ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবন তিন দিন ধরে অবরুদ্ধ। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে গতকাল শনিবারও হাজার হাজার মানুষ নগর ভবন ঘেরাও করেন। সকালে নগর ভবনের সব ফটকে তালা দিয়ে সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দেন তারা। এ সময় ওই ভবনে থাকা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীও কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি। আন্দোলনকারীরা এ দু’জনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাদের প্রতিহত করার হুঁশিয়ারি দেন। আজ রোববারও নগর ভবন অবরুদ্ধ করবেন বলে জানিয়েছেন তারা।

এ পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে ইশরাক হোসেন বলেছেন, ‘আমাকে মেয়র পদে বসানোর জন্য এটা নগরবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। এই আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততা নেই। আমি নিজেও মেয়র হিসেবে শপথ নিতে প্রস্তুত। তবে সরকার এ নিয়ে গড়িমসি করছে। ঢাকাবাসী এটা মেনে নেবে না।’

২০২০ সালে ডিএসসিসি নির্বাচনে হারলে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী ইশরাক হোসেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। গত ২৭ মার্চ আদালত তাঁকে বিজয়ী ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন (ইসি) গেজেট প্রকাশ করে। এরপর ইশরাকের শপথ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। পরে এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হলে শপথ কার্যক্রম ঝুলে যায়। এ নিয়ে আজ রোববার আদালতে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

২০২০ সালের ২ জুন ডিএসসিসির দ্বিতীয় পর্ষদের প্রথম বোর্ড সভা থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য মেয়র পদে থাকার বিধান রয়েছে। সে হিসাবে আগামী ২ জুন দ্বিতীয় পর্ষদের মেয়াদ শেষ হবে। এ সময়ের মধ্যে শপথ নিতে না পারলে ইশরাকের আর ডিএসসিসির মেয়র হওয়ার সুযোগ থাকবে না। এ জন্যই ইশরাকের ইশারায় তাঁর অনুসারীরা জোর আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বলে চাউর রয়েছে।

তবে এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান সমকালকে বলেন, এরই মধ্যে মেয়র-কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বরখাস্ত মানেই পর্ষদেরও বিলুপ্তি। তবে এখন বিষয়টি চলছে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। ফলে যে ক্ষতিটা হচ্ছে, সেটা নগরবাসীর। কারণ, দিনের পর দিন নগর ভবন অবরুদ্ধ থাকার কারণে নাগরিকরা যে কত ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তা কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। এখন দেখা যাক, আদালত কী রায় দেন।

ইশরাককে মেয়র পদে না বসানোর প্রতিবাদে ‘আমরা ঢাকাবাসী’র ব্যানারে গতকাল সকালেই কয়েক হাজার মানুষ নগর ভবনের সামনে জমায়েত হয়ে সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চ শুরু করেন। লংমার্চটি জিরো পয়েন্ট হয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে শিক্ষা ভবন ঘুরে আবার নগর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। বিক্ষোভকারীরা ‘আসিফের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’, ‘শপথ নিয়ে টালবাহানা, চলবে না চলবে না’, ‘অবিলম্বে ইশরাকের শপথ চাই, দিতে হবে’, ‘জনতার মেয়র ইশরাক ভাই, অন্য কোনো মেয়র নাই’– এমন নানা স্লোগান দিতে থাকেন। সাবেক সিনিয়র সচিব মসিউর রহমানের নেতৃত্বে গত বুধবার থেকে এ আন্দোলন চলছে। গতকাল এ কর্মসূচিতে ডিএসসিসির সাধারণ কর্মচারীরাও একাত্মতা প্রকাশ করেন।

যাত্রাবাড়ী থেকে আসা নাসরিন আক্তার বলেন, ‘ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট পাস হলেও তাঁকে শপথ পড়ানো হচ্ছে না। অবিলম্বে তাঁকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে আমরা সচিবালয় ঘেরাও করতে এসেছি।’ পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘যদি ইশরাককে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া হয়, আমরা রাজপথ ছাড়ব না।’

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা ও সচিব অবাঞ্ছিত
গত ২৬ ডিসেম্বর সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর ২৯ ডিসেম্বর থেকে ডিএসসিসি নগর ভবনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম চলছে। এ ভবনেরই ১৪তলায় বসেন উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়া। গত বুধবার থেকে তিনিও নগর ভবনে ঢুকতে পারছেন না। গতকাল সমাবেশ থেকে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সাবেক সিনিয়র সচিব মশিউর রহমান হুঁশিয়ারি দেন, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই প্রতিহত করা হবে।

অবরুদ্ধ নগর ভবন
গত বুধবার থেকেই নগর ভবন কার্যত অবরুদ্ধ। বৃহস্পতিবার প্রধান ফটকগুলোতে তালা লাগানো হলেও গতকাল সবক’টি ফটকসহ সিঁড়িতে ৬৫টি তালা ঝোলানো হয়। সব লিফট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে কেউই নগর ভবনে ঢুকতে পারেননি। স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও একই অবস্থা। অবশ্য স্থানীয় সরকার বিভাগের কিছু কার্যক্রম চলছে সচিবালয়ের পুরোনো ভবনে। নগর ভবনের কর্মকর্তারা কয়েক দিন ধরে সেখানেই সময় কাটাচ্ছেন। এ ছাড়া ডিএসসিসি নগর ভবনে সংস্থার প্রধান কার্যালয় ছাড়াও দুটি আঞ্চলিক দপ্তরের কার্যক্রম বন্ধ। এ ভবনে থাকা আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রকল্পেরও কেউ ঢুকতে পারছেন না।
ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো.

রাসেল রহমান সমকালকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার থেকেই নগর ভবনের কার্যক্রম মূলত বন্ধ। তাদের আনা-নেওয়ার গাড়িও ভবন থেকে বের হতে পারছে না।’ 

নাগরিক সেবা বিঘ্নিত
এদিকে নগর ভবন অবরুদ্ধের ঘটনায় সিটি করপোরেশনের ১৭ ধরনের নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী, প্রকৌশল, রাজস্ব আর ভান্ডার দপ্তরসহ সব বিভাগীয় দপ্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অন্যান্য আঞ্চলিক ৮টি দপ্তর আর ৭৫টি ওয়ার্ড অফিস। এ ছাড়া নগর ভবনে থাকা অঞ্চল-১ ও অঞ্চল-৪ এর সব সেবাই বন্ধ। দুপুরে জন্মসনদের জন্য রাজধানীর কলতাবাজারের পারভেজ মোশাররফ এসেছিলেন নগর ভবনে। তিনি বলেন, ‘ছেলের পাসপোর্টের জন্য জন্মসনদের প্রয়োজন। এ জন্য নগর ভবনে এসেছিলাম। তবে এসে দেখি গেটে তালা।’

সেগুনবাগিচার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাদিকুল ইসলাম জানান, তাঁর বাসার হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফের জন্য তিনি নগর ভবনে গিয়েছিলেন। এভাবে গত দু’দিন তিনি ফিরে গেছেন।

সরকার ইচ্ছা করে শপথ গ্রহণ দেরি করছে
সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মেয়রের শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা সরকার নানাভাবে কালক্ষেপণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন ইশরাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের পরও শপথ নিতে ইচ্ছা করে দেরি করা হচ্ছে। আমি শপথ নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন আইনি পদক্ষেপ নিয়েই গেজেট প্রকাশ করেছে। তবে গেজেট প্রকাশের ২০ দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত শপথের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যেটা সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় বিভাগের এখতিয়ারে পড়ে।’ 

তিনি বলেন, বলা হচ্ছে, আমরা নাকি অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমি ঘৃণাভরে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা যথাসময়ে এই বিষয়ে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছিলাম। ১৮০ দিনের মধ্যে আপিল করলেও অবৈধভাবে নির্বাচিত মেয়র তাপস সাহেব প্রভাব খাটিয়ে এ বিষয়ে আদালতকে কিছু করতে দেননি। আর তখন আদালতও ছিল ফ্যাসিবাদী সরকারের দখলে।

ডা. শাহাদাতের মতো একইভাবে রায় পেয়েছেন ইশরাক
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল এবং যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ খাইরুল আমীনের আদালত। একই রায়ে চসিক নির্বাচন বাতিল চেয়ে বিএনপি প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের করা মামলায় তাঁকে মেয়র ঘোষণা করেন আদালত। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর আদালত এ রায় দিয়েছিলেন।

ওই সময় বাদীপক্ষের অ্যাডভোকেট আরশাদ হোসেন আসাদ বলেছিলেন, চসিক নির্বাচন বাতিল চেয়ে ডা. শাহাদাত হোসেন মামলা করেছিলেন। বাতিল চেয়ে মামলার পর ওই সময় আমরা আরজি সংশোধনের আবেদন করেছিলাম। তখন আদালত করেনি। ৫ আগস্টের পর আরজি সংশোধনের আবেদন করলে তা মঞ্জুর করেন আদালত। তারপর শুনানি শেষে ডা. শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করে রায় দেন আদালত। 

২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চসিক নির্বাচনে কারচুপি ও ফল বাতিল চেয়ে ডা. শাহাদাত প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইশর ক হ স ন স থ ন য় সরক র গ জ ট প রক শ ইশর ক হ স ন নগর ভবন র ড এসস স র শপথ ন ত উপদ ষ ট অবর দ ধ ইশর ক র র জন য কর ছ ল গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা

মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে প্রায়ই বিজ্ঞান, স্থাপত্য বা শাসনব্যবস্থার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু এর মানবিক দিক অধরা রয়ে যায়। বিশেষ করে দরিদ্রদের প্রতি দয়া ও চিকিৎসাসেবার গল্প আড়ালে রয়ে গেছে সব সময়।

মুসলিম সভ্যতায় কীভাবে দরিদ্র ও অসুস্থদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা, আশ্রয় এবং মানসিক সান্ত্বনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা এক অপূর্ব কাহিনি।

বিমারিস্তান: দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসার আশ্রয়

মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবায় ‘বিমারিস্তান’ নামের হাসপাতাল ছিল একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। এগুলো শুধু চিকিৎসার জায়গা ছিল না, বরং দরিদ্রদের জন্য বিনা মূল্যে আশ্রয়, খাদ্য ও যত্নের ব্যবস্থা ছিল। বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত নগরে, বিশেষ করে বড় রাজধানীগুলোতে বিমারিস্তান ছিল। দামেস্কে বিমারিস্তানের নাম ছিল ‘নুরি’, বাগদাদে ‘আদুদি’।

প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহ.)

প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকের সময়, ৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি এতে চিকিৎসক নিয়োগ করেন এবং তাঁদের বেতনের ব্যবস্থা করেন। সমাজের স্বাস্থ্য রক্ষায় কুষ্ঠরোগীদের জন্য পৃথক স্থানে বিনা মূল্যে খাদ্য ও যত্ন দেওয়া হতো।

অন্ধদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা ও সাহায্যকারী নিয়োগ করা হতো। খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।’ (ইবনে আসাকির, তারিখে দিমাশক, ৪৪/১২৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

আরও পড়ুন“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”০১ অক্টোবর ২০২৫

ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালও ছিল, যা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হতো। দূরবর্তী অঞ্চলে মহামারি মোকাবিলায় ৪০টি উটের কাফেলায় চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হতো।

মিসরে প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় আহমদ ইবন তুলুনের সময়, ৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে, ফুসতাতে। এর নাম ছিল ‘বিমারিস্তান আতিক’।

এর জন্য ওয়াক্‌ফ তহবিল রাখা হয়েছিল, এবং শর্ত ছিল যে এটি শুধু সাধারণ মানুষের জন্য, সৈন্য বা দাসদের জন্য নয়। এর বার্ষিক খরচ ছিল ৬০ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)। ইবন তুলুন নিজে প্রতি সপ্তাহে এটি পরিদর্শন করতেন এবং জুমার দিনে মুসল্লিদের জন্য জরুরি সেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে ছিল ১ লাখের বেশি বইয়ের গ্রন্থাগার। (মাকরিজি, খিতাত, ২/৪০৫, দারু সাদির, কায়রো, ১৮৫৩)

সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবি বিমারিস্তান ‘নাসিরি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে মিসর ও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বিমারিস্তান ছিল মনসুর কালাউনের প্রতিষ্ঠিত বিমারিস্তান, ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। এখানে নারী-পুরুষ সবার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল, চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা ছিল না। এখানে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো।

সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। রাতের দীর্ঘ সময় রোগীদের জন্য কষ্টকর হতো, তাই ফজরের আজান দুই ঘণ্টা আগে দেওয়া হতো, যাতে রোগীরা সকালের আশায় উৎফুল্ল হয়। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।

সুস্থ হওয়ার পর রোগীদের পোশাক ও কিছু টাকা দেওয়া হতো, যাতে তারা তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে না বাধ্য হয়। এই বিমারিস্তান ২০০ জনের বেশি দরিদ্র রোগীকে বাড়িতে চিকিৎসা দিত। (মাকরিজি, খিতাত, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৭)

দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসাগ্রন্থ

মুসলিম সভ্যতার চিকিৎসকেরা লক্ষ করেন, চিকিৎসা কখনো কখনো ধনীদের কাছে ব্যবসায় পরিণত হন। তাই তাঁরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তারা নিজেরা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে বা ছোট চিকিৎসকেরা তাদের সহজে চিকিৎসা দিতে পারেন। এই গ্রন্থগুলোয় স্থানীয় ও সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতো; কারণ, ভারত বা চীন থেকে আমদানি করা ওষুধ ছিল দামি।

আরও পড়ুনইসলামে দারিদ্র্য দূরীকরণের ৮টি ব্যবহারিক উপায়০২ নভেম্বর ২০২৫

আবু বকর আর-রাজি: তিনি দরিদ্রদের প্রতি অসাধারণ দয়া দেখাতেন এবং তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করতেন। তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন: ‘বুরউ সা’আত’ (তাৎক্ষণিক চিকিৎসা) এবং ‘মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব’ (যার কাছে চিকিৎসক নেই), যাকে ‘তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন’ (দরিদ্রদের চিকিৎসা) বলা হয়।

তিনি লিখেছেন, ‘অনেক চিকিৎসক ওষুধ ও খাবারের কথা লেখেন, যা শুধু রাজাদের ভান্ডারে পাওয়া যায়। আমি সাধারণ ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে চিকিৎসার একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লিখতে চাই, যাতে সবাই এর সুবিধা পায়।’ (আল-রাজি, মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব, পৃষ্ঠা ১৫, দারুল কুতুব, বৈরুত, ১৯৮৫)

মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো।

ইবনে জাজ্জার কায়রাওয়ানি: তিনি কখনো দরিদ্রদের কাছ থেকে চিকিৎসার ফি নিতেন না। তিনি তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন গ্রন্থে লিখেছেন, ‘দরিদ্ররা স্বাস্থ্য ও রোগ–সম্পর্কিত বইয়ের সুবিধা পায় না। তাই আমি এমন একটি গ্রন্থ লিখলাম, যাতে সহজলভ্য ওষুধ দিয়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করা যায়।’ (ইবনে জাজ্জার, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ১০, দারুল ফিকর, কায়রো, ১৯৯০)

ইবনে আকফানি: তিনি গুনইয়াতুল লাবিব ফি গাইবাতিত তাবিব (চিকিৎসক না থাকলে জ্ঞানীর সম্পদ) গ্রন্থে জরুরি রোগের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য রক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন।

জামালুদ্দিন ইউসুফ মাকদিসি: তিনি ‘তিব্বুল ফুকারা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ধনীরা সুস্বাদু খাবার খায়, তাই তাদের রোগ বেশি। দরিদ্ররা সাধারণ খাবারে সন্তুষ্ট থাকে, তাই তাদের রোগ কম। কিন্তু দরিদ্ররা অসুস্থ হলে তাদের জন্য সহজ ও সস্তা ওষুধ দরকার।’ (মাকদিসি, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ৮, দারুল মারিফা, বৈরুত, ১৯৯২)

মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো। চিকিৎসকেরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে তারা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে। এই ঐতিহ্য দেখায়, ইসলামি সভ্যতা কেবল জ্ঞান বা শক্তিতে নয়, মানবিকতা ও দয়াতেও শ্রেষ্ঠ ছিল।

আরও পড়ুনআপনার মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিচ্ছেন তো২১ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ