শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দাবি উপেক্ষা করে কালীগঞ্জ উপজেলার শিয়ালখোওয়া বিদ্যালয় মাঠে ফের হাট বসানো হয়েছে। এর আগে মাঠে হাট বসাতে জনমত গঠনে সভা করা হয়। সে সভায় হাটের পক্ষে মত দেন বিএনপি নেতা রোকন উদ্দিন বাবুল। প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস হয়নি কারও।

চলবলা ইউনিয়নের শিয়ালখোওয়া এসসি স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান পাশাপাশি। একটি মাঠ ব্যবহার করে দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। গত বছর মাঠটি দখলমুক্ত করা হয়। মাঠ ঘিরে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও আশপাশে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও তিনটি কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে দেড় হাজারের বেশি ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে। একটি মাঠই তাদের ভরসা। মাঠটি ফের দখল হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সচেতন মানুষ। 

৫০ বছর আগে এ হাটের যাত্রা শুরু। ৭৮ শতক খাস জমির ওপর সপ্তাহে শনি ও বুধবার হাট বসে। এ ছাড়া বাকি পাঁচ দিন বাজার বসে। হাটে লোকসমাগমের কারণে শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হয়ে আসছিল। এ কারণে গত বছরের ১২ মে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন মাঠে হাট বন্ধ করে দেয়। 

এর পর দক্ষিণে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে হাট বসানো হয়। কিছুদিন ধরে শিয়ালখোওয়া মাঠে আবার হাট বসানোর পাঁয়তারা চলছিল। গত ১৩ এপ্রিল হাট দখলের উদ্দেশ্যে ইজারাদার সভার আয়োজন করেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা বিএনপির সহসভাপতি রোকন উদ্দিন বাবুল বিদ্যালয় মাঠে হাট বসানোর পক্ষে মত দেন। এর সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘বিদ্যালয় ও হাট একে অপরের পরিপূরক। হাটের যেমন প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি বিদ্যালয়ের প্রয়োজন আছে। পেটে ভাত না থাকলে শিক্ষা হয় না।’ 

একপর্যায়ে তিনি ইজারাদার হিরু তাঁর সম্মতিতে হাট ডেকেছেন বলে জানান। এ বিষয়ে কথা বলতে রোকন উদ্দিন বাবুলের ফোনে কল দেওয়া হলে বলেন, ‘জরুরি মিটিংয়ে আছি। সাক্ষাতে কথা বলব।’ 

অভিভাবক আবদুল খালেক বলেন, ‘সবার মত উপেক্ষা করে বিদ্যালয় মাঠে হাট বসল। হাট না বসানোর দাবিতে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। কাজ হলো না।’ 

সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বীথি জানায়, সকাল ১০টার পর থেকে বিদ্যালয় মাঠে ক্রেতা ও হাটুরেদের সমাগম শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা অনেক গুণ বেড়ে যায়। 

শিয়ালখোওয়া হাট ও বাজারের ইজারাদার আসাদুল ইসলাম হিরু বলেন, ‘৭৬ লাখ টাকা ইজারামূল্যে হাটের ডাক পেয়েছি। বিভিন্ন জনের সঙ্গে সমন্বয় করে মাঠে হাট বসানো হয়েছে। দুই প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের বলেছি মাঠ পরিচ্ছন্ন ও শিক্ষার পরিবেশ রেখে হাট পরিচালনা করা হবে।’ 

শিয়ালখোওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কী সমন্বয় হবে? আমাদের কথা কে শুনবে? ইউএনও আছেন, তাঁর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।’ 

এস.

সি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মনীন্দ্রনাথ রায় বলেন, গত বুধবার মাঠে হাট বসেছে। বেলা দেড়টার পরে ক্লাস হয়নি। বিদ্যালয় মাঠে হাট বসলে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হবেই। 

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বলেন, বিদ্যালয় মাঠে হাট বসলে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ ক ষ র পর ব শ

এছাড়াও পড়ুন:

সংস্কারের একাল-সেকাল

ওয়ান-ইলেভেনকালে জরুরি অবস্থার গর্ভে জন্ম নেওয়া সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে ‘সংস্কারের জিগির’ তোলা হয়েছিল। সে সংস্কারের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা, যা ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ হিসেবে চিহ্নিত।

দল দুটির যেসব নেতা ওই তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তারা ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হন। এক পর্যায়ে ‘সংস্কারপন্থি’ শব্দটিই রাজনৈতিক গালিতে পরিণত হয়।  

সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। ২০০৭ সালের নিন্দিত ‘সংস্কার’ ২০২৪ সালে এসে নন্দিত ‘সংস্কার’ হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, লন্ডভন্ড নির্বাচন ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে আর যাতে কোনো দল সরকারে গিয়ে আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার ‘প্রয়োজনীয়’ সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায় এবং এ জন্য পর্যাপ্ত সময় ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছে। 

ধারণা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানকে গণমুখী করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী করতে বিধিবিধান পরিবর্তনের মধ্যেই সংস্কার কার্যক্রম সীমিত রাখবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অস্ত্রোপচার করে রাষ্ট্রের আকার-আকৃতি, চেহারা-সুরত পাল্টে দেওয়ার এক মহাযজ্ঞের সূচনা করেছে। গঠন করেছে ছোট-বড় ১১টি সংস্কার কমিশন: সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, পুলিশ, জনপ্রশাসন, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য খাত, শ্রম, নারীবিষয়ক, স্থানীয় সরকার এবং গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। আবার এসব বিষয়ে যাতে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠিত হয় সে জন্য গঠন করা হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’।

সন্দেহ নেই, জাতীয় স্বার্থে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। সাধারণত প্রয়োজনের নিরিখে সে ঐক্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার প্রয়োজনে। এবারও দেশকে আক্ষরিক অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে এমনিতেই জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। সে জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার প্রয়োজন কেন হলো, বোধগম্য নয়।

গঠিত ১১টি কমিশনের বেশ কয়েকটি তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে সরকারের কাছে। সেসব প্রস্তাব নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রস্তাবগুলোর কিছু বিষয়ে সবাই একমত হলেও অধিকাংশ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। বিশেষত একই ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বা একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা না হওয়ার যে প্রস্তাব সংস্কার কমিশন করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এসব সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর হাত-পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার শামিল। কেননা, একটি দল সরকারে গেলে সরকারপ্রধান, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান কে হবেন বা থাকবেন, সেটা সংশ্লিষ্ট দলের গঠনতান্ত্রিক বিষয়। রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশন প্রণীত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ দ্বারা রাজনৈতিক দলগুলো এখন নিয়ন্ত্রিত। নতুন করে রাজনৈতিক বিধিবিধান গণতন্ত্র বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে। 

এদিকে গত ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পেশ করেছে, তা নিয়ে আপত্তি তুলেছে কয়েকটি সংগঠন। ১৫টি মূল বিষয়সহ ৪৩৩টি প্রস্তাবনার একটিতে জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য মোট আসন ৬০০ করে ৩০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। নারীদের জন্য সংসদে আসন সংরক্ষিত রাখার সুপারিশকে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক মনে করছেন অনেকে। কেননা, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিলোপের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনই পরবর্তী সময়ে রূপ নিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে।

এটা বলা অসমীচীন নয়, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্তরে কোটা পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে প্রত্যাখ্যাত কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের সুপারিশ নারী কমিশন কেন করল, বোধগম্য নয়। তা ছাড়া এ ধরনের কোটা নারীদের জন্য অবমাননাকর নয় কি? জাতীয় সংসদে নারীদের কোটায় আবদ্ধ রাখার অর্থ তাদের অনগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করা। অথচ আমাদের দেশের নারীরা এখন রাষ্ট্র ও সমাজের নানা ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম।

মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে আমাদের গ্রামের মাথার বাস স্টপেজকে কেন্দ্র করে একটি ছোট্ট বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে আজিমের চায়ের দোকানে প্রায়ই আড্ডা জমে। ঢাকা থেকে গেলে আমিও অংশীজন হই। সেদিনও সে আড্ডায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছিল। কবে সংস্কার শেষ হবে, কবে নির্বাচন হবে– তা নিয়ে একেকজন তাদের জ্ঞানগর্ভ অভিমত ব্যক্ত করছিলেন। এরই মধ্যে কলেজপড়ুয়া এক কিশোর ফোড়ন কেটে বলল, এর পর হয়তো সরকার ‘জাতিসংঘ সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বলবে, নির্বাচন ওই সংস্কারের পর। ছেলেটির কথায় হাসির ফোয়ারা ছুটল আসরে। কারও কারও কাপ থেকে ছলকে পড়ে গেল কিছুটা চা।

মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক   

সম্পর্কিত নিবন্ধ