যে কারণে ভারতের এ অভিযানের নাম দেওয়া হলো ‘অপারেশন সিঁদুর’
Published: 7th, May 2025 GMT
কাশ্মীরে হামলা নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে মঙ্গলবার গভীর রাতে পাকিস্তানের কয়েকটি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। এসব হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত এবং ৪৫ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে পাকিস্তান।
ভারতের চালানো এ হামলার কোডনেম বা সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’। ভারত বলছে, গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় পর্যটকদের ওপর সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের হামলার জবাবে চালানো হয়েছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ভারতীয় বাহিনী জানিয়েছে, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর অংশ হিসেবে তারা পাকিস্তান এবং পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে মোট ৯টি স্থানে ‘সন্ত্রাসবাদী পরিকাঠামোয়’ হামলা চালিয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, এ হামলায় মূলত নিশানা করা হয়েছে জয়শ-ই-মোহাম্মদ ও লস্কর-ই-তৈয়্যবাকে, যারা কাশ্মীরে সক্রিয় এবং অঞ্চলটি পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত করতে চায়। ভারতের সেনাবাহিনী আলাদাভাবে জানিয়েছে, ‘কোনো পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানা হয়নি’ এবং হামলার লক্ষ্য নির্বাচন ও হামলার পদ্ধতিতে ‘অনেক সংযম দেখানো হয়েছে।’
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে জানায়, অভিযান ‘সিঁদুর’ পাকিস্তানের উদ্দেশে একটি ‘বার্তা’। সিঁদুর হলো হিন্দু বিবাহিত নারীদের সিঁথিতে ব্যবহার করা একধরনের লাল চিহ্ন।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামকরণের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব ও নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষার প্রতি তাদের অটল প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেছে। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামটি পেহেলগামে হামলায় নিহতদের রক্তের প্রতিশোধ এবং জাতির সম্মান রক্ষার প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতীয় নারীদের সিঁদুর মুছে দেওয়ার প্রতিশোধ নিতেই এ নামকরণ করা হয়েছে।
সংবাদ মাধ্যমটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘সিঁদুর’ নামটি শুধু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কঠোর অবস্থানই নয়, বরং জাতীয় গর্ব ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবেও কাজ করছে। এ ছাড়া ‘সিঁদুর’ শব্দটি সিন্ধু নদীর সঙ্গেও সাংস্কৃতিকভাবে সম্পৃক্ত। সিন্ধু নদী ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কিছুদিন ধরেই পারমাণবিক ক্ষমতাধর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছিল, এখন তা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মতো অবস্থায় গড়িয়েছে। পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী বলেন, গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর কোটলি, ভাওয়ালপুর, মুরিদকে, বাগ ও মুজাফফরাবাদে ‘কাপুরুষোচিত’ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে এর বদলা নিতে শুরু করেছে।
পাকিস্তানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত ও ৪৫ জন আহত হওয়ার কথাও জানান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী।
এদিকে ভারত সরকারের এক বিবৃতির বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ভারতের সশস্ত্র বাহিনী ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করেছে। এর আওতায় পাকিস্তান ও পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের ৯টি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে।
যদিও ভারত সরকারের দাবি, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কোনো স্থাপনাকে এ অভিযানে নিশানা করা হয়নি। ভারত–নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে পাকিস্তানি বাহিনীর গোলায় তিনজন হয়েছেন বলে ভারতের সেনাবাহিনী জানিয়েছে।
গত ২২ এপ্রিল ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জনের প্রাণহানির পর থেকে ভারত–পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনার মধ্যে এবার যুদ্ধে জড়াল দেশ দুটি।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
টাঙ্গুয়ার হাওরে ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় হাউসবোট প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য ‘অবশ্য পালনীয়’ ১২টি নির্দেশনা জারির এক দিন পর হাওরের ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় হাউসবোট প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন।
রোববার রাতে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক (রুটিন দায়িত্বরত) মোহাম্মদ রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত এ–সংক্রান্ত একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকা প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি রোধকল্পে হাওরের ওয়াচ টাওয়ার ও আশপাশের এলাকায় পর্যটকবাহী হাউসবোটের যাতায়াত পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। একই সঙ্গে পরিবেশের ক্ষতি হয়, এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্থানে ভ্রমণের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন থেকে আগে জারি করা নির্দেশনা অবশ্যই পালনের অনুরোধ করা হয়। অন্যথায় কঠোরই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়। পর্যটকদের নিয়ে হাউসবোটগুলো প্রথমে হাওরের ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় যায়। এরপর সেখান থেকে টেকেরঘাট এলাকায় গিয়ে বোটেই রাত যাপন করেন পর্যটকেরা।
সংকটাপন্ন এই হাওরের জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি, পরিবেশ ও সৌন্দর্য রক্ষায় পর্যটকদের সচেতন করতে শনিবার জেলা প্রশাসন থেকে ১২টি নির্দেশনা জারি করা হয়। একই দিন বিকেলে হাওরপাড়ে এক মতবিনিময় সভায় টাঙ্গুয়ার হাওরের অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসাসহ পরিবেশবান্ধব পর্যটন নিশ্চিতের দাবি জানান এলাকাবাসী। তাঁরা বলেন, মূল হাওরে ইঞ্জিনচালিত নৌযানের প্রবেশ বন্ধ করতে পারলে সমস্যা অনেক কমে আসবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে হাওরের জয়পুর এলাকায় হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে করণীয় শীর্ষক এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা।
এর আগে গত বুধবার বিপর্যয় থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরকে বাঁচানোর দাবিতে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করা হয় হাওর অঞ্চলবাসীর পক্ষ থেকে। প্রথম আলোতে ১২ জুন ‘অস্তিত্ব সংকটে টাঙ্গুয়ার হাওর: শূন্য হচ্ছে প্রকৃতির ভান্ডার’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুনটাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের মানতে হবে ১২ নির্দেশনা২১ জুন ২০২৫জেলা প্রশাসনের নিদের্শনা
হাওরে পর্যটকদের জন্য ব্যবহৃত নৌযানগুলোকে প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত নৌপথ ব্যবহার করতে হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য লাইফজ্যাকেট ব্যবহার, স্থানীয় গাইড ও পরিষেবা গ্রহণ, প্লাস্টিক পণ্য বর্জন, দূর থেকে পাখি ও প্রাণীর পর্যক্ষেণ করা, ক্যাম্পফায়ার বা আগুন জ্বালানো থেকে বিতরণ থাকতে হবে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়, হাওরে উচ্চশব্দে গান-বাজনা করা বা শোনা যাবে না। হাওরের পানিতে অজৈব বা প্লাস্টিক–জাতীয় পণ্য ও বর্জ্য ফেলা যাবে না। মাছ ধরা, শিকার বা পাখির ডিম সংগ্রহ করা যাবে না। পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে কোনো ধরনের বিঘ্ন ঘটানো যাবে না। ডিজারজেন্ট, শ্যাম্পু বা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা যাবে না। গাছকাটা, গাছের ডাল ভাঙা বা বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা যাবে না। হাওরে সংরক্ষিত (কোর জোন) অংশে প্রবেশ করা যাবে না। মনুষ্যসৃষ্ট বর্জ্য হাওরে ফেলা যাবে না।
জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে
সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে জেলার তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় এ হাওরের অবস্থান। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট। এ হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে ছোট–বড় ১০৯টি বিল আছে। তবে প্রধান বিল ৫৪টি। হাওরের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন হাওর রূপ নেয় সমুদ্রে। হাওর এলাকার ৮৮টি গ্রাম রয়েছে। বর্ষায় এই গ্রামগুলো ছোট ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। হাওরের উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়। এই পাহাড় থেকে ৩৮টি ঝরনা নেমে এসে মিশেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে।
টাঙ্গুয়ার হাওর প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, রূপে-গুণে অনন্য এক জলাভূমি। পর্যটকদের কাছে অতিপ্রিয়। ভরা বর্ষায় সেই রূপ উপচে পড়ে। টাঙ্গুয়ার হাওর ও আশপাশের এলাকা ঘুরে তাই মুগ্ধতা নিয়ে ফেরেন পর্যটকেরা। তাই প্রতিবছর এখানে প্রচুর পর্যটক আসেন। তবে প্রয়োজনীয় তদারকির অভাব, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনসহ নানা কারণে এখন হাওরে প্রাকৃতিক সম্পদ কমছে। এখন আগের মতো গাছ, মাছ ও পাখি নেই। জীববৈচিত্র্য রয়েছে হুমকির মুখে।