জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সংস্কারের আলোচনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অবস্থানে অনেকটাই সাদৃশ্য দেখা গেছে। কিন্তু জুলাই সনদে জামায়াতের স্বাক্ষর করা এবং এনসিপির স্বাক্ষর না করার পর সেই চিত্র হঠাৎ বদলে গেছে।

জামায়াতের বিরুদ্ধে নাহিদের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। গত এক বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দলের মধ্যে ‘সুসম্পর্ক’ দেখা গেলেও এখন এনসিপি কেন জামায়াতের সমালোচনা করছে, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করা না করার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।

এনসিপির অবস্থান হচ্ছে, আইনি ভিত্তি নিশ্চিত হওয়ার আগে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না দলটি। বিষয়টি নিয়ে জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে এর আগে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও করেছে তারা। এনসিপি নেতাদের চাওয়া ছিল, জামায়াতসহ আরও কিছু দল সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে না যাক।

অবশ্য এনসিপিকে জুলাই সনদ স্বাক্ষরে রাজি করাতে সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের দিক থেকে নানা চেষ্টা ছিল। সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগের রাতেই (১৬ অক্টোবর) এনসিপি জানিয়ে দেয়, তারা জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করছে না।
জামায়াত ও এনসিপির একাধিক সূত্র জানায়, সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের দিনও (১৭ অক্টোবর) জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে ফোন করে অনুষ্ঠানে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু সেই অনুরোধ রাখা হয়নি।

১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর হয়। বিএনপি, জামায়াতসহ ২৪টি দল সেদিন সনদে সই করে। আমন্ত্রিত হয়েও এনসিপি অনুষ্ঠানে যায়নি। এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের ‘দূরত্বকে’ এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেকে দেখছেন।

নাহিদের ফেসবুক পোস্টে কী আছে

জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে শুরু হওয়া ‘পিআর’ আন্দোলন একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গতকাল রোববার বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া এক পোস্টে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
ফেসবুক পোস্টে নাহিদ লিখেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের আলোকে সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রকৃত প্রশ্ন থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কারপ্রক্রিয়া এবং জাতীয় সংলাপকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতির বিষয়টি সামনে আনা হয়েছিল।

জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে ভোট করার যে আন্দোলন জামায়াত এখন করছে, সেটিকে ‘কথিত’ আন্দোলন বলেও উল্লেখ করেন এনসিপির শীর্ষ এই নেতা। তিনি লিখেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ও পরে কখনোই সংস্কার আলোচনায় যুক্ত হয়নি জামায়াত। তারা কোনো কার্যকর প্রস্তাব দেয়নি, কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেনি এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো অঙ্গীকারও দেখায়নি।
নাহিদ লিখেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধীন সংস্কারের বিষয়ে দলটি (জামায়াত) আকস্মিক যে অনুমোদন দিয়েছে, সেটা সংস্কার আকাঙ্ক্ষার ফল নয়; বরং একটি কৌশলগত অনুপ্রবেশ। সংস্কারবাদের ছদ্মবেশে এটি একটি রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত।

জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করে দেওয়া ফেসবুক পোস্টটি নাহিদ লিখেছেন ইংরেজি ভাষায়। দলটি সম্পর্কে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমরা মৌলিক সংস্কার এবং বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো তৈরি করার জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জামায়াত ও তার সহযোগীরা এটা ছিনতাই করেছে। তারা একে একটি কাঠামোগত পিআর বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে এবং এটাকে তাদের ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দর-কষাকষির একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।’

‘বিশ্বাসভঙ্গের বোধ’

এনসিপির শীর্ষ নেতাদের কেউ এর আগে প্রকাশ্যে জামায়াতের তীব্র সমালোচনা করেননি। জামায়াত নিয়ে হঠাৎ নাহিদের এমন পোস্টের কারণ কী, তা জানতে এনসিপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের পাঁচজন নেতার সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, সংস্কার প্রশ্নে জামায়াতকে ‘গুড ফেইথে’ (বিশ্বাসের সঙ্গে) গ্রহণ করেছিল এনসিপি। বিশেষ করে সংস্কার ও বিচারের প্রশ্নে দুই দলের মধ্যে একধরনের ঐকমত্য ছিল।

কিন্তু জামায়াতের দিক থেকে এনসিপির তৃণমূল পর্যায়ে অনুপ্রবেশ করে স্যাবোটাজ (অন্তর্ঘাত) ঘটানোর চেষ্টা আছে বলে মনে করছেন ওই নেতারা। তাঁরা বলেন, জুলাই সনদে স্বাক্ষর করাসহ জামায়াতের সাম্প্রতিক বিভিন্ন কার্যক্রমে এনসিপির মধ্যে একধরনের ‘সেন্স অব বিট্রেয়াল’ (বিশ্বাসভঙ্গের বোধ) তৈরি হয়েছে। সে কারণেই জামায়াতের ‘রাজনৈতিক দ্বিচারিতার’ বিষয়টি এখন জনসমক্ষে নিয়ে আসতে চাইছেন তাঁরা।

পিআর পদ্ধতিসহ পাঁচ দফা দাবিতে জামায়াতের নেতৃত্বে যে আন্দোলন চলছে, সেখানে এনসিপিকেও রাখার চেষ্টা ছিল। কিন্তু কিছু দাবির সঙ্গে একমত না হওয়ায় এনসিপি শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনে যুক্ত হয়নি।

এনসিপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা চাইছেন তাঁরা। এত দিন জেনে এসেছেন, বিএনপি এ ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছে। কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁরা জানতে পেরেছেন, এনসিপি যাতে শাপলা প্রতীক না পায়, সে ক্ষেত্রে জামায়াতও বাধা সৃষ্টি করছে। জামায়াতের কড়া সমালোচনা করে নাহিদ ইসলামের ফেসবুক পোস্টের পেছনে এটিও কাজ করে থাকতে পারে। এর পাশাপাশি এখানে এনসিপির স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চরিত্র নির্মাণের বিষয়টিও রয়েছে।

জামায়াতের সমালোচনা করে দেওয়া ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে বক্তব্য জানতে নাহিদ ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। একাধিকবার ফোন করা হলেও সাড়া দেননি তিনি।

নাহিদের পোস্ট এবং জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বড় দলগুলো তাদের দ্বিচারিতার পুরোনো কৌশলকে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখাতে চায়। এই চতুরতা যে ভালো কিছু নয়, সেটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন তাঁরা।

জামায়াত কী বলছে

নাহিদ ইসলামের ফেসবুক পোস্ট ‘অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর’ বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গতকাল রোববার রাতে আনুষ্ঠানিক এক বিবৃতিতে দলটি বলেছে, নাহিদ ইসলামের কাছ থেকে বালখিল্য বক্তব্য জাতি আশা করে না।

জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে দলের কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের গণমাধ্যমে এই বিবৃতি পাঠিয়েছেন। এতে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক স্ট্যাটাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম দাবি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির সমালোচনা করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। জামায়াতে ইসলামীর পিআর দাবির আন্দোলনকে প্রতারণামূলক ও রাজনৈতিক কৌশল বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা সর্বৈব মিথ্যা ও দুঃখজনক।

আরও পড়ুনপিআর নিয়ে আন্দোলন জামায়াতের ‘রাজনৈতিক প্রতারণা’: নাহিদ১৪ ঘণ্টা আগে

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে থাকা এহসানুল মাহবুব ওই বিবৃতিতে বলেন, ‘তিনি (নাহিদ ইসলাম) তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে কী বোঝাতে চাচ্ছেন, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তাঁর কাছে এই ধরনের বালখিল্য বক্তব্য জাতি আশা করে না।’

বিবৃতিতে বলা হয়, জুলাই জাতীয় সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবিতে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এবং রাজপথে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিজেদের দৃঢ় অবস্থান জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। কাজেই নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের যৌক্তিক কোনো ভিত্তি নেই।

নাহিদ ইসলামকে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াত নেতা এহসানুল মাহবুব।

আরও পড়ুননাহিদ ইসলামের কাছ থেকে এ ধরনের বালখিল্য বক্তব্য জাতি আশা করে না : জামায়াতে ইসলামী১২ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ ল ই জ ত য় সনদ র ফ সব ক প স ট ন হ দ ইসল ম র জ ল ই সনদ র জন ত ক অন ষ ঠ ন এনস প র গতক ল ব ষয়ট

এছাড়াও পড়ুন:

ফাঁকা বুলির রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন আসছে কেন

সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দটি সম্ভবত ‘সংস্কার’। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শুরু হয় সংস্কার নিয়ে আলোচনা ও তৎপরতা। গঠিত হয় অনেকগুলো কমিশন, টাস্কফোর্স ও কমিটি। এসব কমিশন, টাস্কফোর্স ও কমিটি থেকে শত শত সুপারিশ ও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১৫ মাসের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে, মৌলিক আর্থসামাজিক বিষয়ের সংস্কারগুলো আলোচনাতেই নেই।

রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের সহস্রাধিক সুপারিশ থেকে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হয়েছে মাত্র ১৬৬টি নিয়ে। এর মধ্যে আবার অনেক মৌলিক সংস্কার বিষয়েই রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আর যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়নেও প্রত্যাশিত অগ্রগতি নেই। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো রহস্যজনকভাবে বাদ পড়ে যাচ্ছে বা বদলে দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ পুলিশ ও দুদক সংস্কারের কথা বলা যেতে পারে।

আরও পড়ুনগণ–অভ্যুত্থানের পরও কেন আমলাতন্ত্রের সংস্কার হলো না০৩ নভেম্বর ২০২৫

পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত রেখে পেশাদারির সঙ্গে পরিচালনার জন্য অনেক দিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে স্বাধীন পুলিশ
কমিশন গঠনের বিষয়টি। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু যেভাবে তা গঠিত হচ্ছে, তাতে এই কমিশন বর্তমান দুদকের মতোই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও আমলাতন্ত্রের বশীভূত নখদন্তহীন একটি প্রতিষ্ঠান হবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

পুলিশের মূল সমস্যা হলো অবৈধ আদেশ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার। এ প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও পদায়ন ঘিরে। যদি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের মাধ্যমে এ কাজগুলো করা যায়, তাহলে পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব কমে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ কমিশন গঠনের জন্য যে অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছে, সেখানে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষমতা পুলিশ কমিশনকে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়নি।

অর্থাৎ এগুলো আগের মতোই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করবে। কমিশনের কাজ হবে এ–সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও সুপারিশ করা। তবে সেগুলো বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতার বিষয়ে অধ্যাদেশে কিছু নেই। এমনকি আইজিপি নিয়োগে স্বচ্ছতার জন্য কমিশনকে তিন সদস্যের একটি প্যানেল গঠনের ক্ষমতা দেওয়ার যে প্রস্তাব করেছিল আইন উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন কমিটি, সেটিও খসড়া থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ কমিশনের সদস্য বাছাইয়ের জন্য যে কমিটি করা হবে, তার সভাপতি হবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফলে বাছাই কমিটি কতটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশকে আগের মতোই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন রাখার মাধ্যমে কার্যত পুলিশ কমিশনকে ‘নখদন্তহীন’ করে রাখার তৎপরতা চলছে আমলাদের দিক থেকে। কোনো কোনো রাজনৈতিক মহলও তা–ই চাইছে। (পুলিশ কমিশনের খসড়ায় আমলাতন্ত্রের ‘হস্তক্ষেপ’, প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর ২০২৫)

পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও আমলাতন্ত্রের বাধার বিষয়টি উঠে এসেছিল। সেখানে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পক্ষ থেকে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করা হয়েছে।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে পাঠানো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত থেকে দেখা যায়, সেখানে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন করলে নিয়ন্ত্রণকারী কোনো কর্তৃপক্ষ থাকবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা এবং পুলিশ বাহিনীকে যৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যাবে না। সুতরাং স্বাধীন পুলিশ কমিশন করার প্রস্তাবের সঙ্গে জননিরাপত্তা বিভাগ যৌক্তিক কারণে দ্বিমত পোষণ করছে।’ (পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, সংলগ্নী-৯) সম্ভবত এ দ্বিমতের প্রতিফলনই ঘটেছে পুলিশ কমিশনবিষয়ক খসড়া অধ্যাদেশে।

পরিস্থিতি এ রকম যে একদিকে বহু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, অন্যদিকে যেসব সংস্কার বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলোর অনেকগুলো দায়সারাভাবে করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

যেনতেনভাবে কোনো কমিশন গঠন করলেই যে উদ্দেশ্য সফল হয় না, তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একসময় দেশে দুর্নীতি দমনের জন্য বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে কাজ করত দুর্নীতি দমন ব্যুরো। এই ব্যুরো নির্বাহী বিভাগের অধীন থাকায় এর স্বাধীনতা, কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে ছিল ব্যাপক সংশয় ও জন-অসন্তোষ।

এ রকম একটি পটভূমিতেই দুর্নীতি দমন আইন ২০০৪–এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের অধীন ব্যুরোর পরিবর্তে স্বাধীন কমিশন হিসেবে দুদক গঠন করা হয়। আইন অনুসারে দুদক একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হলেও বাস্তবে তা গঠিত হওয়ার পরের দুই দশক স্রেফ ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে। এর অন্যতম কারণ হলো বর্তমানে বাছাই কমিটির মাধ্যমে যেভাবে দুদকের কমিশনার নিয়োগ করা হয়, তাতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সুস্পষ্ট প্রভাব থাকে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত দুদক সংস্কার কমিশন এ সমস্যার সমাধানে কমিশনার নিয়োগে বিদ্যমান ‘বাছাই কমিটি’র বদলে একটি ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের সুপারিশ করেছিল, যেখানে সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি বিরোধী দল ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে অভিজ্ঞ নিরপেক্ষ ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছিল। এই কমিটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করে স্বচ্ছতার সঙ্গে নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ কমিশনার বাছাই করবে। সেই সঙ্গে দুদকের কাজের ষাণ্মাসিক পর্যালোচনা, গণশুনানি আয়োজন ও পরামর্শ প্রদান করবে।

আরও পড়ুনরাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে সংস্কার ছাড়া দুর্নীতি দমন অসম্ভব০৮ ডিসেম্বর ২০২৪

এ বিষয়ে জুলাই সনদে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) অভিযোগ করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুপারিশ বাদ দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন অধ্যাদেশ চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে।

জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্মতির পরও চূড়ান্ত অধ্যাদেশে এ সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারের অনাগ্রহের ইঙ্গিত বলে উল্লেখ করেছে টিআইবি। বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি ছাড়াও চূড়ান্ত অধ্যাদেশে আরও কিছু ঐকমত্য অর্জিত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুপারিশ বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে টিআইবি, যা সরকারের অভ্যন্তরে স্বার্থান্বেষী ও প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতি-সহায়ক ও সংস্কার পরিপন্থী অবস্থান ছাড়া আর কিছু হতে পারে না বলে মনে করে টিআইবি। (রাষ্ট্র সংস্কার কি সরকারের কাছে শুধুই ফাঁকা বুলি, প্রশ্ন টিআইবির, প্রথম আলো, ২৮ নভেম্বর ২০২৫)

এভাবে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির ক্ষমতা ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন বাছাই কমিটির সুপারিশে গঠিত পুলিশ কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে না। একইভাবে বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি–সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়িত না হলে দুদকে আগের মতোই ক্ষমতাসীনদের কথায় চলবে। অন্যদিকে পুলিশ ও দুদক সংস্কার হয়ে গেছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলে দেওয়া হবে। এভাবে চালাকি করে ওপরে ওপরে সংস্কার করে বাহবা নেওয়া গেলেও তা গণতান্ত্রিক রূপান্তরে কোনো ভূমিকা রাখবে না।

পরিস্থিতি এ রকম যে একদিকে বহু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, অন্যদিকে যেসব সংস্কার বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলোর অনেকগুলো দায়সারাভাবে করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

শুধু সংখ্যা নয়, সংস্কারের গুণগত মান নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। সুপারিশে ঠিক কী ছিল আর বাস্তবায়ন ঠিক কতটুকু হয়েছে, সেটিও পরিষ্কার করতে হবে। এ জন্য সরকারকে সব কমিশন, টাস্কফোর্স ও কমিটিগুলোর দেওয়া সব সুপারিশের তালিকার পাশে কোনটা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, একটা কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইটে তার বিস্তারিত প্রকাশ করতে হবে।

কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

ই–মেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফাঁকা বুলির রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন আসছে কেন