লিবিয়ায় দালাল চক্রের নির্যাতনে ভৈরবের এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ
Published: 3rd, April 2025 GMT
দালাল চক্রের সঙ্গে চুক্তি ছিল, ১৬ লাখ টাকার বিনিময়ে সোহাগ মিয়া (২৮) নামের এক যুবককে লিবিয়া হয়ে সাগর পথে ইতালি পৌঁছে দেওয়া হবে। ৫ লাখ টাকা পাওয়ার পর প্রায় ৭ মাস আগে তাঁকে লিবিয়া নেওয়া হয়। এরপর দফায় দফায় আদায় করা হয় পুরো টাকা। এর মধ্যে ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও সোহাগের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। গত রোববার দালাল চক্রের জিম্মায় লিবিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
সোহাগ কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌর শহরের কালিপুর দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা। এই তথ্য নিশ্চিত করে পরিবারের সদস্যেরা অভিযোগ করেন, দালাল চক্রের ক্রমাগত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে সোহাগের মৃত্যু হয়েছে। ইতালি পৌঁছে না দিতে পারলেও, এ সময়ের মধ্যে নানা অজুহাতে চুক্তির সব টাকা আদায় করে নিয়েছে তাঁরা।
ইতালিতে থাকেন সোহাগের বড় ভাই সুজন মিয়া। ভাইয়ের মৃত্যুর তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সোহাগ দালাল চক্রের জিম্মায় ছিল। দালালেরা আমার মাধ্যমে ১৬ লাখ টাকা নেয়। সোহাগকে প্রতিনিয়ত টাকার জন্য নির্যাতন চালাত। প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত খাবার দিত না। কয়েক দিন আগে শারীরিকভাবে নির্যাতন করলে সোহাগ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। সর্বশেষ গত রোববার তাঁর মৃত্যুর খবর এসেছে। এর পর থেকে দালালদের কারও মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।’
পরিবারের সদস্যরা জানায়, সোহাগের বাবা বেঁচে নেই। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। এর আগে ৮ বছর তিনি কাতারে ছিলেন। বছরখানিক আগে দেশে ফিরে বিয়ে সেরেছেন। সেই সংসারে দুই মাস বয়সী একটি কন্যাসন্তানও আছে। দেশে থাকা অবস্থায় নরসিংদীর বেলাব উপজেলার বারৈচা এলাকার সেন্টু মিয়া নামের এক দালালের সঙ্গে সোহাগের পরিচয় হয়। পরে সেন্টুর মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে সাগরপথে ইতালি যাওয়ার চুক্তি হয়। লিবিয়ায় তাঁকে আটকে রেখে কৌশলে এবং দফায় দফায় চুক্তির পুরো টাকা আদায় করে চক্রটি। এটি নিয়ে কথা বললে তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হতো।
সোহাগের স্ত্রী লিজা বেগম জানান, নিজের ইচ্ছামতো তাঁর স্বামীর সঙ্গে কথা বলা যেত না। কথা হলেই বলতেন, সমস্যায় আছেন। দালালের দাবি করা টাকার বিনিময়ে সোহাগের সঙ্গে বলতে হতো।
সোহাগের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে পরিবারটি। একই সঙ্গে দালাল চক্রের সদস্যের বিচারও দাবি করেছেন।
এদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত সেন্টু মিয়া বর্তমানে দেশে নেই। তাঁর মুঠোফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শবনম শারমিন বলেন, ‘সোহাগের লাশ দেশে মরদেহ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আমার সহযোগিতা থাকবে।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
দোষ বিয়ারিং প্যাডের নয়, যারা লাগিয়েছে কিংবা বুঝে নিয়েছে, তাদের: ডিএমটিসিএল এমডি
মেট্রোরেল চালুর আগে নিরাপত্তার পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা (সেফটি অডিট) ছাড়াই যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকার মেট্রোরেলের। এর মধ্যে বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে একজন পথচারী মারা গেছেন। এবার নতুন করে নিরাপত্তার নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
বিয়ারিং প্যাড পড়ে পথচারীর মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর আজ সোমবার সকালে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেলের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেলের আগে সেফটি অডিট হয়নি। তাই সেফটি অডিট করতে চাইছি। যত দ্রুত করা যায়, সেটা আমরা করব। থার্ড পার্টিকে (তৃতীয় পক্ষ) দিয়ে এই অডিট করানো হবে। ইউরোপীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়েই করানো হবে। আমাদের কাছে ফ্রান্সের দুটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। সেফটি অডিট করার জন্য আমরা খুব শিগগির টেন্ডারের প্রক্রিয়ায় যাব।’
এক বছর আগে ঢাকার মেট্রোরেলের স্তম্ভের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার পর গত ২৬ অক্টোবর ফার্মগেটে আরেকটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু হয়। এরপর ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় শাহবাগ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ছিল।
বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ার পর এগুলোর নিরাপত্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, ‘বিয়ারিং প্যাড হঠাৎ করে পড়ে যায়নি। এটা হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার জিনিস নয়। যেহেতু এটা নিয়ে তদন্ত চলছে, ফলে এ বিষয়ে আমি জাজমেন্টাল হতে চাই না। তবে যেটা হতে পারে, সেটা বলতে পারি, ডিজাইন ফল্ট হতে পারে। যে জিনিসের ওপর বসানোর কথা বলা হয়েছিল, যা যা দেওয়ার কথা ছিল, সেটা বসানো হয়নি। যে ডিজাইনে হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়তো ঠিকাদার করেনি। যে পরামর্শককে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা হয়তো ঠিক করে জিনিসটা বুঝে নেয়নি। এই চারটা কারণে হতে পারে অথবা এর মধ্যে কোনো একটা কারণেও হতে পারে।’
ফারুক আহমেদ আরও বলেন, ‘দোষ কিন্তু বিয়ারিংয়ের নয়। বিয়ারিং যে লাগিয়েছে, সেটি বাজেভাবে লাগানো হয়েছে কি না? যার আসলে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল, সে বুঝে নিয়েছে কি না, সেগুলো এখন দেখতে হবে।’
আরও পড়ুনবৃষ্টির পানি ঢোকে, এসি বিকল হয়, মেট্রোরেল ব্যবস্থায় ৪৫ সমস্যা০২ নভেম্বর ২০২৫এসব কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য হাজার কোটি টাকায় বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা আছে জানিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘প্রথম ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেবেন পরামর্শক। আমাদের বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পরামর্শকদের। তখন এই কাজগুলো কিছুটা তাড়াহুড়া হয়েছে। কেন হয়েছে, সেটার উত্তর তো আমি দিতে পারব না। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই অংশে অনেক ডিফেক্ট আছে। ফলে সেটা এখনো আমরা বুঝে নিইনি।’
ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, যেখানে বিয়ারিং প্যাড পড়ে গিয়েছিল, ওই অংশের ত্রুটি সারিয়ে দেওয়ার সময়সীমা (ডিফেক্ট লায়াবেলিটি) গত জুন পর্যন্ত ছিল। কিন্তু ডিএমটিসিএল তাদের এই সময়সীমা গ্রহণ করেনি। কারণ, এখনো অনেক বড় ত্রুটি রয়ে গেছে। যত সমস্যা আছে, এগুলো ঠিকাদারকে মেরামত করতে হবে। এ জন্য ‘ডিফেক্ট লায়াবেলিটি’ দুই বছর বাড়ানোর জন্য ঠিকাদারকে বলা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেলের সব কটি পিলার পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে জানিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, এর আগে পুরো পথের বিয়ারিং প্যাডের ছবি ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে তোলা হয়েছে। এরপর কর্মকর্তারা সরেজমিনে নিরীক্ষা করেছেন। যেসব স্থানে ত্রুটি শনাক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে। ডিএমটিসিএলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, যেখানে ত্রুটি বা সমস্যা পাওয়া যাবে, সেখানে বিয়ারিং প্যাড অবশ্যই পরিবর্তন করা হবে।
আরও পড়ুনমেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড কী, খুলে পড়ার কারণ কী হতে পারে২৬ অক্টোবর ২০২৫চার বছর আগে তাড়াহুড়া করে ঢাকার মেট্রোরেল চালু করা হয়েছিল দাবি করে ফারুক আহমেদ বলেন, প্রকল্পটি চালুর আগে ন্যূনতম ছয় থেকে নয় মাসের পরীক্ষামূলক চলাচল নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল। তিন বছরে মেট্রোরেল চালু হবে বা পাঁচ বছরে মেট্রোরেল সম্পূর্ণ হবে—এ ধরনের ধারণা আসলে ভুল। কোনো মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য সব ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পর ছয় থেকে সাত বছর লাগে। এর আগে প্রকল্প প্রণয়ন, সম্ভাব্যতা যাচাই ও অন্যান্য প্রস্তুতিতে চলে যায় তিন বছর।
২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের যে লক্ষ্যমাত্রা আগে নেওয়া হয়েছিল, তা কিসের ভিত্তিতে হয়েছে, তা তার বোধগম্য নয় বলে মন্তব্য করেন ডিএমটিসিএলের এমডি।
নতুন মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প তাহলে মুখ থুবড়ে পড়ছে কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘মেট্রোরেল প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েনি। মেট্রোরেল আমাদের লাগবে। আমাদের লক্ষ্য হলো, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এই প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়। সরকারের উদ্দেশ্য হলো একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা, যাতে একাধিক প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারে এবং কম খরচে উন্নত মানের মেট্রোরেল নির্মাণ সম্ভব হয়। মেট্রোরেল আমাদের করতেই হবে; তবে তা হবে স্মার্ট ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে।’
আরও পড়ুনবিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে ফার্মগেটে একজন নিহত, মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ২৬ অক্টোবর ২০২৫