ইউরোপীয় কমিশনের উরসুলা ভন ডার লেন বৈশ্বিক মঞ্চে গভীর পরিবর্তনের এ সময়ে একটি ‘সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ইউরোপ’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার জার্মানির আখেন শহরে আন্তর্জাতিক কার্ল দ্য গ্রেট (শার্লেমেন) পুরস্কার গ্রহণকালে তিনি এ আহ্বান।

পুরস্কার গ্রহণের সময় তিনি একবিংশ শতাব্দীর জন্য একটি ‘নতুন ইউরোপীয় শান্তিব্যবস্থা (প্যাক্স ইউরোপিয়া) গঠনের আহ্বান জানান, যা ইউরোপ নিজেই পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করবে।

আখেনের আন্তর্জাতিক শার্লেমেন পুরস্কার ১৯৫০ সাল থেকে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়ে আসছে, যাঁরা ইউরোপ এবং ইউরোপীয় ঐক্যের জন্য অসাধারণ অবদান রেখেছেন।

ভন ডার লেন বলেন, ‘আমরা যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ওপর একসময় নির্ভর করতাম, তা খুব দ্রুতই বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়েছে।’

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের কারণে যে নিশ্চিত ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, তা ভেঙে গেছে।’ স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে

ভন ডার লেন বলেন, ‘ভেবেছিলাম, শান্তির সুবিধাভোগী হয়ে থাকতে পারব। কিন্তু সেই সময় শেষ হয়ে গেছে। তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, বিশ্ব এখন আবার সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাশা ও যুদ্ধের ছায়ার মধ্যে চলে গেছে।

ইইউ প্রধান বলেন, ‘আমাদের উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিপক্ষরা আবার নিজেদের সজ্জিত করেছে, সংগঠিত হয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্মম ও নিষ্ঠুর যুদ্ধের চেয়ে বড় উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না।’

ভন ডার লেন বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলো শত শত বিলিয়ন ইউরো প্রতিরক্ষা ব্যয়ে বিনিয়োগ করছে, যা সময়ের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আমরা এটি করছি শান্তিকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সর্বোচ্চটা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই দশকে একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। যদি আমরা শুধু এর ফলাফল মেনে নিতে না চাই, তাহলে আমাদেরকেই এই নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’

ভন ডার লেন আরও বলেন, ‘ইতিহাস কখনো দ্বিধা বা বিলম্বকে ক্ষমা করে না। আমাদের মিশন হচ্ছে ইউরোপীয় স্বাধীনতা।’

পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ‘জার্মানি এই শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

ফ্রিডরিখ মের্ৎস বলেন, ‘আমরা শুধু দর্শক হয়ে থাকব না, আমাদের মহাদেশে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানব মর্যাদাকে রক্ষা ও শক্তিশালী করার ব্যাপারে জার্মানি সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।’

জার্মানির চ্যান্সেলর আরও বলেন, ‘আগামী জুনে ন্যাটো সম্মেলনে জার্মানি এমন সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত, যা ইউরোপের নিজস্ব নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে তার অবস্থানকে যথাযথভাবে তুলে ধরবে।’

বার্লিন ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা জিডিপির সাড়ে ৩ শতাংশ প্রতিরক্ষা ব্যয়ে এবং ১.

৫ শতাংশ নিরাপত্তা-সম্পর্কিত অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় বৃদ্ধির পরিকল্পনাকে সমর্থন করে।

এর আগে প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ আন্তর্জাতিক শার্লেমেন পুরস্কার পেয়েছেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস ক র ব যবস থ ইউর প য় ন বল ন আম দ র ন ইউর

এছাড়াও পড়ুন:

টাঙ্গাইলে চলতি মৌসুমে কৃষকের ১০ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা

টাঙ্গাইল সদরের ভাঁটচান্দা গ্রামের প্রান্তিক চাষি আব্দুল কাদের। চলতি মৌসুমে ভাঁটচান্দা মৌজার গভীর নলকূপের আওতায় দুই বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। উৎপাদন মূল্যের চড়া বাজারে টাকার পরিবর্তে সেচ পাম্প মালিকরা ধান নেয়ায় তিনি প্রায় নয় হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

আব্দুল কাদের বলেন, “এই মৌজায় প্রায় ৪৫ বছর যাব ধান চাষ করি। আগে টাকা নিলেও বর্তমানে ধান নিচ্ছে। এত আমরা প্রান্তিক কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ক্ষতি পোষাতে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী টাকা নেওয়ার দাবি করছি।”

শুধু আব্দুল কাদের নয়, ১২টি উপজেলায় ১৮৪টি গভীর নলকূপের বেশির ভাগ প্রান্তিক ধান চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষকরা বলছেন, প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে গভীর নলকূপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে নিয়ম অনুযায়ী টাকা নেওয়ার নিয়ম থাকলেও ধান নেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। টাকা নেওয়ার কথা বললে সেচ পাম্প মালিকরা হুমকি ধামকি দিচ্ছেন। এছাড়াও অনেক কৃষক ভয়ে সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে রাজি হয়নি।

সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, এসব নলকূপের আওতায় চলতি মৌসুমে প্রায় চার হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। এতে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে প্রান্তিক কৃষকদের।

বিএডিসি সূত্রে জানা যায়, প্রান্তিক পর্যায়ে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন খরচ কমাতে অন্তত ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই কিউসেকের ১৮৪টি গভীর নলকূপ বরাদ্দ দেয় বিএডিসি। নলকূপগুলো সমিতির মাধ্যমে পরিচালনা করার কথা থাকলেও বেশির ভাগই প্রভাবশালীদের দখলে। 

নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বিঘায় ১২ থেকে ১৫শ’ টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে সিকি ভাগ হিসেবে ধান নিচ্ছেন। এতে প্রতিবিঘায় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার ধান চলে যাচ্ছে।

সরেজমিন ভাটচান্দা ছাড়াও টাঙ্গাইল শহরের এনায়েতপুর, করটিয়া, দাইন্যাসহ বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গভীর নলকূপগুলো প্রভাবশালীদের দখলে। কৃষকদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করার কথা থাকলেও বেশির ভাগ সেচ পাম্প প্রভাবশালীদের পরিবারের সদস্য দিয়ে কমিটি গঠন করেছেন। এতে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা তেমন কোন উপকার পাচ্ছেন না।

আলিসাকান্দা গ্রামের কৃষক ইয়াকুব আলী বলেন, ‘আমাদের দাইন্যা রামপাল গ্রামে টাকা নেওয়া হয়। তবে আলিসাকান্দায় ধান নেওয়ায় প্রতি বিঘায় আমাদের চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার ক্ষতি হচ্ছে।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক জন কৃষক বলেন, নিয়ম অনুযায়ী টাকা নেয়ার কথা বললে সেচ পাম্প মালিকরা নানা ভাবে হুমকি দিচ্ছে। কৃষি বিভাগ ও বিএডিসির কর্মকর্তারা এসব দেখেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে না।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে রাজি হয়নি অনেক সেচ পাম্পের মালিক। তবে ভাটচান্দা গ্রামের সেচ পাম্প মালিক শামসুল হক বলেন, “নিয়ম অনুযায়ী টাকা নিলে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাই ধান নিচ্ছি।”

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নাজমুস সাদেকীন বলেন, “কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমাতে এবং প্রান্তিক পর্যায়ের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়াতে হবে। অন্যথায় বছরের পর বছর কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেড়ে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে। একসময় তারা ধানসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করা বন্ধ করে দিবে।”

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক তরুণ ইউসুফ বলেন, “বিষয়টি অনৈতিক ও অমানবিক। মানবিকতা ও আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষকদের স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে।”

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আশেক পারভেজ বলেন, “এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

টাঙ্গাইল বিএডিসির (ক্ষুদ্র সেচ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, “প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে নলকূপ দেওয়া হয়েছে। সব জায়গায় টাকা নেওয়ার নিয়ম। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

ঢাকা/কাওছার/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ