পাকিস্তানের সমস্যা শুধু সংখ্যায় বাড়ছে না, বরং দেশের ভেতরে বিভাজন আর অস্থিরতাও তাতে আরও গভীর হচ্ছে। কোথাও বিক্ষোভ, কোথাও বিদ্রোহ, কোথাও আবার চরমপন্থীদের সহিংসতা। সন্ত্রাসবাদ, কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে টানাপোড়েন, পানিবণ্টন নিয়ে বিরোধ এবং সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংঘাত—সব একসঙ্গে ঘটছে।

এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায়, দেশের শাসনব্যবস্থা ও নেতৃত্ব কোন পর্যায়ে রয়েছে। সংবাদমাধ্যমে সরকার নিজেই নিজেকে বাহবা দিলেও আসল চিত্র একেবারেই ভিন্ন। মৌলিক সমস্যা এখনো অব্যবস্থাপনার শিকার। শাসনের মানও জনগণের প্রত্যাশার অনেক নিচে। পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন জায়গায় শাসকদের গুণগান করে বড় বড় বিলবোর্ড টাঙানো হচ্ছে।

কিন্তু এসব দিয়ে নেতৃত্ব তৈরি হয় না। টেলিভিশনে যেসব অনুষ্ঠান দেখানো হয়, সেখানে মনে হয় ক্ষমতাবানদের দৈনন্দিন দায়িত্ব পালনও যেন বিশেষ কিছু। এসব মানুষকে উৎসাহিত তো করেই না, বরং মনে হয়, নেতারা নিজেরাই নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অতি উদ্বিগ্ন। প্রকৃত স্বীকৃতি আসে কাজ দিয়ে, পোস্টার আর পত্রিকার ৬০ পাতার বিজ্ঞাপন দিয়ে নয়।

পাকিস্তানের সেসব জটিল সমস্যা এখন সামনে এসেছে। খাপছাড়া, এলোমেলোভাবে অর্থনীতি, রাজনীতি আর নিরাপত্তা–সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা কাজে আসে না, বরং ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। একের পর এক জনমত জরিপে সেই হতাশারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি ইপসস জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করে, দেশ ভুল পথে হাঁটছে।

পাকিস্তানের ইতিহাসে এর আগেও নেতৃত্বহীন সময় এসেছে। অতীতে অনেকেই দেশের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের না ছিল দক্ষতা, না ছিল দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা মোকাবিলার দৃষ্টিভঙ্গি। ক্ষমতা হাতে পেলেই যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তা নয়। এই কারণেই দেশে শুধু শাসন হয়েছে, শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। রাজনীতি হয়েছে ক্ষমতার খেলা, জনস্বার্থ নয়। কিন্তু এখন সমস্যাগুলো এতটাই জটিল যে নেতৃত্বশূন্যতা আজ ভয়াবহভাবে স্পষ্ট।

তাহলে কেমন নেতৃত্ব চাই পাকিস্তানের? কাকে বলব দক্ষ নেতা? আর কী গুণ থাকা দরকার একজন কার্যকর নেতার মধ্যে? সবার আগে প্রয়োজন এমন এক দৃষ্টিভঙ্গির, যা শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ নিয়েও পথ দেখায় এবং আশার সঞ্চার ঘটায়। সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার পরিকল্পনাও থাকা চাই। একজন নেতা কেবল কথা বলেই থেমে যাবেন না, তিনি জাতির মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলবেন, মানুষের ভরসা অর্জন করবেন আর রূপান্তরের পথে সাহসিকতার সঙ্গে অগ্রসর হবেন।

একজন নেতার উচিত হবে এমন দল গঠন করা, যাঁদের মধ্যে দক্ষতা ও সততা দুই-ই রয়েছে। বুদ্ধিমান নেতা জানেন, কে কোন কাজের উপযুক্ত। ব্যক্তিগত আনুগত্য বা রাজনৈতিক সুবিধা নয়। নেতৃত্ব মানে হচ্ছে মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা, তাদের দুঃখ-কষ্ট বোঝা, তাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা জানা এবং তার সাড়া দেওয়া।

এই মানদণ্ডে বিচার করলে দেখা যায় আজকের শাসকগোষ্ঠী কতটা ব্যর্থ। কোথাও কোনো বড় স্বপ্ন নেই। নেই সুসমন্বিত কোনো পরিকল্পনা। সমস্যা দেখা দিলেই তড়িঘড়ি দমনের চেষ্টা চলছে। 

কিন্তু মূল সমস্যাগুলো থেকে যাচ্ছে অমীমাংসিত। যেমন বেলুচিস্তানের পরিস্থিতি। প্রদেশটি তীব্র অসন্তোষে ফুটছে, অথচ কোনো টেকসই সমাধানের রূপরেখা তৈরি হয়নি। আবার পাঞ্জাব ও সিন্ধুর মধ্যে পানির ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ দিনকে দিন বাড়ছে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার যেন চোখ বুজে আছে।

অর্থনীতি নিয়েও বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অর্থনীতি বারবার সংকটে পড়ে। সেগুলো দূর করার বাস্তব উদ্যোগ দেখা যায়নি। ছোটখাটো সমাধানে ব্যস্ত থেকেছে সরকার। দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সাহস দেখায়নি।

অর্থনীতি নিয়েও বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অর্থনীতি বারবার সংকটে পড়ে। সেগুলো দূর করার বাস্তব উদ্যোগ দেখা যায়নি। ছোটখাটো সমাধানে ব্যস্ত থেকেছে সরকার। দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সাহস দেখায়নি।

আরও বড় সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা। নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে বিতর্কের কারণেই তাদের প্রতি জনসমর্থন দুর্বল। সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়েছে এলোমেলোভাবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কোনো ছাপ নেই। শাসনের দায়িত্ব পেয়েছে এমন একটি দল, যেখানে কিছু দক্ষ পেশাজীবী থাকলেও বেশির ভাগই নির্বাচিত হয়েছে পারিবারিক সম্পর্ক বা রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে।

আর একেবারেই অনুপস্থিত একটি গুণ। সেই গুণটি হলো জনগণকে নাগরিকদের অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা। আজকের নেতারা যেন সাধারণ মানুষের জীবন থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তাঁদের কথা বা কাজ, কোনোটাতেই মানুষের প্রতিচ্ছবি নেই। তাঁরা দেশকে একত্র করার বদলে যেন আরও বিভক্ত করে ফেলছেন। বর্তমান সময়ের যোগাযোগনির্ভর জগতে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার মতো দক্ষতাও তাঁদের মধ্যে অনুপস্থিত। 

হেনরি কিসিঞ্জার লিখেছিলেন, ‘সাধারণ নেতারা বর্তমান সামলান; কিন্তু মহান নেতারা সমাজকে নিয়ে যান স্বপ্নের দিকে।’ 

দরকার এমন নেতৃত্ব, যাঁরা সাহস করে পুরোনো ব্যর্থতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে দেশকে নিয়ে যাবেন একটি আশাবাদী ভবিষ্যতের দিকে।

মালিহা লোধি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত

ডন থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ষমত সমস য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন

প্রথিতযশা অধ্যাপক ও পরিসংখ্যানবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন সব্যসাচী মানুষ। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তাঁর ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের ধারণ করতে হবে।

জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেনের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।

অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতা, বৃত্তি, পদক, পুরস্কার ও সনদ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট।

অনুষ্ঠানে ‘যুগলের বন্ধন: কাজী নজরুল ইসলাম-কাজী মোতাহার হোসেন’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। তিনি দুই বন্ধুর সম্পর্কের রসায়নের নানা দিক তুলে ধরেন।

প্রধান অতিথি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এই অনুষ্ঠানের দুটো প্রাপ্তি আছে। প্রথমত, মানুষের অবদান ও মেধাকে স্বীকার করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই উপমহাদেশের একজন প্রথিতযশা সব্যসাচী মানুষের ঋণ স্বীকার করা হচ্ছে।

কাজী মোতাহার হোসেন যেকোনো বিবেচনায় একজন দার্শনিক বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। প্রথম সারির পরিসংখ্যানবিদ, বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও তিনি অনেকগুলো সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রভাব বিস্তার করেছেন। একজন মানুষের ছোট জীবদ্দশায় এত গুণ সন্নিবেশিত করা কঠিন। কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন।

সবাইকে নিয়ে চলা, প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, নিজের জগতের বাইরে নানা কিছুতে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঐতিহ্য কাজী মোতাহার হোসেন করে গেছেন বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, তাঁর সম্মানে যাঁরা আজ স্বীকৃতি পেলেন, তাঁরা এই ঐতিহ্যকে ধারণ করবেন। এটা (বিশ্ববিদ্যালয়) যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সে বার্তা দেবেন। যেসব শিক্ষার্থী সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁদের ছোট প্রোফাইল তৈরি করে ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মাজেদ বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন একজন সব্যসাচী মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তাঁর পদচারণা ছিল না। তিনি দাবা খুব পছন্দ করতেন। দাবা খেলার কথা শুনলে তিনি ছুটে যেতেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে তাঁর শোনা নানা গল্প তিনি স্মৃতিচারণা করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাফর আহমেদ খান বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান চর্চার পথিকৃৎ ছিলেন। বিজ্ঞান, দাবাচর্চারও পথিকৃৎ ছিলেন। এমন কোনো পুরস্কার নেই যে, তিনি পাননি। তাঁর দেখানো পথে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের আলোকিত করতে পারেন।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রওনাক হোসেন। এই আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সেরা শিক্ষার্থীদের বই, নগদ অর্থ ও সনদ তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গঙ্গাচড়ায় হিন্দুবাড়িতে হামলা ঠেকাতে ‘পর্যাপ্ত’ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
  • নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ-আ.লীগ নেতা–কর্মীদের ‘গোপন বৈঠক’ ঘিরে গ্রেপ্তার ২২, সেনা হেফাজতে মেজর
  • দেশের চারজনের একজন বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার
  • ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ যাতে মাথাচাড়া দিতে না পারে
  • ডেঙ্গুতে দুজনের, করোনাভাইরাসে একজনের মৃত্যু
  • জাওয়াইদেহ বেদুইনদের মৌখিক সাহিত্য
  • রাবিতে আ.লীগ ট্যাগ দিয়ে চিকিৎসা কর্মীকে বিবস্ত্র করে মারধর
  • ইরানের সঙ্গে সংঘাত: ইসরায়েলকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা দিতে সৌদি সরকারকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র
  • সিরিজের শেষ ম্যাচে নেই স্টোকস, দায়িত্বে পোপ
  • সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন