উত্তরাঞ্চলে এক সময়ের দুই খরস্রোতা নদী সূতিখালী ও করতোয়া। নিয়মিত পণ্য নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নৌযান চলাচল করত। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন হাজারো মানুষ। নদীর পানি সেচের পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হতো। কিন্তু দখল-দূষণে সংকুচিত হয়ে নাব্য হারিয়েছে নদী দুটি। আগের মতো মাছ মেলে না। পৌরসভার নালার সংযোগ দেওয়ায় পানি কালচে হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, আবর্জনায় হচ্ছে ভরাট। পানি না থাকায় নদীর বুকে হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ। খনন করে নদী দুটিতে নাব্য ফেরানোর দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। এরই মধ্যে একটি নদী খননের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।


পৌরসভার নালার সংযোগ দেওয়ার আগে নদীর পানিতে মাছ পাওয়া যেত। দুই পারের মানুষ গোসল করত। এখন নালার দুর্গন্ধযুক্ত পচা পানি পুরো এলাকার পরিবেশ দূষণ করছে। কথাগুলো করতোয়া নদীর খলশী স্লুইসগেট এলাকার বাসিন্দা শাহীন আলমের। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় একসময়ের খরস্রোতা নদীটি পৌরসভার নালায় ভেসে আসা বর্জ্যে ভরাট হচ্ছে। এতে নাব্য হারিয়ে এখন মৃতপ্রায় করতোয়া।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নালার পানির সঙ্গে আসা বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য এবং বাসাবাড়ি ও হাটবাজারের ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে ও মশা-মাছির অত্যাচারে অতিষ্ঠ নদীপারের মানুষ। মাঝেমধ্যেই নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। নালার পথ পরিবর্তনের দাবি তাদের।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী বগুড়া শহরের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে মিশেছে। একসময় এ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন হাজারো জেলে। চলাচল করত নানা ধরনের পণ্যবাহী নৌকা। এতে নদীর দু’পাশে গড়ে ওঠে শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্র। ছিল অসংখ্য জেলেপল্লি। সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দখল-দূষণসহ নানা কারণে এর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় হারিয়ে গেছে নাব্য।
এখন শুধু বর্ষাকালে দেখা মেলে নদীর পানিপ্রবাহ। অন্য সময় প্রায় পানিশূন্য থাকে। এরপরও বিভিন্ন স্থানে আটকে থাকা পানিতে পাওয়া যেত দেশি মাছ। পৌরসভার নালা করতোয়া নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করায় তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এ নালা দিয়ে শহরের বাসাবাড়ি, দোকান-হোটেল, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও হাটবাজারের পশু জবাইয়ের ময়লা পানি প্রবাহিত হয়। অটোরাইস মিলের আবর্জনা ও ছাইয়ে নদী ভরাট হচ্ছে। 
স্থানীয় বাসিন্দা মো.

কাজেম উদ্দিনের ভাষ্য, করতোয়া নদীর পানির যে অবস্থা, মাছ তো দূরের কথা, কোনো জলজ প্রাণীও বসবাস করতে পারে না। এ ছাড়া অটোরাইস মিলের দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানির সঙ্গে ভেসে আসা ছাইয়ে তলদেশ ভরাট হয়ে স্থায়ীভাবে নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে নালার মুখ বন্ধ করে নদীর গতিপথ স্বাভাবিক করার দাবি জানান তিনি।
গোবিন্দগঞ্জ নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক এম এ মতিন মোল্লা বলেন, প্রশাসন অবৈধ দলখদার, পরিবেশ রক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিযান চালায়। পৌর প্রশাসকের দায়িত্বে আছেন ইউএনও। তিনি থাকাকালীন দখল-দূষণ মুক্ত না করে ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করা হয়, সেটা দুঃখজনক। 
ইউএনও ও পৌর প্রশাসক সৈয়দা ইয়াসমিন সুলতানা বলেন, পৌরসভার নির্দিষ্ট ময়লা ফেলার জায়গা নেই। প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে এবং এটি পরিদর্শন করে যথাসম্ভব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ময়ল র স ত প প রসভ র ন ল নদ র প ন প রব হ করত য়

এছাড়াও পড়ুন:

ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা

বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার শ্রমিকেরা বৈশাখ মাসের অপেক্ষায় থাকতেন। বৈশাখে হাওরের বুকজুড়ে সবুজ ধান যখন সোনালি রঙ ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাওরে আসতে থাকেন ধান কাটার শ্রমিকেরা। কিন্তু, এই চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। হাওরের কৃষক এখন ধান কাটার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন। ফলে কৃষকের শ্রম এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে। তবে, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কৃষি শ্রমিকেরা। বাধ্য হয়ে তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।

তিন বছর হলো ধান কাটার পেশা ছেড়েছেন মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের মো. মকবুল মিয়া। এখন তিনি সারাবছর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।

আরো পড়ুন:

খুলনার বরফশ্রমিক
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মকবুল মিয়া বলেন, ‘‘আগে বছরের ছয় মাস বর্ষায় নৌকা বাইতাম, আর হুগনা সিজন আইলে নিজের জমি চাষ করতাম, আবার মাইনষের জমিতেও কামলা দিতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়া আমরার ছয়জনের সংসার চইল্যা যাইতো। কিন্তু, যহন থেইক্যা নতুন নতুন মেশিন হাওরে আইতাছে, তহন থেইক্যা আমরার আর বেইল নাই।’’

‘‘কেউ আর আমরারে আগের মতন দাম দেয় না। কাম করলেও ঠিকমতো টেহা পাই না, তাই পুষায় না,’’ বলেন এই কৃষিশ্রমিক।

মকবুলের মতো ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো, ঝাড়া, কাঁধে বহন করার মতো স্বাধীন পেশা ছেড়েছেন অষ্টগ্রামের ফয়জুল, ইটনার শামছুল মিয়া, নিকলীর ফরিদ উদ্দিনসহ অসংখ্য শ্রমিক। এক সময় যারা এ পেশায় দলবেঁধে কাজ করতেন, এখন দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। ধান কাটার পেশা বদলে তারা এখন কেউ রিকশাচালক, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি-ফুচকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

তারা বলছেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির গতির সঙ্গে তারা কখনো তাল মেলাতে পারবেন না। কৃষকরাও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বেশি জমি যাদের আছে তারাও আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। যে কৃষক অল্প জমিতে চাষাবাদ করেছেন, তারাও আর পয়সা খরচ করে কৃষিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করছেন না। তারা পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। ফলে খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা পড়েছেন বিপাকে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রচুর সময় লাগে। ফসল কাটার পরে বহন ও মারাই করা, তারপর বস্তায় সংরক্ষণ করার জন্যও অনেক শ্রমিকের দরকার। এটুকু ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিনের কাজ। তার জন্য মজুরি গুনতে হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু, এ কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই কম লাগে।

বৈশাখে বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়-তুফান শুরু হলে পাকা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে তারা যে পদ্ধতিতে ধান কাটা সহজ এবং দ্রুত হয় সেই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। ধান কাটতে এ বছর হাওর অঞ্চলে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। এই সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ৪১৩টি ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করছেন। 

জেলা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ উদ্দিন বলেন, ‘‘মানুষের পেশা পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু, কৃষি এমন একটা পেশা, যারা এ পেশা রপ্ত করেছেন তাদের জন্য নতুন পেশায় আসা খুব কঠিন। বর্তমানে কৃষিকাজে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে কৃষিশ্রমিকেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’’

‘‘শুধু কৃষিতেই নয়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে,’’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারকেই সুদৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান, মাঠে যদি কৃষক ও শ্রমিক ন্যায্য শ্রমমূল্য না পান, তাহলে কৃষিও একদিন হুমকির মুখে পড়বে।’’

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ