গেম তৈরির কথা ভাবলেই মনে হয় শক্তিশালী সফটওয়্যার, কম্পিউটার ও অপারেটিং সিস্টেম ছাড়া সম্ভব নয়। তবে গেমিং ব্যবসায় সময় বদলেছে। বদলে যাওয়া এ সময়ে গেমিং জগতের নতুন প্রযুক্তির নাম এইচটিএমএলফাইভ (HTML5) গেম। এ ধরনের গেম মোবাইল, ডেস্কটপ, এমনকি স্মার্ট টিভিতে সহজেই চালানো যায়। ফলে আলাদা কোনো অ্যাপ ইনস্টল না করে সরাসরি ওয়েব ব্রাউজারে গেম খেলা যায়। আর দেশে সেই ধরনের গেম তৈরির কাজটি করছে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান ন্যাপটেক ল্যাবস।

প্রতিষ্ঠার পর এই গেমিং স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানটি সাড়ে ৪ বছরে ৬০০টির বেশি গেম তৈরি ও প্রকাশ করেছে। অনলাইনে ন্যাপটেক ল্যাবসের গেম এখন পর্যন্ত ২ কোটির বেশিবার খেলা হয়েছে। ব্যবসা শুরুর পর থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার বেশি আয় করেছে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে ২০২৪ সালেই ১ কোটি টাকার বেশি আয় করেছে ন্যাপটেক ল্যাবস। চলতি বছর গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ আয় হবে বলে জানিয়েছে স্টার্টআপটির প্রতিষ্ঠাতা ও সহপ্রতিষ্ঠাতা। তবে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ পেলে এ বছরের মধ্যে ব্যবসা পাঁচ গুণ বড় করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।

মূলত গেমিফিকেশন মডেল, গেমিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে আয় অংশীদারত্ব, গেম বিক্রি ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয় করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, ভারত, সাইপ্রাসসহ বিশ্বের ২৪টি দেশে তাদের তৈরি গেম বিক্রি ও গেমিফিকেশন সার্ভিসের মাধ্যমে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বর্তমানে তারা বিশ্বের ১৫টি বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্ক ও ১৮টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে। ফলে বৈশ্বিক পর্যায়ে প্ল্যাটফর্মভিত্তিক রাজস্ব আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে তাদের তৈরি গেমগুলোর।

যেভাবে শুরু 

যখন করোনার থাবায় পুরো দেশ লকডাউনে চলে যায়, তখন ন্যাপটেক ল্যাবসের প্রতিষ্ঠাতা মোসাব্বির হোসাইন তাঁর গেম তৈরির পূর্বাভিজ্ঞতা থেকে একটি স্টার্টআপ চালুর পরিকল্পনা করেন। ২০১৭ সালে স্নাতক পাস করার পর থেকেই তাঁর পরিকল্পনা ছিল নিজেই একটি গেমিং স্টার্টআপ চালু করবেন। তবে আর্থিক সমস্যার কারণে সেটি শুরু করতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। ২০২০ সালে লকডাউনের শুরুতে তিনি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন। এর আগে চাকরির সুবাদে ‘মোবাইল গেম অ্যাপ্লিকেশন’ নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের সময় পরিচয় হয় সুজানা হকের সঙ্গে। পরে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চারজনের একটি দল গঠনের মাধ্যমে কাজ শুরু করে ন্যাপটেক ল্যাবস। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ১৫ জনের বেশি গেম ডেভেলপার, ডিজাইনার, আর্টিস্ট ও বিপণনবিশেষজ্ঞ কাজ করছেন

কী কী রয়েছে এই স্টার্টআপে

‘ন্যাপটেক গেমস’ নামের প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব একটি অনলাইন গেমিং প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, যেখানে রয়েছে ৪০ হাজারের বেশি গেম। মোবাইল, ট্যাব, ডেস্কটপ ও স্মার্ট টিভির মাধ্যমে এই প্ল্যাটফর্মে তাৎক্ষণিকভাবে গেম খেলা যায়। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, এটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ গেমিং পোর্টাল।

ভারতের শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্সের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জিওগেমসেও এখন ন্যাপটেক ল্যাবসের এইচটিএমএলফাইভ গেম রয়েছে। এ ছাড়া দেশে গ্রামীণফোনের জিপি অ্যাপের জোস গেমস, রবির গেম বাক্স ও টেলিটকের ন্যাপটেক্স গেমস নামের গেম টুর্নামেন্ট প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশের ডিজিটাল পেমেন্ট, ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস ও এন্টারপ্রাইজ সলিউশন সেবা দেওয়া প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান এসএসএল ওয়্যারলেসের সঙ্গেও পরিবেশক অংশীদার হিসেবে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া ওয়েবভিত্তিক গেমিং প্ল্যাটফর্ম গেমপিক্স ও গেমজুপেও চাইলে যে কেউ তাদের গেম খেলার সুযোগ রয়েছে।

ন্যাপটেক ল্যাবসের প্রতিষ্ঠাতা মোসাব্বির হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গেমিং প্ল্যাটফর্মে প্রচার হওয়া বিজ্ঞাপন আয়ের ৫২ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর বাকি আয় আসে গেম বিক্রি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারি ব্যবসা থেকে। বর্তমানে ন্যাপটেক ল্যাবস ইনফিনিক্স, টেকনো ও আইটেলের মতো মোবাইল তৈরির চীনা বহুজাতিক কোম্পানি ট্রান্সশন হোল্ডিংসের জন্য বিশেষ ধরনের মিনি গেম তৈরি করছে। এসব গেম চীনা প্রতিষ্ঠানটির মিনি গেম প্ল্যাটফর্ম পাম স্টোর ও আহা গেমসে পাওয়া যাবে, যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াও গেম খেলার সুযোগ রয়েছে।

গেম তৈরির পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রেও কাজ করছে ন্যাপটেক ল্যাবস। অনলাইনে ‘কিডি কিং গেমস’ নামে শিশুদের জন্য গাণিতিক দক্ষতা, যুক্তি, ও ভাষাশিক্ষার সহায়ক শিক্ষাপদ্ধতি গেমের সিরিজ চালু করেছে তারা। মোসাব্বির হোসাইন জানান, এই অনলাইন গেম শিশুদের পড়াশোনাকে আরও মজাদার ও কার্যকর করে তুলছে।

ন্যাপটেক ল্যাবসের সহপ্রতিষ্ঠাতা সুজানা হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি গেম তৈরিতে আমাদের গড়ে ১৫ দিন সময় লাগে। আগামী কয়েক বছরে দেড় হাজারের বেশি গেম তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে থাকবে ক্যাজুয়াল (ধাপে ধাপে খেলা যায়), হাইপার-ক্যাজুয়াল (খুব সহজে খেলা যায়), শিক্ষামূলক গেম ও ব্র্যান্ডেড গেমস।’

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিজনেস টু বিজনেস গবেষণা ও রেটিং প্ল্যাটফর্ম গুড ফার্মস। বৈশ্বিক প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান, সফটওয়্যার কোম্পানি ও সার্ভিস প্রোভাইডারদের কর্মদক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে র্যাঙ্কিং করে প্রতিষ্ঠানটি। গুড ফার্মস ২০২৫ সালে তাদের বিশ্বসেরা গেম ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির তালিকায় ন্যাপটেক ল্যাবসকে ৯ নম্বরে স্থান দিয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে ১ নম্বর গেম কোম্পানি হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে ন্যাপটেক ল্যাবসকে।

স্টার্টআপের বর্তমান অবস্থা

গত বছরের শেষে গুগলের এক্সিলারেটেড গ্রোথ প্রোগ্রাম থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছে ন্যাপটেক ল্যাবস। এই প্রোগ্রামের আওতায় গুগল তিন মাসের জন্য একসঙ্গে কাজ করবে ন্যাপটেকের সঙ্গে। তবে এ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে প্রতিষ্ঠানের বড় বিনিয়োগ লাগে।

ন্যাপটেকের প্রতিষ্ঠাতা মোসাব্বির হোসাইন বলেন, ‘আমরা কয়েকটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করছি। আশা করছি, বড় কোনো বিনিয়োগ পেলে গুগলের এই প্রোগ্রামে আমরা অংশগ্রহণ করতে পারব। এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক গেম ডেভেলপমেন্টে আরও এগিয়ে যেতে চাই। আমাদের লক্ষ্য ভবিষ্যতে ৫০টি দেশে আমাদের গেম বিক্রি ও কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়া।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম স ব ব র হ স ইন প ল য টফর ম ক জ করছ ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

‘আমরার এইতা দিবস-টিবস দিয়া কী অইব’

ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা ২০ মিনিট। মাথার ওপর প্রখর রোদের উত্তাপ। প্রচণ্ড গরমে ত্রাহি অবস্থায় একটু বিশ্রাম নিতে গাছের ছায়ার খোঁজে ক্লান্ত পথিক। এমন সময় ঘর্মাক্ত শরীরে একটি ভবন নির্মাণের কাজ করতে দেখা গেল কয়েকজন শ্রমিককে। তাদের একজন তোঁতা মিয়া, অপরজন হাবিবুল।

হাবিবুল পাথর ভরেই যাচ্ছেন, তোঁতা মিয়া সেগুলো মাথায় করে একের পর এক টুড়ি ছাদ ঢালাইয়ের জন্য পৌঁছে দিচ্ছেন নির্দিষ্ট স্থানে। সেখানেও বালু-পাথরের মিশ্রণ করছেন আরও কয়েকজন। তাদের কর্মযজ্ঞের এক ফাঁকে কথা হয় তোঁতা মিয়ার সঙ্গে।

আলাপকালে তোঁতা মিয়া বলেন, ‘সারাদিন কাম (কাজ) কইরা ৫০০ ট্যাহা (টাকা) হাজিরা পাই। এইডি দিয়া কোনোমতে বউ-পুলাপান নিয়া দিন পার করতাছি। মে দিবস-টিবস কী কইতারতাম না। আমরার মতো গরিব মানুষ কাম না করলে পেডে ভাত জুটতো না এইডাই কইতারবাম।’

গতকাল বুধবার ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণকাজ করার সময় এসব কথা বলেন তোঁতা মিয়া (৪৫)। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার আকুয়া এলাকায়। এ সময় কথা হয় আরেক নির্মাণ শ্রমিক একাদুল মিয়ার সঙ্গে। একাদুলও জানেন না মে দিবস কী। তিনি বলেন, ‘এই কাম কইরা খাইয়া-না খাইয়া বউ-পুলাপান লইয়া কোনোরহমে দিন পার করতাছি। বর্তমান বাজারো জিনিসপাতির দাম বাড়লেও আমরার মজুরি বাড়ে না। পাঁচ বছর আগেও যা পাইতাম, অহনও তাই পাই।’ তিনি বলেন, ‘কয়েক ট্যাহা সঞ্চয় করবাম এই বাও (উপায়) নাই। অসুখ অইয়া চার দিন ঘরে পইড়া থাকলে না খাইয়া থাহন লাগব। আমরার এইতা দিবস-টিবস দিয়া কী অইব?’

আজ বৃহস্পতিবার মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এই দিনটি সারাবিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয় নানা আয়োজনে। কিন্তু যাদের অধিকার আদায়ের জন্য এ দিনটি পালন করা হয়– তারাই জানেন না দিবসটি সম্পর্কে। তাদের আরেকজন দিনমজুর রাজন মিয়া। রাজন জানান, এসব দিবসে তাদের মতো গরিব মানুষের কোনো লাভ-লোকসান নেই। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ