রাজধানী ঢাকার অদূরে টঙ্গীর বুক চিরে বয়ে চলা ঐতিহাসিক তুরাগ নদ। এ নদের ওপরে রয়েছে একটি বেইলি ব্রিজ। বহু আগের নির্মিত রুগ্ণপ্রায় সেতুটির ওপর দিয়ে লাখো মানুষ আতঙ্ক নিয়ে যাতায়াত করেন। রিকশা ও হেঁটে পার হওয়া ছাড়া কোনো গাড়ি চলাচলের সুযোগ নেই। জরুরি প্রয়োজনে ঢাকায় যেতে অনেক পথ ঘুরতে হয়। এ অবস্থায় ২০২২ সালে বেইলি ব্রিজের পাশ দিয়ে একটি কংক্রিটের সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। চলতি বছরে সম্পূর্ণ হওয়ার কথা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় ৬ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে নির্মাণকাজ। এতে নির্মাণাধীন সেতু নিয়ে আশাবাদী হয়েও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) রাজধানীর সঙ্গে গাজীপুরের টঙ্গীবাসীর যাতায়াতের সুবিধার্থে তুরাগ নদের ওপরে ‘প্রত্যাশা সেতু’ তৈরির উদ্যোগ নেয়। কাজ শুরুর পরপরই ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বর্তমানে স্থিতাবস্থায় রয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, ১৪টি পিলারের ওপর ৪৯৮ মিটার দৈর্ঘ্যের নির্মিতব্য এই সেতুটির কাজ চলছে। ১৪ পিলারের মধ্যে ১১টিতে স্প্যান বসানো হলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় বাকি তিনটি পিলারে স্প্যান বসানোর কাজ বন্ধ রয়েছে। সেতুটির কাজ শেষ না হওয়ায় এলাকার মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম অসন্তোষ। পল্লি সড়ক গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সালে শুরু হওয়া সেতুটির কাজ ৩ বছরের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল।
ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় বিপাকে পড়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনডিইর এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, জায়গার সমস্যার বিষয়টি সমাধানের দায়িত্ব এলজিইডির। নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধিতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এলজিইডি দ্রুত সমাধান দিলেই কাজের পরিবেশ তৈরি হবে।
এদিকে জমির মালিক আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, এলজিইডি প্রথমে সেতুটির পাইলিংয়ের কাজের সুযোগ চায়। শুরুতে বাধা দিলেও এলজিইডির টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে আমরা সরে আসি। পরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আশানুরূপ ফল না পেয়ে আদালতে স্টে অর্ডারের জন্য আবেদন করি। আদালত তা মঞ্জুর করেন। এখনও সে অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় এলাকাবাসী খুবই হতাশ।
উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকার প্রবীণ আনোয়ার হোসেন বলেন, সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হলে আমাদের টঙ্গীসহ অন্যান্য এলাকার মানুষের সঙ্গে যাতায়াত সহজ হবে। পুরোনো সেতুটি যে কোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। দ্রুত সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করার দাবি জানান তিনি।
টঙ্গীর স্টেশন এলাকার বাসিন্দা আবু সাঈদ সমকালকে বলেন, বেইলি সেতুর ওপর দিয়ে রিকশা ছাড়া কোনো যানবাহন চলাচলের সুযোগ নেই। কেউ অসুস্থ হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য সহজে ঢাকায় নেওয়া যায় না। অনেক পথ ঘুরতে হয়। এটা আমাদের জন্য বড় ধরনের বাধা।
ভূমি অধিগ্রহণে টাকা না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডি ঢাকা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী বাচ্চু মিয়া সমকালকে বলেন, উনাদের এ অভিযোগ ঠিক নয়। সেতুর দুই পাশে যাদের জায়গা পড়েছে, তাদের সঙ্গে আমরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখছি। চার ধারার কাজও প্রায় শেষ। প্রকল্পের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে সরকারের নির্ধারিত মূল্য হস্তান্তর করার পর তারা আট ধারা অনুযায়ী যাচাই-বাছাই শেষে জমির মালিকদের মূল্য পরিশোধ করবে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা দূর করতে হবে
দেশে রোগমুক্ত সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ড্রামে খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ একটি বড় বাধা। একইসাথে ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ ও গুণগত প্যাকেজিং অত্যন্ত জরুরি।
রাজধানীর বিআইপি কনফারেন্স রুমে সোমবার (২৮ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত “সবার জন্য ভিটামিন সমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল: অগ্রগতি, বাধা ও করণীয়” শীর্ষক সাংবাদিক কর্মশালায় এসব বিষয় তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত এই কর্মশালায় প্রিন্ট, টেলিভিশন এবং অনলাইন মিডিয়ায় কর্মরত ২৬ জন সাংবাদিক অংশ নেন।
কর্মশালায় জানানো হয়, জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জরিপ ২০১১-১২ অনুযায়ী, প্রাক্-বিদ্যালয়গামী প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন ভিটামিন ‘এ’ এবং দুইজন শিশু ভিটামিন ডি-এর ঘাটতিতে ভুগছে। ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ ব্যতীত ভোজ্যতেল বাজারজাত করা নিষিদ্ধ। আইসিডিডিআর,বি-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাজারে মোট ভোজ্যতেলের ৬৫ শতাংশই ড্রামে বিক্রি হয়। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ তেলে কোনো ভিটামিন ‘এ’ নেই, আর ৩৪ শতাংশ তেলে রয়েছে প্রয়োজনের চেয়ে কম মাত্রায়। মাত্র ৭ শতাংশ ড্রামের খোলা তেলে আইন অনুসারে ভিটামিন ‘এ’–এর নির্ধারিত পরিমাণ পাওয়া গেছে। ফলে সাধারণ মানুষ আইনটির সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কর্মশালায় জানানো হয়, নন-ফুড গ্রেড উপকরণে তৈরি ড্রাম দিয়ে ভোজ্যতেল পরিবহন করা হয়-যেগুলো আগে কেমিক্যাল, লুব্রিকেন্ট/মবিল বা অন্যান্য শিল্পপণ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ধরনের ড্রামে সংরক্ষিত খোলা ভোজ্যতেল জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, পাশাপাশি এতে ভেজাল মেশানোর আশঙ্কাও থাকে। এই পুরোনো ড্রামগুলোতে কোনো লেবেল বা উৎস সম্পর্কিত তথ্য না থাকায় তেলের উৎপত্তিস্থল বা সরবরাহকারীকে শনাক্ত করা যায় না। তাই খোলা ড্রামে ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ আইন বাস্তবায়নে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কর্মশালায় জানানো হয়, জুলাই ২০২২ এর পর থেকে ড্রামে খোলা সয়াবিন তেল এবং ডিসেম্বর ২০২২ এর পর থেকে খোলা পাম তেল বাজারজাতকরণ বন্ধে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। তাই নিরাপদ ভোজ্যতেল ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে শিল্প মন্ত্রণালয়, বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।
ভিটামিন ‘এ’-এর ঘাটতি অন্ধত্ব, গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যুসহ নানা শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাব রিকেটস ও হাড় ক্ষয়ের পাশাপাশি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ প্রেক্ষাপটে, ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ একটি সাশ্রয়ী ও কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এতে সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের খাবারের মাধ্যমে সহজেই এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন পেতে পারে।
এছাড়াও কর্মশালায় ভোজ্যতেলে গুণগতমানের প্যাকেজিং নিশ্চিতের উপরও জোর দেওয়া হয়। সাধারণত সূর্যরশ্মিসহ যেকোন আলোর সংস্পর্শে ভিটামিন ‘এ’ নষ্ট হতে থাকে এবং একপর্যায়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ভোজ্যতেল বাজারজাত হয় যেসব বোতলে সেগুলোর অধিকাংশই আলো প্রতিরোধী না হওয়ায় ভোজ্যতেলের গুণগত ও পুষ্টিমান হ্রাস পায়। সে কারণে ভোজ্যতেলের প্যাকেজিংয়ের জন্য আলো প্রতিরোধী অস্বচ্ছ উপাদান ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
কর্মশালায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর-এর কার্যক্রম ও গবেষণাগার বিভাগের পরিচালক (উপসচিব) ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন; ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের কনসালটেন্ট সাবেক অতিরিক্ত সচিব মুশতাক হাসান মুহ. ইফতিখার; ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্টস স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট আবু আহমেদ শামীম; দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর ডেপুটি এডিটর সাজ্জাদুর রহমান এবং প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের।
কর্মশালায় গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা তুলে ধরেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের লার্জ স্কেল ফুড ফর্টিফিকেশন কান্ট্রি এডভোকেসি বাংলাদেশ-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. রীনা রাণী পাল এবং প্রজ্ঞা'র কর্মসূচি প্রধান হাসান শাহরিয়ার।
ঢাকা/হাসান/সাইফ