শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত বরাবরই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল—এ দুটি খাতে বরাদ্দ বাড়বে, সংস্কার হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য হলো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ কমছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের এডিপির চেয়ে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে শিক্ষায় বরাদ্দ কমছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। 

বাস্তবতা হলো, এবারও ভিন্নভাবে বাজেট তৈরির চেষ্টাটা দেখা গেল না। বাজেট তৈরির প্রক্রিয়ায় যে গতানুগতিকতা কিংবা আমলাতান্ত্রিকতা আমরা এত দিন দেখে আসছিলাম, সেই ধারাবাহিকতার একটা প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি। 

এটা সত্যি যে অন্তর্বর্তী সরকারকে সম্পদের স্বল্পতার মধ্যে বাজেটটা করতে হচ্ছে। বাজেটের ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষী শব্দটি বহুল ব্যবহৃত একটা শব্দ। উচ্চাভিলাষী বাজেট তৈরি করার মতো সম্পদের বাস্তবতা আমাদের নেই। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে, একটা বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। চব্বিশের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জন-আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রেও বিশাল একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষাটা কিন্তু মূলত বাজেটের আকার বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষা নয়। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হচ্ছে, গুণগত মানের দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেটে একটু ভিন্ন ধরনের উদ্যোগ থাকা। 

বাজেট যাঁরা প্রণয়ন করেছেন, তাঁরা একদিকে ঠিক কাজটাই করেছেন। উচ্চাভিলাষী পথটা তাঁরা পরিহার করেছেন। বাস্তবতার মধ্যে বাজেট তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ কমানো হলো, সেই বার্তাটাও মানুষের মধ্যে যাচ্ছে। 

আমাদের বাজেটে সাধারণত অবকাঠামো খাতগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, সামাজিক খাতগুলোকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। এবারের বাজেটে বরাদ্দের যে বিন্যাস দেখছি, সেটা প্রথাগত ঐতিহ্যেরই প্রতিফলন। শিক্ষা খাতে ৯১টি প্রকল্প ও স্বাস্থ্য খাতের ৩৫টি প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো মূলত অবকাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প। আমরা শিক্ষা বাজেট ও স্বাস্থ্য বাজেট বলি। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় এগুলোকে বলা দরকার শিক্ষা অবকাঠামো বাজেট ও স্বাস্থ্য-অবকাঠামো বাজেট। কেননা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বাজেট আর অবকাঠামো নির্মাণ সমার্থক হয়ে গেছে। বাজেট প্রক্রিয়া প্রণয়নে যাঁরা যুক্ত থাকেন, তাঁদের মধ্যে প্রচণ্ড একটা আগ্রহ থাকে নতুন অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের প্রতি। 

এবারের বাজেটে সম্পদের স্বল্পতা স্বীকার করে নিয়েও জন-আকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রেখে ভিন্ন ধরনের সংকেত দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেটা দরকারও। প্রকল্পের বিন্যাসগুলোকে বদলেই সেটা করা সম্ভব হতো। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের যে অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে, সেই অর্থ অন্য কাজে ব্যয় করার সুযোগ ছিল। যেমন প্রাথমিকে বৃত্তির একটা প্রকল্প আছে। ২০০৪ সালে প্রকল্পটি চালু হয়। মাসে ১০০ টাকা করে দেওয়া হয়। এটার একটা পরীক্ষিত বিতরণ পদ্ধতিও আছে, যেখানে তুলনামূলকভাবে অব্যবস্থাপনাগত অপচয়ও কম। এখানে যদি ১০০ টাকার বদলে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হতো, তাহলে কিন্তু মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ সংকেত দেওয়া যেত। সীমিত সম্পদের মধ্যেও সরকার যে ব্যতিক্রমীভাবে বরাদ্দের বিন্যাসটা সাজানোর চেষ্টা করছে, সেটা মানুষ বুঝতে পারতেন। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। 

তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা যে দুর্বল অবস্থায় আছে, তার অন্যতম কারণ হলো জনবল-ঘাটতি। পদের বিপরীতে প্রায় ৪০ শতাংশ পদ খালি আছে। সেই শূন্য পদে নিয়োগের জন্য যদি আলাদা একটা উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে কিন্তু মানুষের মধ্যে ইতিবাচক একটা সংকেত যেত। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমিয়ে আনাটা একমাত্র সংকেত হতে পারে না। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। 

অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে বাজেট যাঁরা তৈরি করছেন, তাঁদের মধ্যে দুর্নীতি ঠেকানোর চিন্তাটা ক্রিয়াশীল আছে। দুর্নীতি ঠেকানোর একটা পদ্ধতি হিসেবে তাঁরা প্রকল্প কমানোর পথ বেছে নিয়েছেন। এই চিন্তার পেছনে আমাদের নাগরিক সমাজেরও একধরনের দায় আছে। আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রম বা বাজেট সাজানোয় দুর্নীতি কমানোটা অবশ্যই একটা বড় বিষয়।

বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি যদি কমাতে হয়, তাহলে ব্যয় দক্ষতার বিষয়টা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, প্রকল্প নির্বাচনপ্রক্রিয়াটা কতটুকু ভিন্নভাবে তৈরি করা হচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা মাঠ বাস্তবতা ভালো করে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বাজেট বরাদ্দ কমে যাওয়াটা হতাশার বিষয়। অবকাঠামো খাতের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে কতটা বরাদ্দ কমল, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। কিন্তু প্রকল্প বিন্যাসের জায়গায় একধরনের উদ্ভাবনী চিন্তা দেখানোর সুযোগ ছিল। বাজেটের চেয়েও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার ও গভর্ন্যান্স গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে সরকারের মনোযোগের ঘাটতিটা দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে কমিশন করা হলেও শিক্ষা সংস্কারে কমিশন করেনি।

অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দের দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। আবার মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম খরচ করি আমরা। এটা সত্যি, রাতারাতি এ ধারায় পরিবর্তন আসবে না। আমাদের সম্পদ কম। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের শর্তের বাস্তবতাও আছে। সে কারণেই বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে একধরনের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যাচ্ছে। সরকার মূলত সীমিত সম্পদ, দুর্নীতি কমানো ও আইএমএফের চাপে এই রক্ষণশীলতার পথে হাঁটছে। 

দুর্নীতির নানা চেহারা আছে। কিছু চেহারা যেটা আছে, সেটাকে আমরা সরাসরি দুর্নীতি হিসেবে চিনি। যেমন ঘুষ, আর্থিক লেনদেন। কিন্তু কিছু চেহারা আছে, সেটাকে ঠিক দুর্নীতি বলা যাবে না। সেটা হচ্ছে অদক্ষ প্রকল্প নির্বাচন ও ব্যয় দক্ষতার ঘাটতি। এ দুটি বিষয় কিন্তু দুর্নীতির সমগুরুত্বের অথবা তার চেয়েও বড়। 

আসন্ন বাজেটে বরাদ্দ নিয়ে এদিক-সেদিক করার খুব বেশি সুযোগ নেই। তবে দুটি করণীয় সরকারের আছে। প্রথমত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কমানোটাই একমাত্র বার্তা যেন না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া। জন-আকাঙ্ক্ষাকে মাথায় রেখে প্রকল্প বিন্যাসে নতুন কিছু করার যে চেষ্টা করা হয়েছে, বাজেটে তার প্রতিফলন থাকা দরকার।

আমি প্রাথমিক শিক্ষায় বৃত্তি বাড়ানো ও স্বাস্থ্যে জনবল বাড়ানোর দুটি উদাহরণ দিয়েছি। এ রকম কিছু করা গেলে সেটা মানুষের মধ্যে ইতিবাচক বার্তা দেবে। প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবেও এ ধরনের উদ্যোগ থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাজেটের ন্যারেটিভে গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিকতা এবং আইএমএফের বাধ্যবাধকতার বাইরে বেরিয়ে মূল সমস্যাটা সঠিকভাবে অনুধাবন করা গেল কি না, তার একটা উপস্থিতি অবশ্যই থাকতে হবে।

ড.

হোসেন জিল্লুর রহমান বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান

* মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রক র য় প রকল প অবক ঠ ম ব স তবত সরক র র প রণয়ন আম দ র কর ছ ন র একট

এছাড়াও পড়ুন:

অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে

অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বাধা দিতে একটি গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এই আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। আজ সোমবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কার্যালয়ে প্রস্তাবিত অভিন্ন পারিবারিক আইন (ইউএফসি) বিষয়ে তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় তরুণ-তরুণীরা বলেন, ছোট থেকে নারীর প্রতি বৈষম্য দেখে আসছেন তাঁরা। ধর্মীয় বয়ানের মাধ্যমে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বাধা দিতে একটি গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। হিন্দু রীতিনীতি বৈষম্যে পরিপূর্ণ। এসব রীতিনীতি আইন হিসেবে ব্যবহার করতে শেখানো হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে। বিয়ে নিবন্ধন সবার জন্য বাধ্যতামূলক থাকতে হবে। সব ধর্মের ও সব শ্রেণির নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করা হলে তা কল্যাণকর হবে।

সভায় সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ১৯৮৯ সাল থেকে সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রযুক্তির প্রসারের মধ্য নিয়ে নারীর যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তা বাংলাদেশেও হতে হবে। অভিন্ন পারিবারিক আইনের পক্ষে জনমত তৈরি করা সহজ কাজ নয়। এ জন্য সমাজের মধ্যে ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে হবে। তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় ওয়াজে নারীবিদ্বেষী প্রচারণা বন্ধে এবং সমতা প্রতিষ্ঠায় তরুণদের সোচ্চার হতে হবে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীকেই কথা বলতে হবে। সবাই নিজ নিজ স্বার্থ অনুসারে নারীকে ব্যবহার করছে। নারী অধিকার যেন কারও লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

তরুণ–তরুণীদের প্রশ্নের জবাবে সংগঠনের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক দীপ্তি শিকদার বলেন, অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের বিষয়টি ধর্মের দোহাই দিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হয়। এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণের অভাবও লক্ষ করা যায়। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ধারাবাহিকভাবে তৃণমূল থেকে জনমত তৈরির কাজ করছে।

সভায় লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা। তরুণ প্রতিনিধির মধ্যে বক্তব্য দেন শিউলি বিশ্বাস, মুমতাহিনা, রীতা জেসমিন, জারিন চৌধুরী, ফাহমিদা নাজনীন এবং প্রজ্ঞা লাবণী সাদিয়া।

সভা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল কর্মকর্তা সিননোমে মারমা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এনবিআর দুই ভাগ নিয়ে আপত্তি নেই, আপত্তি পদ–পদবি নিয়ে
  • অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে
  • সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলছে: প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান
  • অ্যান্ড্রয়েডে অ্যাপ সাইডলোড করা কি এখন আর নিরাপদ, কী বলছেন ব্যবহারকারীরা
  • রাজস্ব বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখার পরামর্শ টিআইবির