কক্সবাজার সৈকতে ঘোড়া, কুকুর ও গরু, স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটুকু
Published: 1st, November 2025 GMT
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী-সুগন্ধা-লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারে সারা বছর পর্যটকের সমাগম লেগে থাকে। পিঠে তুলে পর্যটকদের বালুচর ঘোরানোর জন্য ঘোড়া আছে ৫০টির বেশি। খাবারের সন্ধানে সৈকতে দল বেঁধে বিচরণ করে শত শত বেওয়ারিশ কুকুর। বালুচরে ঘাস না থাকলেও দেখা মেলে অসংখ্য গরুর। পরিবেশ ও প্রাণী বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মানুষ ও পশুর সহাবস্থান জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি লবণাক্ত আবহাওয়া প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকর। বিশেষ করে ঘোড়ার বিষ্ঠা ও মূত্র বালুচর দূষিত করে, যা ভ্রমণে আসা শিশু-কিশোরদের বিপদ ডেকে আনতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক খন্দকার মাহবুব পাশা প্রথম আলোকে বলেন, খাবারের সন্ধানে বেওয়ারিশ কুকুর ও গরু সৈকতে নামে। আর পর্যটকদের পিঠে তুলে ঘোরানোর জন্য ঘোড়া রাখা হয়। প্লাস্টিক, খাবারভর্তি পলিথিন-উচ্ছিষ্ট খায় প্রাণীগুলো। ক্লান্ত ও অভুক্ত ঘোড়া সমুদ্রের লোনাপানি পান করে, গোসলও লোনাপানিতে। ঘোড়া ও কুকুরের মলমূত্র বালুচর ও পানিতে দূষণ ছড়াচ্ছে। ঘোড়ার বিষ্ঠা-মলমূত্র বালুচরে পড়ামাত্র সরিয়ে ফেলতে ঘোড়ামালিকদের নির্দেশনা দেওয়া আছে।
অভুক্ত ঘোড়া
গত শুক্রবার দুপুর ১২টা। সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে রাখা হয় সাতটি ঘোড়া। পর্যটকেরা ঘোড়াগুলো ঘিরে ছবি তুলছেন। একজন নারী তাঁর দুই শিশুসন্তানকে পিঠে তুলে ঘোড়ায় চড়তে দেন। ঘোড়াচালক রহিম দুই শিশুকে বালুচর ঘুরিয়ে দিয়ে আনেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, ঘোড়াকে সমুদ্রের পানিতে নিয়ে গোসল করানো হচ্ছে। এ সময় ঘোড়াটি লোনাপানি খাচ্ছিল।
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কক্সবাজারের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, তিন দশক ধরে সৈকতে ঘোড়ার ব্যবসা চলছে। সাত বছর আগেও ১২০টির মতো ঘোড়া ছিল, এখন আছে ৫০-৬০টি। সারা দিন ঘোড়াগুলো সৈকতে পর্যটক টানে। এ সময় মলমূত্র ত্যাগ করে। পর্যটকের বিচরণক্ষেত্রে ঘোড়ার বিষ্ঠা ও মূত্র স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ায়। ঘোড়ার মলমূত্রে ক্ষতিকারক জীবাণু থাকে। ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ঘোড়াগুলোকে ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হয় না। অসুস্থ ও অভুক্ত থেকে গত পাঁচ বছরে অন্তত ৫০টি ঘোড়ার মৃত্যু হয়েছে। ঘোড়ার বিষ্ঠা সমুদ্রের পানিতে মিশে যায়। সেই পানিতে গোসল করেন হাজার হাজার মানুষ। এক দশক আগে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার সেলিম মো.
কক্সবাজার ঘোড়া মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ নিশান প্রথম আলোকে বলেন, সমিতির আওতায় ৪২ জনের বর্তমানে ৫৫টি ঘোড়া রয়েছে। সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোড়াগুলো সৈকতে পর্যটকদের বিনোদন দেয়। আগে ঘোড়াদের সমুদ্রের লোনাপানি খাওয়ানো হতো। এখন ভুসির সঙ্গে লবণ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। ঘোড়ার বিষ্ঠা-মূত্র যেন বালুচর কিংবা সমুদ্রের পানিতে না ছড়ায়, সে জন্য বালুর নিচে পুঁতে ফেলা হয়। আগে প্রতিবছর অসুস্থ হয়ে ১০-১২টা ঘোড়া মারা যেত। এখন ২-৩টা।
অধিকাংশ ঘোড়া চর্মরোগে আক্রান্ত কেন, জানতে চাইলে আহসান উল্লাহ বলেন, সমুদ্রের লবণাক্ত আবহাওয়াতে ঘোড়ার চর্মরোগ হয়, লোম উঠে যায়। আবার বর্ষাকালে সারা দিন বৃষ্টিতে ভিজে। কিছু মালিক ঘোড়াকে ঠিকমতো খাবার দেন না, এ কারণে কিছু ঘোড়া অপুষ্টিতে ভোগে দুর্বল হয়।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আয়াছুর রহমান বলেন, পর্যটন মৌসুমে যখন সমুদ্রসৈকত লাখো পর্যটকে ভরপুর থাকে, তখন প্রতিটি ঘোড়া থেকে মালিকপক্ষ আয় করে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। আয়রোজগার কমে গেলে ঘোড়াগুলোকে খাবার না দিয়ে রাস্তাঘাটে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন অভুক্ত ঘোড়া লোনাপানি, পলিথিন খেয়ে ফেলে।
ঘোড়াচালকদের বেশির ভাগ শিশু–কিশোর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কিশোর চালক জানায়, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোড়াগুলো সৈকতে পর্যটক টানে, অথচ এ সময়টুকুতে ঘোড়াদের কিছুই খেতে দেওয়া হয় না। সকাল ও সন্ধ্যায় বাড়িতে খাবার খাওয়ানো হয়।
দুর্বল, অসুস্থ বা আঘাতপ্রাপ্ত ঘোড়ার পিঠে চড়া একেবারেই অনুচিত উল্লেখ করে কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, এটি ঘোড়ার প্রতি নিষ্ঠুরতাও বটে। বালুচরের যেখানে ঘোড়ার বিচরণ, সেদিকে হাঁটাচলা কিংবা শিশুদের খেলতে দেওয়া অনুচিত।
সারা দিন ঘোড়া মলমূত্র ত্যাগ করতে থাকে উল্লেখ করে রামু উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. অসীম বরণ সেন প্রথম আলোকে বলেন, ঘোড়াকে প্রচুর খাওয়াতে হয়। ঘোড়ার বিষ্ঠা ও মূত্রতে ক্ষতিকর জীবাণু থাকলেও স্বাস্থ্যগত তেমন ঝুঁকি নেই। কারণ, বিশাল সৈকতে অল্পসংখ্যক ঘোড়া একসঙ্গে থাকে। তবে ঘোড়াকে লোনাপানি খাওয়ানো একেবারে অনুচিত। লোনা আবহাওয়া ঘোড়ার চর্ম রোগ হয়।
বেওয়ারিশ কুকুর ও গরুর বিচরণক্ষেত্র
সৈকতজুড়ে বেওয়ারিশ কুকুরের বিচরণ পর্যটকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। কিছু অভুক্ত কুকুর খাবারের জন্য শিশু-কিশোরদের পিছু নেয়। মাঝেমধ্যে নারী শিশুদের আক্রমণও করে বসে। কুমিল্লার পর্যটক শামসুল হুদা বলেন, কুকুরের কামড় আতঙ্কে শিশুদের বালুচরে ছেড়ে দেওয়া যায় না। কারণ, কুকুর কামড়ালে কিংবা আঁচড় দিলে জলাতঙ্ক ছড়াতে পারে। তা ছাড়া কুকুরের মল সৈকতের বালুকে দূষিত করছে, যা থেকে শিশুদের মধ্যে পরজীবী সংক্রমণ ও চর্মরোগ ছড়াতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লাইফগার্ডের একজন সদস্য বলেন, সকাল ছয়টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শত শত কুকুর সৈকতে পড়ে থাকে এবং খাবারের সন্ধান করে। শীত মৌসুমে কুকুরের দল সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম ও লাল কাঁকড়া খেয়ে ফেলে, যা সৈকতের জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
প্রাণী চিকিৎসকেরা বলেন, কুকুর জলাতঙ্ক ভাইরাসের প্রধান বাহক। বেওয়ারিশ কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে জলাতঙ্ক হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু প্রায় অনিবার্য। পর্যটন এলাকায় শিশুরা এর প্রধান শিকার হতে পারে। কুকুরের মলমূত্র সৈকতের বালুচরে মিশে যায়। তাতে পরজীবী ও ব্যাকটেরিয়া জীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে।
সৈকতে গরুর বিচরণ। সম্প্রতি সুগন্ধা সৈকতেউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত র ব ল চর মলম ত র র ব চরণ পর যটক পর ব শ স কত র সন ধ য র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’
পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে।
যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে।
রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”
তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।
শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’
ঢাকা/শহিদুল/এস