া হচ্ছে নামমাত্র। ফলে পানির প্রবাহ কমে গেছে। স্থিতি অবস্থার কারণে নদীতে জন্ম নিচ্ছে শ্যাওলা। বিশেষ করে যেসব পয়েন্ট থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়, সেখানে শ্যাওলা থাকায় বিপাকে পড়েছে ওয়াসা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাপ্তাই হ্রদ, কর্ণফুলী ও হালদা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কর্ণফুলী ও হালদার একাংশ ড্রেজিং না করলে আগামীতে সুপেয় পানির উৎস সংকটে ভুগতে হবে।
নুরুল আমিন বলেন, ‘কাপ্তাই থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ছাড়া হচ্ছে না। এবার বৃষ্টিও কম হয়েছে। ফলে কর্ণফুলী ও হালদায় পানি চলাচলের গতি কমে প্রাকৃতিকভাবে জন্মেছে শ্যাওলা। পানি সংগ্রহে শ্যাওলা বড় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।’
কাপ্তাই লেক থেকে পানি ছেড়ে পাঁচ ইউনিটের মাধ্যমে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যে পানি ছেড়ে বিদ্যুৎ হয়, সেটিই কর্ণফুলী ও হালদার প্রাণ। কারণ কাপ্তাই লেকের পানির বাধায় দুই নদীতে ঢুকতে পারে না সাগরের পানি।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, পানি কমে যাওয়ায় পাঁচটির মধ্যে এখন চার ইউনিট বন্ধ। ৪০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ইউনিট চালু রাখতে যে পরিমাণ পানি ছাড়া হচ্ছে, তা সাগরের পানিকে বাধা দিতে অক্ষম। এ সময় কাপ্তাইয়ে ৯২ দশমিক ২০ মিনস সি লেভেল (এমএসএল) পানি থাকার কথা। অথচ রয়েছে ৮৮ দশমিক ৫২। এ জন্য পানি কম ছাড়ছে কর্তৃপক্ষ।
দিনে উৎপাদন কমেছে ৬ কোটি লিটার
ওয়াসার পানি সরবরাহের সবচেয়ে বড় দুটি প্রকল্প হলো– রাঙ্গুনিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প-১ ও ২। এর মাধ্যমে কর্ণফুলী নদী থেকে প্রতিদিন ২৮ কোটি লিটার পানি সংগ্রহ করা হয়। হালদা নদের মদুনাঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্প এবং মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পে প্রতিদিন ৯ কোটি লিটার উৎপাদন হয়। এর বাইরে ৫০টি গভীর নলকূপ থেকে মেলে চার কোটি লিটার। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি দিয়ে মেটানো হয় নগরবাসীর চাহিদা। কিন্তু লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দিনে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা নদী থেকে পানি সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ রাখছে ওয়াসা। এতে উৎপাদন প্রায় ছয় কোটি লিটার কমে গেছে। কমবেশি নগরীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ পানি বঞ্চিত। কোনো কোনো এলাকায় একেবারেই মিলছে না। বিশেষ করে নগরীর বাকলিয়া, বায়েজিদ, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, সরাইপাড়া, পতেঙ্গা, হালিশহর, আকবর শাহ, কাট্টলী, আগ্রাবাদ, মুরাদপুরে নিয়মিত পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
আকবর শাহ এলাকার বাসিন্দা কাজী আহমদ উল্লাহ বলেন, ‘বছরজুড়েই পানি সংকট থাকে। তবে গ্রীষ্ম শুরু হলে তেমন একটা পাওয়া যায় না। যা মেলে, তাতে প্রচুর ময়লা ও দুর্গন্ধ। এর মধ্যে নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে লবণাক্ততা।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: লবণ ক ত প রকল প লবণ র নগর র
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।