‘কিংস পার্টি’ গঠনের তাত্ত্বিক বাস্তবতা
Published: 11th, March 2025 GMT
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠিত হয়েছে। বিতর্ক উঠেছে, এ কি আরেকটি ‘কিংস পার্টি’? কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে কিংস পার্টি গঠনের বাস্তবতাই নেই। কিন্তু কিংস পার্টি গঠনের অন্তত তাত্ত্বিক বাস্তবতা এ দেশে রয়েছে।
আমরা জানি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ক্ষমতার কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে একটি ছোট কিন্তু প্রভাবশালী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার পক্ষে কাজ করে, যা তাদের কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা ও নির্ভরতা প্রদান করে। এই ক্ষুদ্র অভিজাত গোষ্ঠীর প্রভাবের ফলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো অধিকাংশ সময় কয়েকজনের স্বার্থানুযায়ীই নির্ধারিত হয়।
বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রও দীর্ঘকাল ধরে দেশের শাসনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে আসছে। তারা ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণকে কেবল পছন্দ হিসেবে নয়, বরং একটি কৌশলগত প্রয়োজন হিসেবে দেখে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রীয় স্তরায়িত কাঠামো সরকারি আদেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দরকারি স্থিতিশীলতা প্রদান করে। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত পরিবেশে এমন স্থিতিশীলতা বাধার মুখে পড়ে।
গণঅভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতা রাজনৈতিক অর্থনীতির অভিজাত গোষ্ঠী এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র উভয় পক্ষের জন্য অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিই কিংস পার্টি গঠনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে কিংস পার্টি সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা নিরসনের উপায় হিসেবে গণ্য হয়। রাজনৈতিক বিভাজনের ঝুঁকি এড়িয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র প্রায়ই এমন পদক্ষেপ অবলম্বন করে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারে, এমন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দরকষাকষির দ্বারও এতে উন্মুক্ত হয়।
তৃতীয় বিশ্বের বাংলাদেশে যেখানে সামাজিক মর্যাদা ‘ক্ষমতা’ দিয়ে নির্ধারিত হয়; সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রসৃষ্ট কিংস পার্টির বাস্তবতা সেখানে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সামরিক সরকারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতা দখল না করেও সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক, জনবিচ্ছিন্ন বা জনসমর্থনপুষ্ট গোষ্ঠীগুলোর সমন্বয়ে কিংস পার্টি গঠন করতে পারে। এ প্রসঙ্গে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ে কিংস পার্টি গঠন চেষ্টার কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান কেবল বিদ্যমান স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেনি; দেশের গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক বিভাজনগুলো আরও স্পষ্ট করেছে। এই গভীর বিভাজনের ফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলো মোকাবিলায় বিভিন্ন গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ কিংস পার্টির ধারণা গ্রহণ করতে পারে। এই ধারণা ক্ষমতা দখলের সুযোগ-সন্ধানী উপায় হিসেবে নয়, বরং বিরোধী স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংহতি স্থাপনের প্রয়োজনীয় শক্তি হিসেবে মূল্যায়িত হয়। যদি এই দলটি মাঠ পর্যায়ে সুসংহত নেতৃত্ব ও নীতি নির্দেশনা প্রদান করতে পারে, তবে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে উত্থান ঘটতে পারে। বিশৃঙ্খলা মোকাবিলায় সক্ষমতাও অর্জন করতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে যদি সামরিক অভ্যুত্থান বা গণঅভ্যুত্থানের পর কোনো একটি দলকে মাঠ পর্যায়ে সুসংহত নেতৃত্ব এবং নীতি নির্দেশনা প্রদান করে জনপ্রিয়তা লাভের বিশেষ সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে তাকে কিংস পার্টি বলা ছাড়া অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিংস পার্টির প্রতিশ্রুত স্থিতিশীলতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কারণ এ ধরনের স্থিতিশীলতা বিনিয়োগের জন্য একটি পূর্বাভাসযোগ্য ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান গুরুত্ববহ। কারণ এ অঞ্চল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং সাহায্যের ক্ষেত্রে ‘স্ট্র্যাটেজিক হাব’ হিসেবে কাজ করে। ফলে দেশের শাসন কার্যক্রমে স্থিতিশীলতার স্বার্থে এবং এই আন্তর্জাতিক অবস্থানের মর্যাদা বজায় রাখতে রাজনৈতিক অভিমুখগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারী ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রভাব অনুভব করে এবং তাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি সাহায্যপুষ্ট কিংস পার্টির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, যা শাসন কার্যক্রমে স্থিতিশীলতার অঙ্গীকার করে এবং বিশৃঙ্খলা ও অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলায় বিদেশি স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়।
দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অর্থনৈতিক অস্থিরতার সম্ভাবনা বিনিয়োগের পরিবেশকে প্রভাবিত করে। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক মহল স্থিতিশীলতা ও নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে সক্ষম এমন কেন্দ্রীভূত শাসন মডেলের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়। কিংস পার্টি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করতে পারলে তা শুধু ব্যবসায়িক অভিজাতদের কাছ থেকেই নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছ থেকেও ব্যাপক সমর্থন লাভ করতে পারে। এই শ্রেণিগুলো সাধারণত অর্থনৈতিক অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারে, এমন স্থিতিশীল সরকারের দিকে ঝোঁকে।
সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত কর্তৃপক্ষের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, যা তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণে প্রভাব ফেলে। এ ধরনের প্রবণতা তাদের ক্ষমতাসীন শ্রেণির প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের ফলে গড়ে ওঠে, যারা জাতীয় শক্তি এবং সংকট মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ফলে যে কোনো দল যদি স্থিতিশীল শাসন এবং সংকট মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা দেখাতে পারে, তার প্রতি জনসাধারণের সমর্থন অর্জন সহজ হয়। কিংস পার্টি এ ধরনের একটি দল হিসেবে উঠে আসতে পারে, যা তাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আশাবাদের প্রতিফলন ঘটায়।
শেষ পর্যন্ত যদিও বিকেন্দ্রীকৃত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ধারণা অনেকের মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়, মাটির ওপরের বাস্তবতা দেশকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতে পারে। কিংস পার্টির সম্ভাব্য উত্থানের পেছনের ধারণাগত ও বাস্তবিক কারণগুলো স্বীকার করা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য আরও নির্ভুল বোঝাপড়া ও যুক্তিসংগত আচরণের কৌশল প্রদান করে। এই বোঝাপড়া বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গঠনে জড়িত সব পক্ষের জন্য অপরিহার্য, যাতে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাগুলো জটিল ও বৈচিত্র্যময় জাতি শাসনের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
ড.
huda@du.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন পর স থ ত ত র ব স তবত র জন ত ক র জন য পর ব শ গঠন র ন করত সরক র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
রাইজিংবিডিতে সংবাদ প্রকাশ: ডেরা রিসোর্টের লাইসেন্স বাতিল
মানিকগঞ্জের ঘিওরের বালিয়াখোড়ায় অবস্থিত ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের নানা অনিয়ম নিয়ে রাইজিংবিডিতে ‘কবরস্থানে হরিণের খামারসহ নানা অনিয়মের আখড়া ডেরা রিসোর্ট’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স বাতিল করেছে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে ডেরা রিসোর্টে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সহকারী নিয়ন্ত্রক (সিনিয়র সহকারী সচিব) শেখ রাশেদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনা পত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টার ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর লাইসেন্স প্রাপ্তির আবেদন করেন। নানা অনিয়মের কারণে তাদের লাইসেন্স নামঞ্জুর করা হয়েছে। রিসোর্টের লাইসেন্স না থাকায় প্রশাসনকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি ‘ফসলি জমি দখল করে ডেরা রিসোর্ট নির্মাণ, বিপাকে কৃষক’; ১৯ মার্চ ‘ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে ডেরা রিসোর্ট, তদন্ত কমিটি গঠন’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে রাইজিংবিডি। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ‘কবরস্থানে হরিণের খামারসহ নানা অনিয়মের আখড়া ডেরা রিসোর্ট’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ডেরার লাইসেন্স নামঞ্জুর করে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক মানিকগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, “অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডিতে ডেরা রিসোর্ট নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও ভোগান্তি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদক অনুসন্ধান করে ডেরা রিসোর্টের নানা অনিয়ম তুলে এনেছেন। প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রশাসন লাইসেন্স বাতিল করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে এটি ভালো উদ্যোগ। তবে এসব নির্দেশনা কাগজে কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়ন করাটাই বড় কাজ। নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে সুশাসন নিশ্চিত হবে।”
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কপি পেয়েছি। সে অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক বলেন, “লাইসেন্সের বিষয়ে কোন নোটিশ এখনও পাইনি আমরা। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিষয়েও জানা নেই। যদি লাইসেন্স বাতিল করে থাকে, তাহলে আমরা আইনিভাবে বিষয়টি সমাধান করব।”
এ বিষয়ে জানতে বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকালে এশিউর গ্রুপের অঙ্গসংগঠন ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ সাদীর মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
ঢাকা/চন্দন/এস