কথা বড় বিচিত্র জিনিস। একই কথা—সকালে যার ওজন পাঁচ মণ, বিকেলে তার ওজন পাঁচ ছটাক না–ও থাকতে পারে। যে কথার দাম খাটের তলায় এক শ টাকা, আগরতলায় সে কথার দাম দশ পয়সা না–ও থাকতে পারে। যে কথা হাবলা হাবার মা–বাবা বললে কেউ গা করবে না; সেই একই কথা ওবামার মা–বাবা বললে তামাম দুনিয়ায় নিউজ হয়ে যাবে।
স্থান–কাল–পাত্রভেদে একই কথার ওজন যে একেক রকম, তা আমেরিকার গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের সামান্য কথা অসামান্যভাবে আবার প্রমাণ করল।
আদতে তুলসী গ্যাবার্ড খুব নতুন কিছু বলেননি। কিন্তু তাঁর কথা নিয়ে ভারতের মিডিয়ায় বিরাট চাঞ্চল্য হয়েছে। বাংলাদেশে হোয়াটসঅ্যাপ–মেসেঞ্জারে লিংক চালাচালি হচ্ছে। এত উথালিপালাথির কারণ হলো স্থান–কাল–পাত্র—তিনটি অনুষঙ্গই এত লাগসই ভূমিকা রেখেছে যে তুলসীর সাধারণ কথাগুলো বিরাট হয়ে উঠেছে।
গত সোমবার (১৭ মার্চ) এনডিটিভিকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় সঞ্চালক বিষ্ণু সোম তুলসীকে বলেছিলেন, ‘ভারতের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে আমরা অনেক পটপরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্র কি সেখানকার পরিস্থিতিকে আমলে নিচ্ছে এবং রাজনীতির বাইরেও সব পর্যায়ে স্থিতিশীলতা রাখতে তৎপর আছে?’
এর জবাবে তুলসী বলেছেন, ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অনেক দিন ধরে নিপীড়ন, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আসছে এবং এটি আমেরিকান সরকার এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে।’ তিনি বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদ দমন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সে লক্ষ্যেই তারা কাজ করছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন নতুন ক্যাবিনেট ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।’
তুলসীর এই কথাগুলো সরকারি কর্মকর্তা বা কূটনীতিকদের ব্যবহার্য ফরম্যাট করা কথা। এখানে দৃশ্যত উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছু নেই। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে এই কথা আমরা বহু শুনেছি। এগুলো আমাদের কাছে জলভাত ছিল। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের হুমকি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বৈশ্বিক তৎপরতা একই মতাদর্শ ও উদ্দেশ্যকে অনুসরণ করে—এটি মূলত একটি ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।’ মূলত তিনি এই ‘ইসলামি খেলাফত’ টার্মটি বাংলাদেশ ইস্যুতে ব্যবহার করায় আবহ গরম হয়েছে।
তুলসীর জায়গায় আজ যদি একজন শ্বেতাঙ্গ ক্যাথলিক আমেরিকান থাকতেন এবং তিনি ঠিক এই কথাগুলোই বলতেন, তাহলে সেই কথাগুলোও হয়তো চাঞ্চল্য তৈরি করত, কিন্তু তার প্রভাবের ধরন হতো অন্য রকম। সেই কথাগুলো ইউনূস সরকারবিরোধীদের জন্য সম্ভবত এতটা ‘মৃতসঞ্জীবনী সুধা’ হিসেবে ধরা হতো না। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের অন্ধ অনুসারীদের হয়তো ‘শিগগিরই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে’ মার্কা স্ট্যাটাস দিয়ে ফেসবুক গরম করতে দেখা যেত না।তুলসী বলেছেন, ‘এটি স্পষ্ট, অন্য যেকোনো ধর্মের অনুসারীরা ইসলামপন্থীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, যদি না তারা সেই [চরমপন্থী] গোষ্ঠীর গ্রহণযোগ্য ধর্ম অনুসরণ করে। তারা সন্ত্রাস ও চরম সহিংসতার মাধ্যমে এ মতবাদ বাস্তবায়ন করতে চায়।.
প্রথমত, কথাগুলো যিনি বলেছেন, তিনি যে শুধু বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির গোয়েন্দাপ্রধান, তা–ই নয়; এর বাইরেও তাঁর এমন ব্যক্তি পরিচয় আছে, যা এই কথাগুলো কারও জন্য উদ্বেগ–জাগানিয়া আবার কারও জন্য ‘মৃতসঞ্জীবনী সুধা’ হিসেবে কাজ করছে।
ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে কোনো কবির কবিতা বা লেখকের গল্প, গদ্য বা নাটক পড়ানোর আগে সাহিত্যের মাস্টাররা ছাত্রছাত্রীদের আগে সেই কবি বা ঔপন্যাসিক বা নাট্যকারের জীবন সম্পর্কে ধারণা দেন। সংশ্লিষ্ট কবি বা ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিগত জীবন কেমন, তাঁর ধর্ম বা সমাজসংক্রান্ত দর্শন কী, তা সম্পর্কে আলোচনা করেন। এতে ব্যক্তি হিসেবে কবি বা লেখকের মনস্তত্ত্ব বোঝা যায়। কোন কোন বিষয়ে তাঁর পক্ষপাত আছে, তা বোঝা যায়। এসব জানা গেলে তাঁর কাব্য বা গল্প বা উপন্যাসের মর্মার্থ ধরা সহজ হয়।
আরও পড়ুনবাংলাদেশে গুতেরেস এবং আমাদের সংস্কার ১০ ঘণ্টা আগেসেই নিরিখে তুলসী গ্যাবার্ডের বাংলাদেশে ‘ইসলামি খেলাফত’ প্রতিষ্ঠাবিষয়ক উদ্বেগকে যদি বিচার করি, তাহলে তাঁর ব্যক্তি ও পেশাদারি জীবনে ঢুঁ মারা দরকার হয়ে পড়ে।
তুলসী গ্যাবার্ড ফৌজি মানুষ। মার্কিন সেনা হিসেবে তিনি ইরাক ও কুয়েত যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদায় এসেছেন। চাকরি শেষে ডেমোক্রেটিক দলের রাজনীতি করলেও পরে রিপাবলিকান দলে ভেড়েন।
তুলসীর বাবা মাইক গ্যাবার্ড একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ছিলেন। তাঁর মা ক্যারল গ্যাবার্ড প্রথমে খ্রিষ্টান ছিলেন, পরে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁদের পরিবার মূলত ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) বা ‘হরে কৃষ্ণ’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। মূলত এ সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা কৃষ্ণভক্তিতে আকৃষ্ট হন। ভক্তি, জয়, আরিয়ান ও বৃন্দাবন নামে তুলসীর আরও চার ভাইবোন আছে।
তুলসী গ্যাবার্ড যদিও নিজেকে ইসকনের সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন না, তবে তিনি স্পষ্টতই ইসকনের ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। ব্যক্তিজীবনে তিনি প্রসাদভোজী। মাছ–মাংস খান না।
২০১৯ সালে তিনি ভারতের নাগপুরে আরএসএসের সদর দপ্তর পরিদর্শন করে আরএসএসের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিলেন।
মা–বাবা—দুজনের কেউই ভারতীয় বংশোদ্ভূত না হওয়ার পরও হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তুলসী বলেছেন, যখনই তিনি ভারতে এসেছেন, তখনই তাঁর মনে হয়েছে, তিনি যেন তাঁর জন্মভূমিতে এসেছেন। শুধু ধর্মীয় কারণে তিনি ভারতের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন। এবার ভারতে আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে উপহার হিসেবে একটি ‘গঙ্গাজল কুম্ভ’ দিয়েছেন।
এ পর্যন্ত তুলসী গ্যাবার্ডের ক্যারিয়ারে দেখা যায়, তিনি ‘উগ্র ইসলামপন্থা’র ঘোর বিরোধী। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অন্য দেশে হস্তক্ষেপ করে সরকার পরিবর্তনের নীতিরও তিনি ঘোর বিরোধী হিসেবে পরিচিত।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দাপ্রধানদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে নয়াদিল্লিতে এসেছেন তুলসী। তবে তুলসীকে মোদি সরকার শুধু একজন মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবে দেখেনি; এর বাইরেও তার চেয়ে ‘আপন কেউ’ একজন হিসেবে দেখেছে। তুলসীও সেই অভ্যর্থনাকে সেভাবেই গ্রহণ করেছেন। তিনি ‘বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলমান দুর্ভাগ্যজনক নিপীড়ন, হত্যা ও অন্যান্য নির্যাতনকে’ যুক্তরাষ্ট্র সরকার, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ‘উদ্বেগের একটি প্রধান ক্ষেত্র’ হিসেবে দেখেছেন।
বাংলাদেশ সম্পর্কে তুলসীর এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতের ক্ষমতাসীন মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্ট মিল দেখা গেছে।
এসব কারণে তুলসী গ্যাবার্ডের এই মন্তব্য খুব অপ্রত্যাশিত ছিল, তা বলা যাবে না। তিনি যে মুহূর্তে ভারতে অবস্থান করছেন, সেই মুহূর্তে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে কীভাবে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তা তিনি বলেননি। এটিকেও অপ্রত্যাশিত বলে ভাবার সুযোগ কম।
তুলসীর জায়গায় আজ যদি একজন শ্বেতাঙ্গ ক্যাথলিক আমেরিকান থাকতেন এবং তিনি ঠিক এই কথাগুলোই বলতেন, তাহলে সেই কথাগুলোও হয়তো চাঞ্চল্য তৈরি করত, কিন্তু তার প্রভাবের ধরন হতো অন্য রকম। সেই কথাগুলো ইউনূস সরকারবিরোধীদের জন্য সম্ভবত এতটা ‘মৃতসঞ্জীবনী সুধা’ হিসেবে ধরা হতো না। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের অন্ধ অনুসারীদের হয়তো ‘শিগগিরই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে’ মার্কা স্ট্যাটাস দিয়ে ফেসবুক গরম করতে দেখা যেত না।
তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘খুব ভালো বন্ধু’ এবং তাঁরা অভিন্ন লক্ষ্যসমূহ অর্জনের ওপর আলোকপাত করছেন। বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী সন্ত্রাসকে পরাজিত করা তাঁদের লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
অনেকে বলছেন, তুলসী গ্যাবার্ড স্রেফ একজন গোয়েন্দাপ্রধান। তাঁর এই বক্তব্যের প্রভাব ততটা নেই, যতটা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাঁর বক্তব্যের সম্ভাব্য প্রভাবকে খাটো করে দেখার সুযোগ কম।
ইতিমধ্যেই তুলসীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের সরকারের দিক থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে যথেষ্ট শক্ত ভাষায় তুলসীর বক্তব্যকে ‘অন্যায্য’, ‘বিভ্রান্তিকর’, ‘বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনামের জন্য ক্ষতিকর’ বলে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে এত কঠোরভাবে বাংলাদেশের কোনো সরকারকে কোনো মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করতে দেখা যায়নি। ফলে এটি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের কূটনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অনেকে বলছেন, তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় না যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি আসলে কোনো নতুন কথা বলেননি, শুধু তার আগের অবস্থান এবং ট্রাম্প প্রশাসনের ইসলামপন্থী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতির কথাই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আর সেটিকেই ভারতীয় মিডিয়া সেনসেশন দিয়ে প্রচার করেছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিকবলিত রাষ্ট্র এবং ইউনূস সরকারকে জঙ্গি তোষণকারী সরকার হিসেবে দেখানোর একটা সূক্ষ্ম চেষ্টা রয়েছে। সে ধরনের যেকোনো চেষ্টাকে নস্যাৎ করার সক্ষমতা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের আছে—আপাতত এই আস্থা রাখতে চাই।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসল মপন থ সরক র র এস ছ ন আম র ক ত লস র র জন য বল ছ ন র ওপর ক ষমত ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
স্কিন ব্যাংকে পর্যাপ্ত ত্বক থাকলে ৪০ শতাংশের বেশি দগ্ধ রোগীকেও বাঁচানো যায়
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে হতাহত হওয়ার ঘটনার পর দেশের একমাত্র স্কিন ব্যাংকের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এ ব্যাংকের অবস্থান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাইলস্টোনের ঘটনার পর অনেকেই স্কিন (চামড়া বা ত্বক) দান করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে ইনস্টিটিউটে যোগাযোগ করছেন। স্কিন ব্যাংকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্বক থাকলে ৪০ শতাংশের বেশি পুড়ে যাওয়া রোগীকেও বাঁচানো সম্ভব।
২১ জুলাই দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। গত সোমবার রাত ১০টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ৩৪ জন মারা গেছে। আর সোমবার বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ৪৫ জন। তাদের মধ্যে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি ৩৩ জন।
দেশে স্কিন ব্যাংকের যাত্রা শুরুর পর দান করা ত্বক ব্যবহার করে ১০ জন দগ্ধ রোগীর চিকিৎসা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৯ জনই বেঁচে গেছেন। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা থাকায় একজন মারা গেছেন।জীবিত ব্যক্তির শরীর থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করা ত্বক মারাত্মকভাবে দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া যে কেউ চাইলে মরণোত্তর ত্বক দান করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে দাতার মৃত্যুর পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মরদেহ থেকে ত্বক সংগ্রহ করা হয়। পরে সেই ত্বক দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
ওজন কমানোসহ কিছু প্লাস্টিক সার্জারির পর বেঁচে যাওয়া ত্বক সংরক্ষণ করার মধ্য দিয়ে দেশের একমাত্র স্কিন ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করে। আগে এ ধরনের অস্ত্রোপচারের পর বাড়তি ত্বক ফেলে দেওয়া হতো।
স্কিন ব্যাংকের সমন্বয়কারী ও জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মাইলস্টোনের ঘটনার পর ত্বকদানের বিষয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে; বিশেষত অনেক নারী আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এখন পর্যন্ত শতাধিক মানুষ এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে যোগাযোগ করেছেন।
তবে সমস্যা হলো, আগ্রহী ব্যক্তিদের বেশির ভাগ চাইছেন, মাইলস্টোনের ঘটনায় দগ্ধ শিক্ষার্থীদের শরীরে যাতে তাঁদের দান করা ত্বক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে প্রক্রিয়া শেষে কার দান করা ত্বক কার শরীরে ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া ত্বক দান করার ক্ষেত্রে স্ক্রিনিংসহ পুরো প্রক্রিয়া শুনে অনেকে আর আগ্রহ দেখাননি। এখন পর্যন্ত যাঁরা যোগাযোগ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৬ জন ত্বক দান করতে চেয়েছেন বলে জানান চিকিৎসক মাহবুব হাসান।
ভবিষ্যতে দগ্ধ রোগীর চিকিৎসায় ত্বক সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। ত্বক সংগ্রহের পর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তরল নাইট্রোজেনে ডুবিয়ে মাইনাস ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। তাহলে সেই ত্বক পাঁচ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে।মাহবুব হাসান, জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক।৩ জুলাই মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম আন্তর্জাতিক দগ্ধ ও আঘাতপ্রাপ্তদের সম্মেলন। এই সম্মেলনে ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ফার্স্ট স্কিন ব্যাংক ইন বাংলাদেশ: দ্য ওয়ে অব ওভার কামিং দ্য চ্যালেঞ্জেস’ শিরোনামের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাহবুব হাসান। প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, দেশে স্কিন ব্যাংকের যাত্রা শুরুর পর দান করা ত্বক ব্যবহার করে ১০ জন দগ্ধ রোগীর চিকিৎসা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৯ জনই বেঁচে গেছেন। আর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা থাকায় একজন মারা গেছেন।
আপাতত রেজিস্ট্রেশন ও স্ক্রিনিংদেশের একমাত্র স্কিন ব্যাংক উদ্বোধন করা হয় গত ৯ জানুয়ারি। তবে গত ২০ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়। ব্যাংকটিতে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল। বর্তমানে এই ব্যাংকে দুজন চিকিৎসক ও একজন নার্স দায়িত্ব পালন করছেন।
স্কিন ব্যাংক যাত্রা শুরুর পর মোট ১৪ হাজার ৫০০ সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক সংরক্ষণ করা হয়েছিল। মাইলস্টোনের ঘটনার আগপর্যন্ত ৯ হাজার সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক ব্যাংকে ছিল। মাইলস্টোনের ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় গত রোববার পর্যন্ত এ ব্যাংক থেকে সাড়ে ৩ হাজার সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক ব্যবহার করা হয়েছে।
স্কিন ব্যাংক যাত্রা শুরুর পর মোট ১৪ হাজার ৫০০ সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক সংরক্ষণ করা হয়েছিল। মাইলস্টোনের ঘটনার আগপর্যন্ত ৯ হাজার সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক ছিল। মাইলস্টোনের ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় গত রোববার পর্যন্ত এ ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন হাজার সেন্টিমিটার স্কয়ার ত্বক ব্যবহার করা হয়েছে।মাইলস্টোনের ঘটনার পর ত্বকদানের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে। ত্বকদানের আহ্বান জানিয়ে অনেকেই পোস্ট দিচ্ছেন। তবে কিছু কিছু ভুল তথ্যও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে।
আরও পড়ুনস্কিন ব্যাংক চালু হলো বাংলাদেশে, দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত২৫ জুলাই ২০২৫মাইলস্টোনের ঘটনার পর জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অনেকেই ত্বক দান করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। তবে স্কিন ব্যাংকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্বক সংরক্ষিত আছে।
এ বিষয়ে চিকিৎসক মাহবুব হাসান বলেন, এ মুহূর্তে ত্বকদানে আগ্রহী ব্যক্তিদের রেজিস্ট্রেশন আর স্ক্রিনিং করে রাখার বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, যাতে জরুরি প্রয়োজনে তাঁদের কাছ থেকে ত্বক সংগ্রহ করা যায়।
সংগ্রহ করা ত্বক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তরল নাইট্রোজেনে ডুবিয়ে মাইনাস ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখলে পাঁচ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে