কথা বড় বিচিত্র জিনিস। একই কথা—সকালে যার ওজন পাঁচ মণ, বিকেলে তার ওজন পাঁচ ছটাক না–ও থাকতে পারে। যে কথার দাম খাটের তলায় এক শ টাকা, আগরতলায় সে কথার দাম দশ পয়সা না–ও থাকতে পারে। যে কথা হাবলা হাবার মা–বাবা বললে কেউ গা করবে না; সেই একই কথা ওবামার মা–বাবা বললে তামাম দুনিয়ায় নিউজ হয়ে যাবে।
স্থান–কাল–পাত্রভেদে একই কথার ওজন যে একেক রকম, তা আমেরিকার গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের সামান্য কথা অসামান্যভাবে আবার প্রমাণ করল।
আদতে তুলসী গ্যাবার্ড খুব নতুন কিছু বলেননি। কিন্তু তাঁর কথা নিয়ে ভারতের মিডিয়ায় বিরাট চাঞ্চল্য হয়েছে। বাংলাদেশে হোয়াটসঅ্যাপ–মেসেঞ্জারে লিংক চালাচালি হচ্ছে। এত উথালিপালাথির কারণ হলো স্থান–কাল–পাত্র—তিনটি অনুষঙ্গই এত লাগসই ভূমিকা রেখেছে যে তুলসীর সাধারণ কথাগুলো বিরাট হয়ে উঠেছে।
গত সোমবার (১৭ মার্চ) এনডিটিভিকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় সঞ্চালক বিষ্ণু সোম তুলসীকে বলেছিলেন, ‘ভারতের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে আমরা অনেক পটপরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্র কি সেখানকার পরিস্থিতিকে আমলে নিচ্ছে এবং রাজনীতির বাইরেও সব পর্যায়ে স্থিতিশীলতা রাখতে তৎপর আছে?’
এর জবাবে তুলসী বলেছেন, ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অনেক দিন ধরে নিপীড়ন, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আসছে এবং এটি আমেরিকান সরকার এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে।’ তিনি বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদ দমন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সে লক্ষ্যেই তারা কাজ করছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন নতুন ক্যাবিনেট ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।’
তুলসীর এই কথাগুলো সরকারি কর্মকর্তা বা কূটনীতিকদের ব্যবহার্য ফরম্যাট করা কথা। এখানে দৃশ্যত উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছু নেই। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে এই কথা আমরা বহু শুনেছি। এগুলো আমাদের কাছে জলভাত ছিল। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের হুমকি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বৈশ্বিক তৎপরতা একই মতাদর্শ ও উদ্দেশ্যকে অনুসরণ করে—এটি মূলত একটি ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।’ মূলত তিনি এই ‘ইসলামি খেলাফত’ টার্মটি বাংলাদেশ ইস্যুতে ব্যবহার করায় আবহ গরম হয়েছে।
তুলসীর জায়গায় আজ যদি একজন শ্বেতাঙ্গ ক্যাথলিক আমেরিকান থাকতেন এবং তিনি ঠিক এই কথাগুলোই বলতেন, তাহলে সেই কথাগুলোও হয়তো চাঞ্চল্য তৈরি করত, কিন্তু তার প্রভাবের ধরন হতো অন্য রকম। সেই কথাগুলো ইউনূস সরকারবিরোধীদের জন্য সম্ভবত এতটা ‘মৃতসঞ্জীবনী সুধা’ হিসেবে ধরা হতো না। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের অন্ধ অনুসারীদের হয়তো ‘শিগগিরই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে’ মার্কা স্ট্যাটাস দিয়ে ফেসবুক গরম করতে দেখা যেত না।তুলসী বলেছেন, ‘এটি স্পষ্ট, অন্য যেকোনো ধর্মের অনুসারীরা ইসলামপন্থীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, যদি না তারা সেই [চরমপন্থী] গোষ্ঠীর গ্রহণযোগ্য ধর্ম অনুসরণ করে। তারা সন্ত্রাস ও চরম সহিংসতার মাধ্যমে এ মতবাদ বাস্তবায়ন করতে চায়।.
প্রথমত, কথাগুলো যিনি বলেছেন, তিনি যে শুধু বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির গোয়েন্দাপ্রধান, তা–ই নয়; এর বাইরেও তাঁর এমন ব্যক্তি পরিচয় আছে, যা এই কথাগুলো কারও জন্য উদ্বেগ–জাগানিয়া আবার কারও জন্য ‘মৃতসঞ্জীবনী সুধা’ হিসেবে কাজ করছে।
ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে কোনো কবির কবিতা বা লেখকের গল্প, গদ্য বা নাটক পড়ানোর আগে সাহিত্যের মাস্টাররা ছাত্রছাত্রীদের আগে সেই কবি বা ঔপন্যাসিক বা নাট্যকারের জীবন সম্পর্কে ধারণা দেন। সংশ্লিষ্ট কবি বা ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিগত জীবন কেমন, তাঁর ধর্ম বা সমাজসংক্রান্ত দর্শন কী, তা সম্পর্কে আলোচনা করেন। এতে ব্যক্তি হিসেবে কবি বা লেখকের মনস্তত্ত্ব বোঝা যায়। কোন কোন বিষয়ে তাঁর পক্ষপাত আছে, তা বোঝা যায়। এসব জানা গেলে তাঁর কাব্য বা গল্প বা উপন্যাসের মর্মার্থ ধরা সহজ হয়।
আরও পড়ুনবাংলাদেশে গুতেরেস এবং আমাদের সংস্কার ১০ ঘণ্টা আগেসেই নিরিখে তুলসী গ্যাবার্ডের বাংলাদেশে ‘ইসলামি খেলাফত’ প্রতিষ্ঠাবিষয়ক উদ্বেগকে যদি বিচার করি, তাহলে তাঁর ব্যক্তি ও পেশাদারি জীবনে ঢুঁ মারা দরকার হয়ে পড়ে।
তুলসী গ্যাবার্ড ফৌজি মানুষ। মার্কিন সেনা হিসেবে তিনি ইরাক ও কুয়েত যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদায় এসেছেন। চাকরি শেষে ডেমোক্রেটিক দলের রাজনীতি করলেও পরে রিপাবলিকান দলে ভেড়েন।
তুলসীর বাবা মাইক গ্যাবার্ড একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ছিলেন। তাঁর মা ক্যারল গ্যাবার্ড প্রথমে খ্রিষ্টান ছিলেন, পরে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁদের পরিবার মূলত ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) বা ‘হরে কৃষ্ণ’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। মূলত এ সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা কৃষ্ণভক্তিতে আকৃষ্ট হন। ভক্তি, জয়, আরিয়ান ও বৃন্দাবন নামে তুলসীর আরও চার ভাইবোন আছে।
তুলসী গ্যাবার্ড যদিও নিজেকে ইসকনের সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন না, তবে তিনি স্পষ্টতই ইসকনের ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। ব্যক্তিজীবনে তিনি প্রসাদভোজী। মাছ–মাংস খান না।
২০১৯ সালে তিনি ভারতের নাগপুরে আরএসএসের সদর দপ্তর পরিদর্শন করে আরএসএসের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিলেন।
মা–বাবা—দুজনের কেউই ভারতীয় বংশোদ্ভূত না হওয়ার পরও হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তুলসী বলেছেন, যখনই তিনি ভারতে এসেছেন, তখনই তাঁর মনে হয়েছে, তিনি যেন তাঁর জন্মভূমিতে এসেছেন। শুধু ধর্মীয় কারণে তিনি ভারতের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন। এবার ভারতে আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে উপহার হিসেবে একটি ‘গঙ্গাজল কুম্ভ’ দিয়েছেন।
এ পর্যন্ত তুলসী গ্যাবার্ডের ক্যারিয়ারে দেখা যায়, তিনি ‘উগ্র ইসলামপন্থা’র ঘোর বিরোধী। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অন্য দেশে হস্তক্ষেপ করে সরকার পরিবর্তনের নীতিরও তিনি ঘোর বিরোধী হিসেবে পরিচিত।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দাপ্রধানদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে নয়াদিল্লিতে এসেছেন তুলসী। তবে তুলসীকে মোদি সরকার শুধু একজন মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবে দেখেনি; এর বাইরেও তার চেয়ে ‘আপন কেউ’ একজন হিসেবে দেখেছে। তুলসীও সেই অভ্যর্থনাকে সেভাবেই গ্রহণ করেছেন। তিনি ‘বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলমান দুর্ভাগ্যজনক নিপীড়ন, হত্যা ও অন্যান্য নির্যাতনকে’ যুক্তরাষ্ট্র সরকার, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ‘উদ্বেগের একটি প্রধান ক্ষেত্র’ হিসেবে দেখেছেন।
বাংলাদেশ সম্পর্কে তুলসীর এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতের ক্ষমতাসীন মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্ট মিল দেখা গেছে।
এসব কারণে তুলসী গ্যাবার্ডের এই মন্তব্য খুব অপ্রত্যাশিত ছিল, তা বলা যাবে না। তিনি যে মুহূর্তে ভারতে অবস্থান করছেন, সেই মুহূর্তে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে কীভাবে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তা তিনি বলেননি। এটিকেও অপ্রত্যাশিত বলে ভাবার সুযোগ কম।
তুলসীর জায়গায় আজ যদি একজন শ্বেতাঙ্গ ক্যাথলিক আমেরিকান থাকতেন এবং তিনি ঠিক এই কথাগুলোই বলতেন, তাহলে সেই কথাগুলোও হয়তো চাঞ্চল্য তৈরি করত, কিন্তু তার প্রভাবের ধরন হতো অন্য রকম। সেই কথাগুলো ইউনূস সরকারবিরোধীদের জন্য সম্ভবত এতটা ‘মৃতসঞ্জীবনী সুধা’ হিসেবে ধরা হতো না। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের অন্ধ অনুসারীদের হয়তো ‘শিগগিরই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে’ মার্কা স্ট্যাটাস দিয়ে ফেসবুক গরম করতে দেখা যেত না।
তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘খুব ভালো বন্ধু’ এবং তাঁরা অভিন্ন লক্ষ্যসমূহ অর্জনের ওপর আলোকপাত করছেন। বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী সন্ত্রাসকে পরাজিত করা তাঁদের লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
অনেকে বলছেন, তুলসী গ্যাবার্ড স্রেফ একজন গোয়েন্দাপ্রধান। তাঁর এই বক্তব্যের প্রভাব ততটা নেই, যতটা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাঁর বক্তব্যের সম্ভাব্য প্রভাবকে খাটো করে দেখার সুযোগ কম।
ইতিমধ্যেই তুলসীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের সরকারের দিক থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে যথেষ্ট শক্ত ভাষায় তুলসীর বক্তব্যকে ‘অন্যায্য’, ‘বিভ্রান্তিকর’, ‘বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনামের জন্য ক্ষতিকর’ বলে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে এত কঠোরভাবে বাংলাদেশের কোনো সরকারকে কোনো মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করতে দেখা যায়নি। ফলে এটি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের কূটনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অনেকে বলছেন, তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় না যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি আসলে কোনো নতুন কথা বলেননি, শুধু তার আগের অবস্থান এবং ট্রাম্প প্রশাসনের ইসলামপন্থী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতির কথাই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আর সেটিকেই ভারতীয় মিডিয়া সেনসেশন দিয়ে প্রচার করেছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিকবলিত রাষ্ট্র এবং ইউনূস সরকারকে জঙ্গি তোষণকারী সরকার হিসেবে দেখানোর একটা সূক্ষ্ম চেষ্টা রয়েছে। সে ধরনের যেকোনো চেষ্টাকে নস্যাৎ করার সক্ষমতা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের আছে—আপাতত এই আস্থা রাখতে চাই।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসল মপন থ সরক র র এস ছ ন আম র ক ত লস র র জন য বল ছ ন র ওপর ক ষমত ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ