কমছে আলুর উৎপাদন, লোকসানে কৃষকেরা
Published: 20th, October 2025 GMT
কয়েক বছর ধরে আলু চাষ করে মুনাফা করতে পারছেন না কৃষক মো. উসমান গণী। কখনো লোকসান গুনতে হচ্ছে, কখনো খরচটাই শুধু উঠছে। তাই আগামী নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া মৌসুমে তিনি আগের চেয়ে কম জমিতে আলু চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
চন্দনাইশ উপজেলার বাসিন্দা উসমান গণী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দেড় কানি জমি রয়েছে। গত বছর প্রায় ৩০ শতক জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। প্রতি শতকে গড়ে তিন মণ করে আলু পেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্রি করে মুনাফা হয়নি। তিনি বলেন, ‘এবার ৫ থেকে ৬ গন্ডা জমিতে আলু করব। গতবার রোগবালাই আর পোকার আক্রমণে অনেক আলুই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।’
শুধু উসমান গণী নন, তাঁর মতো চট্টগ্রাম জেলার শতাধিক কৃষক কয়েক বছর ধরে আলু চাষ করে লাভের মুখ দেখেননি। ফলে তাঁরা ধীরে ধীরে আলু চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন—এমন তথ্য মিলেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে।
সর্বশেষ মৌসুমে দেশে আলুর উৎপাদন চাহিদার তুলনায় প্রায় ৪০ লাখ টন বেশি হয়েছিল। ফলে দাম পড়ে যায়। মাঠপর্যায়ে কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য পাননি। তাই অনেকেই এখন আর আগ্রহী নন। এ কারণে এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও বাড়ানো হয়নি।মো.ওমর ফারুক, অতিরিক্ত উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামে সাধারণত ডায়মন্ড, কার্ডিনাল, দোহাজারীর স্থানীয় জাতসহ কয়েক জাতের আলুর চাষ হয়। ডায়মন্ড বা বারি-৭ ও কার্ডিনাল বা বারি-৮ জাতের আলুর উৎপত্তিস্থল নেদারল্যান্ডস। ‘দোহাজারী’ চট্টগ্রামের স্থানীয় জাত। বহু বছর আগে দোহাজারীতে এ আলুর চাষ শুরু করেছিলেন কৃষকেরা। সাধারণত নভেম্বরের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে এসব জাতের বীজ রোপণ করা হয়। আর ফলন ওঠাতে হয় ৯০ থেকে ৯৫ দিনের মধ্যে।
কেন লোকসানে কৃষকচট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘সর্বশেষ মৌসুমে দেশে আলুর উৎপাদন চাহিদার তুলনায় প্রায় ৪০ লাখ টন বেশি হয়েছিল। ফলে দাম পড়ে যায়। মাঠপর্যায়ে কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য পাননি। তাই অনেকেই এখন আর আগ্রহী নন। এ কারণে এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও বাড়ানো হয়নি।’
আলু মাটির নিচে জন্মায়, তাই একে বলা হয় ‘মাটির নিচের ফসল’। কিন্তু নানা রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণে অনেক আলু মাঠেই নষ্ট হয়। আলুর রোগ হয় গাছের পাতা, কাণ্ড, চারার অঙ্কুর ও মাটির নিচের কন্দে।
চট্টগ্রামের কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সবচেয়ে ক্ষতিকর রোগ হলো লেট ব্লাইট। এ রোগে পাতা কালচে হয়ে যায়, পরে গাছ শুকিয়ে যায়। আর্লি ব্লাইটে পাতায় বাদামি দাগ পড়ে। লিফ কার্ল ভাইরাসে পাতা কুঁকড়ে যায়, গাছ খর্বাকৃতি হয়ে পড়ে। ফলে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এ ছাড়া কাটুই পোকা আলু কেটে নষ্ট করে। স্থানীয় জাতের আলুতে এসব রোগবালাই তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, জেলায় মোট আবাদযোগ্য জমি ২ লাখ ২৮ হাজার ২৯০ হেক্টর এবং কৃষক পরিবারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ। এর মধ্যে দেড় লাখ পরিবার ভূমিহীন। কৃষকেরা তিন মৌসুমে ফসল চাষ করেন-রবি, খরিফ-১ ও খরিফ-২।‘ফলন কমে যাচ্ছে, আলু পচে যাচ্ছে’চন্দনাইশ উপজেলার হাজিরপাড়া গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ মুছা জানান, তাঁর গ্রামে এখন আর দেশি লাল আলুর চাষ তেমন হয় না। একসময় দেশি লাল আলুতে ভরা থাকত মাঠ। এক গন্ডা জমিতে ছয়-সাত মণ আলু পাওয়া যেত। ২০১৪ সালের দিকে হঠাৎ দেখা গেল, পাতাগুলো কুঁকড়ে যাচ্ছে, গাছ বড় হচ্ছে না। ফলনে ধস নামে। তার পর থেকে দেশি আলুর চাষ ক্রমাগত কমতে থাকে।
স্থানীয় কৃষকেরা জানান, ভাইরাসের কারণে দেশি আলুর গাছ দুর্বল হয়ে যায়, কন্দ ছোট হয়। আলুর আকার ছোট হলে বাজারে দাম পাওয়া যায় না। তাই অনেকেই দেশি জাত বাদ দিয়ে বিদেশি বা উন্নত জাতের দিকে ঝুঁকছেন। চন্দনাইশের কৃষক আবু মুছা বলেন, ‘সব মিলিয়ে এক কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়ে ২০ থেকে ২২ টাকা। কিন্তু গত মৌসুমে ওই দামে বিক্রি করতেও পারিনি। তাই এবার আর আলু চাষ করব না।’
চট্টগ্রামে আলু একসময় ছিল লাভজনক ফসল। এখন সেটি কৃষকের কাছে হয়ে উঠছে অনিশ্চয়তার প্রতীক। ফলন কমছে, খরচ বাড়ছে, দাম পড়ছে। কৃষকেরা ধীরে ধীরে মাঠ থেকে সরে যাচ্ছেন। ফলে মাটির নিচের এই সোনালি ফসল যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা প্রণব নাথ আলু চাষে হিমশিম খাচ্ছেন। মোটাদাগে তিনটি কারণ তিনি জানিয়েছেন। এগুলো হলো ফলন কমে যাওয়া, আলু পচে যাওয়া, দাম কম পাওয়া। প্রণব নাথ প্রথম আলোকে বলেন, গত মৌসুমে ২০ শতক জমিতে আলুর চাষ করেছিলেন। খরচ হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু সব টাকা উঠে আসেনি। ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।
উৎপাদন কমেছে ২৮ শতাংশকৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, পাঁচ বছর ধরে চট্টগ্রামে আলুর আবাদ ও উৎপাদন দুই-ই কমছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৪১ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ৬৪ হাজার ৬৮৫ টন। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ৩ হাজার ৬৮৩ হেক্টরে, উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৪৯৯ টনে; অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে জমি কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ ও উৎপাদন কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, জেলায় মোট আবাদযোগ্য জমি ২ লাখ ২৮ হাজার ২৯০ হেক্টর এবং কৃষক পরিবারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ। এর মধ্যে দেড় লাখ পরিবার ভূমিহীন। কৃষকেরা তিন মৌসুমে ফসল চাষ করেন—রবি, খরিফ-১ ও খরিফ-২।
রবি মৌসুম (১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ) হচ্ছে আলু চাষের সময়। এ মৌসুমে বোরো ধান, শীতকালীন সবজি, ভুট্টা, গম, তেল ও ডালজাতীয় ফসলের পাশাপাশি নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে কৃষকেরা আলুর বীজ মাটিতে রোপণ করেন।
অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘একই জাতের বীজ বারবার ব্যবহার করার কারণে ফলন কমে যাচ্ছে। রোগবালাইয়ে নষ্ট হচ্ছে আলু। চট্টগ্রামের কৃষকেরা অপরিপক্ব বীজ ব্যবহার করেন। আমরা পরামর্শ দিই—এক বছর বিরতি দিয়ে চাষ করতে এবং সার-বীজ ব্যবস্থাপনায় বৈচিত্র্য আনতে। কিন্তু অনেকেই পরামর্শ না মেনে উৎপাদন করে লোকসান গুনছেন।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আল র চ ষ হয় ছ ল চ ষ কর অন ক ই পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
চীনের সামরিক বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান, ৯ জেনারেলকে বরখাস্ত
চীনের সামরিক বাহিনীতে শুরু হয়েছে বিরল শুদ্ধি অভিযান। দেশটির কমিউনিস্ট পার্টি একযোগে বরখাস্ত করেছে নয়জন শীর্ষ জেনারেলকে, যাদের মধ্যে রয়েছেন সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় শীর্ষ কর্মকর্তা। এটিই দেশটিতে কয়েক দশকের মধ্যে সামরিক বাহিনীর মধ্যে অন্যতম বড় অভিযান।
চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মারাত্মক আর্থিক অপরাধের অভিযোগে এই নয় জেনারেল সন্দেহভাজনের তালিকায় রয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই তিন তারকা জেনারেল এবং পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগ্রহণকারী সংস্থা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। খবর বিবিসি বাংলার।
আরো পড়ুন:
চীনের ওপর অতিরিক্ত ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের
দাঁতে ট্যাটু করছেন চীনের তরুণ-তরুণীরা
এই বরখাস্ত দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের অংশ হলেও বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, এটি রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণেরও একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে।
যে নয় জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে, তারা হলেন— সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের (সিএমসি) ভাইস চেয়ারম্যান হি ওয়েইডং, সিএমসির রাজনৈতিক বিভাগের পরিচালক মিয়াও হুয়া, একই বিভাগের নির্বাহী উপপরিচালক হে হংজুন, জয়েন্ট অপারেশন কমান্ড সেন্টারের নির্বাহী উপপরিচালক ওয়াং জিউবিন, ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডার লিন জিয়াংইয়াং, সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক কমিশনার কিন শুতং, নৌবাহিনীর রাজনৈতিক কমিশনার ইয়ুআন হুয়াজি, রকেট ফোর্সেস কমান্ডার ওয়াং হৌবিন এবং আর্মড পুলিশ ফোর্স কমান্ডার ওয়াং চুনিং।
এই তালিকার মধ্যে হি ওয়েইডং চীনা সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সবচেয়ে আলোচিত। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পর তিনিই সিএমসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। গত মার্চে সর্বশেষ প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল তাকে। এরপর থেকে জনসম্মুখে অনুপস্থিতির কারণে জল্পনা ছিল যে, তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ ফোরাম পলিটব্যুরোতেও সদস্য ছিলেন এবং পলিটব্যুরোর প্রথম সদস্য হিসেবে এ ধরনের অভিযানে তদন্তের মুখে পড়লেন।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, বরখাস্ত হওয়া ব্যক্তিরা দলের শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ভঙ্গ করেছেন এবং দায়িত্বসংশ্লিষ্ট গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার সন্দেহ রয়েছে। তারা বর্তমানে সামরিক আদালতের বিচারের মুখোমুখি এবং এই অভিযানকে দল ও সামরিক বাহিনীর দুর্নীতি বিরোধী প্রচেষ্টার একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের ফেলো নেইর থমাস বিবিসি চাইনিজকে বলেন, শি জিনপিংয়ের এই শুদ্ধিকরণ অভিযান মূলত ক্ষমতা সংহত করার কৌশল। তার মতে, শি দুর্নীতিপরায়ণ ও অবিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের অপসারণের মাধ্যমে পার্টিকে আরও সুশৃঙ্খল, কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় টিকে থাকার উপযোগী করতে চাইছেন।
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, এই শুদ্ধিকরণ শাসনব্যবস্থাকে আরো কঠোর করে তুলতে পারে। এখন দৃষ্টি থাকবে ২০ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া পার্টির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে কারা অংশ নিচ্ছেন তার দিকে।
ঢাকা/ইভা