আমরা এখন বাঘের মুখে পড়েছি: মির্জা আব্বাস
Published: 15th, May 2025 GMT
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আজ হুমকির মুখে। একটি কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা আগে ছিলাম কুকুরের মুখে, এখন বাঘের মুখে পড়েছি। আমরা নির্বাচনের কথা বলছি, কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিরাপদ নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন দেওয়ার সরকার, দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সরকার নয়। মিয়ানমারের রাখাইনে করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত সরকার, এই সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিক আপনারা নন।’
বৃহস্পতিবার বিকেলে কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে কুমিল্লা বিভাগীয় বিএনপির সদস্য ফরম নবায়ন ও বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এখনো বিএনপির সুদিন আসেনি উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘অনেকেই ভাবছেন, বিএনপির সুদিন এসে গেছে। তবে এখনো সুদিন আসে নাই। আমাদের নেতা তারেক রহমান এখনো দেশে ফেরেননি; কিংবা ফিরতে পারেন নাই। বিএনপি বর্তমানে অনেক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। কারণ দেশে আগে বিএনপির শত্রু ছিল আওয়ামী লীগ, যাদের সঙ্গে বিএনপিকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এখন দেশে বিএনপির অনেক শত্রু হয়ে গেছে। অনেক দল আজকে বিএনপির শত্রু, তবে বিএনপি কাউকে শত্রু ভাবে না। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, যাঁরা বিএনপিকে শত্রু ভাবেন, কিন্তু বিএনপি আপনাদের শত্রু ভাবে না।’
বিএনপি নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কারণ, বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে। বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির কথা ছড়ানো হচ্ছে। আমি বলতে চাই, বিএনপি কখনো চাঁদাবাজিকে প্রশ্রয় দেয় না। বিএনপির অবস্থান চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে। বিএনপি তো ক্ষমতায় নেই, আমি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানকে বলতে চাই, চাঁদাবাজ যেই হোক তাকে ধরে জেলে পাঠান। কিন্তু আপনার সেই সাহস নেই। কারণ আপনার দল, আপনার সাঙ্গপাঙ্গ যারা আছে, তারাই এখন চাঁদাবাজি করছে। তারাই লুটতরাজ করছে।’
বিএনপির জ্যেষ্ঠ এই নেতা বলেন, ‘আপনারা টিভি, পত্রিকা খুললে দেখবেন, এই সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সময় মিডিয়ার কোনো স্বাধীনতা ছিল না। এই সরকারের সময়ও মিডিয়ার কোনো স্বাধীনতা নেই। মিডিয়ার মধ্যে একটাই কথা শুধু বিএনপি, বিএনপি আর বিএনপি। বিএনপি কী করছে, এটা ছাড়া কারও বিরুদ্ধে কিছু বলা হচ্ছে না। দেশে নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, এ জন্য কেউ নির্বাচনের কথা বলতে চায় না। আমরা নির্বাচনের কথা বললে তাদের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। মনে হয় নির্বাচন শব্দটা যেন কেউ চেনে না। নির্বাচনের কথা বলা যেন পাপ।’
বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র স স ব ধ নত সরক র আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
বউ-শাশুড়ির হাত ধরে আয়ের পথে নারীরা
চারদিকে সবুজ মাঠ। মাঝখানে কর্মমুখর একটি গ্রাম বাহাদুরপুর। কয়েক বছর আগেও গ্রামটির অনেক পরিবারে আর্থিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। নারীদের ঘরে বসে অলস সময় কাটত। দরিদ্র পরিবারের নারীরা আয়ের পথ খুঁজে পাওয়ায় সেই চিত্র এখন অনেকখানিই বদলেছে। এই সুযোগ করে দিয়েছেন সাবিনা বেগম। সবার কাছে তিনি প্রিয় ‘সাবিনা আপা’।
কুটিরশিল্পের ১৬ ধরনের কাজে পটু সাবিনা পরিশ্রম করে শুধু নিজের ভাগ্য বদল করেননি, গ্রামের অনেক দরিদ্র নারীকে নকশার কাজ শিখিয়ে আর্থিক উপার্জনের পথ দেখিয়েছেন। তাঁর সহায়তায় সুই–সুতা দিয়ে কাপড়ে নকশা তুলে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার অন্তত ২০০ নারী দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। সংসারে এনেছেন সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য। প্রায় প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে সাবিনা বেরিয়ে পড়েন। কাজ নিয়ে ছুটে চলেন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বাড়িতে ফেরেন। সেখানে হাতের কাজ শেখান দরিদ্র নারীদের।
স্থানীয় রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মহিলা সদস্য ববিতা বেগম বলেন, বাহাদুরপুর গ্রামে আগে কলহবিবাদ লেগেই ছিল। নারীরাও সব সময় ঝগড়া করতেন। এখন তাঁরা মিলেমিশে নকশা তোলার কাজ করে বাড়তি আয় করছেন। এ অবদান সাবিনার। তাঁর হাত ধরে নারীরা যেভাবে আয় করার পথ খুঁজে পেয়েছেন, অন্য এলাকার নারীরাও তাঁদের দেখে অনুপ্রেরণা পাবেন।
সুই–সুতার সুনিপুণ কারুকাজ
উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাহাদুরপুর গ্রাম। কাঁচা-পাকা সড়ক পেরিয়ে গ্রামে ঢোকার মুখে সবুজ ফসলের মাঠ। মাঠের ওপারের গ্রামের বাড়িগুলোর উঠানে বসে সুই–সুতা দিয়ে কাপড়ে নকশা তোলার কাজে ব্যস্ত নারীরা। গ্রামের বাসিন্দা সাবিনা বেগমের উঠানে দেখা গেল, বড় বড় জমায়েত। ২০–২৫ জন নারী পাটি পেতে বসে নকশা তুলছেন। কারও হাতে শাড়ি, কারও হাতে পাঞ্জাবি, কারও হাতে লেহেঙ্গা। সাধারণ একটি কাপড় সুই–সুতার সুনিপুণ কারুকাজে হয়ে উঠছে অসাধারণ।
সাবিনা বেগমও তাঁদের কাজে সহযোগিতা করছেন। কেউ কোথাও আটকে গেলে কাছে গিয়ে শিখিয়ে দিচ্ছেন। কাজের ফাঁকে উঠানের আমগাছের তলায় বসে নারীদের ভাগ্য বদলের গল্প শোনালেন সাবিনা।
বউয়ের স্বপ্ন, শাশুড়ির সহযোগিতা
সাবিনা বেগম বেড়ে উঠেছেন ঢাকার মিরপুরে। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই বড়। ২০০৪ সালে এইচএসসি পাসের পর ২০০৬ সালে পীরগঞ্জের বাহাদুরপুর গ্রামের মমিনুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তখন দুজনই বেকার। সাবিনার পরামর্শে পীরগঞ্জ বাজারে বইয়ের দোকান দেন মমিনুল। সাবিনা শুরু করেন টিউশনি; কিন্তু গ্রামে নারীদের ওপর অকারণে নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ও পারিবারিক কলহ নাড়া দেয় সাবিনার চিন্তাকে। এরপর গ্রামের নারীদের সবাইকে নিয়ে কিছু একটা করার কথা ভাবেন তিনি।
বিষয়টি শুনে সাবিনার শাশুড়ি মনোয়ারা তাঁকে উৎসাহ দেন। একপর্যায়ে ২০১৭ সালে সাবিনাকে নিয়ে পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী গ্রামে আত্মীয় সাইফুল ইসলামের বাড়িতে যান মনোয়ারা। সেখানে নারীদের নকশার কাজ করে জীবন বদলের চিত্র দেখে সাবিনা মুগ্ধ হন।
শাশুড়ি মনোয়ারার পরামর্শে ২০১৮ সালে সাবিনা পীরগঞ্জ পল্লী উন্নয়ন কার্যালয় থেকে হস্তশিল্পের পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। তিনি সেই প্রশিক্ষণ দেন শাশুড়ি মনোয়ারা বেগমসহ গ্রামের পাঁচ নারীকে। শাশুড়ির গাভি আর ছাগল বিক্রির ৮৫ হাজার টাকায় বাড়ির একটি কক্ষে পুরোদমে সেলাই ও হাতের কাজ শুরু করেন সাবিনা। ধীরে ধীরে কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালে তাঁর বাড়িতে আসেন ঢাকার কাপড় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান। ঢাকায় কয়েকটি কাপড়ের শোরুম আছে তাঁর। তিনি সাবিনাকে ঢাকায় নিয়ে যান। স্থানীয় এজেন্ট মনোনীত করে তাঁর হাতে তুলে দেন শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি–পিস ও কাঁথায় নকশা করার সরঞ্জাম। মান ভালো হওয়ায় বাড়তে থাকে কাজের পরিমাণ। ধীরে ধীরে তিনি গ্রামের অন্য নারীদের যুক্ত করেন এই কাজে।
২৫ জন দিয়ে শুরু
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রামের ২৫ জন দরিদ্র নারীকে নিয়ে সাবিনা গঠন করেন বাহাদুরপুর ব্যাপারীপাড়া কুটিরশিল্প সমিতি। তিনি সমিতির সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশা ও কারচুপির কাজ দেন। সমিতির বাইরে থাকা গ্রামের গৃহবধূরাও তাঁর কাছে ছুটে আসেন কাজ শিখতে। সাবিনা তাঁদেরও প্রশিক্ষণ দেন। বর্তমানে এসব গৃহবধূ দুই শতাধিকে পৌঁছেছে।
কারিগরেরা লেহেঙ্গায় নকশা করার জন্য ৬০০ টাকা, শাড়িতে ৭০০ টাকা, পাঞ্জাবি ও থ্রি–পিসে ৫০০ টাকা করে মজুরি পান। সাবিনা প্রতিটি কাজের জন্য কমিশন পান ৭০ টাকা। এই আয়ের টাকায় আবাদি জমি ও পাকা বাড়ি করেছেন। কিনেছেন মোটরসাইকেল। হাঁস-মুরগি ও গাভি পালন করছেন। গাছপালায় ঘেরা বাড়িতে দুই ছেলে-মেয়ে, স্বামী ও শাশুড়িকে নিয়ে সুখের সংসার তাঁর।
স্বাবলম্বী অন্য নারীরাও
সাবিনা বেগমের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর সুই–সুতার কাজ করে এলাকার অনেক নারী এখন স্বাবলম্বী। তাঁদের কেউ মাসে পাঁচ হাজার, আবার কেউ ৯ হাজার টাকা আয় করছেন। ধুলগাড়ী গ্রামের হাফিজা খাতুন (২৭) তাঁদের মধে৵ একজন। তিনি বলেন, ১৪ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। আগে ভূমিহীন স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। এখন তাঁর আয়ে সংসার চলছে, স্বামীর আয় জমা থাকছে। ৯ শতক জমি কিনেছেন। খড়ের ঘরের জায়াগায় তুলেছেন টিনের ঘর। হাঁস-মুরগি, গরু–ছাগলও পালেন।
কৃষিকাজ করে ছয় সদস্যের সংসার চালাতে কঠিন লড়াই করতে হতো গ্রামের মিজানুর রহমানকে। এখন তাঁর দুই মেয়ে শিল্পী খাতুন ও তামান্না আক্তার নকশার কাজ করে নিজেদের পড়ার খরচ চালিয়েও প্রতি মাসে দুই–তিন হাজার টাকা জোগান দেয় বলে জানালেন তিনি।
গ্রামের বাসিন্দা সানজিদা বেগম জানান, তিন বছর আগে স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। বিষয়টি জানতে পেরে সাবিনা তাঁকে নকশা তোলার প্রশিক্ষণ দেন। এখন মাসে তাঁর আট হাজার টাকা আয় হচ্ছে।
রায়পুর ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন গরিব মেয়েরা সাবিনার কাজে যুক্ত হয়ে অলস সময় কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। অনেকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করায় দিন দিন এর প্রসার ঘটছে।
উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, দরিদ্র নারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন সাবিনা। তাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সহজ শর্তে ঋণও দেওয়া হয়েছে। তিনি নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং অন্যদেরও এগিয়ে নিচ্ছেন।
শ্বশুরবাড়ির লোকজন ইতিবাচকভাবে নেওয়ার কারণে কাজ করা সহজ হয়েছে বলে মনে করেন সাবিনা বেগম। স্বামীর উৎসাহ আর শাশুড়ির সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে সাবিনা বলেন, ‘এখন আমার একটিই স্বপ্ন—নারীদের জীবনে দুঃখ মোচন করা। এ জন্য পীরগঞ্জ সদরে বড় একটি পোশাক কারখানা করব। পুরো উপজেলার নারীদের সংগঠিত করে সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা দেব। তাঁরা সংসারে খরচ জোগাতে অবদান রাখবেন।’