গত কিছুদিন নির্বাচন নিয়ে তরুণদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার শুরু হয়েছে। তরুণ নেতারা নাকি নির্বাচনের বিরুদ্ধে! তারা ও ইউনূস সরকার নাকি নির্বাচন চায় না! কী নির্জলা মিথ্যাচার! অথচ সত্যটা হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে সরকারপ্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই সুনির্দিষ্ট একটা সময়সীমা দিয়েছেন। তিনি বহুবার বলেছেন, নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।
সরকারের এই সময়সীমা জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণ নেতারা মেনে নিয়েছেন এই শর্তে যে সরকার শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের বিচার কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করবেন; রাষ্ট্রে যাতে এ ধরনের খুনি শাসক তৈরি হওয়া কঠিন হয়, সে জন্য রাষ্ট্র ও শাসনকাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করবেন এবং নিজেদের প্রতিশ্রুত সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, ইউনূস সরকার একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। এটি সাধারণ কোনো নির্বাচনকালীন সরকার নয়। কেবল জুলাই বিপ্লবের নেতারাই নন, দেশের ক্রিয়াশীল প্রায় সব রাজনৈতিক দল মনে করে এই সরকারের ওপর তিনটি ম্যান্ডেট রয়েছে। এই ম্যান্ডেট সংবিধান অনুযায়ী ‘বৈধ’ নয় বলে শেখ হাসিনার সাগরেদরা দাবি করেন। কিন্তু চব্বিশের রক্তস্নাত রাজপথে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এটিই নতুন সামাজিক চুক্তি।
যাঁরা মনে করেন, হাজারও তরুণের রক্ত মাড়িয়ে মুহাম্মদ ইউনূস শেখ হাসিনার কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে একটা নির্বাচন দিয়ে আরেক শাসকের হাতে ক্ষমতার চাবি চালাচালির জন্য ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন এবং তিনি বিচার ও সংস্কার করবেন না, তাঁরা জুলাইকে ভুলভাবে পাঠ করেছেন। তাঁরা রক্তাক্ত অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের ম্যান্ডেট সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছেন।
কেবল নির্বাচন আদায়ের জন্য বিএনপি তো ১৭ বছর ধরে নিষ্ফলা এক আন্দোলন পরিচালনা করেছে। তারা সফল হলে তিন মাসের একটা নির্বাচনকালীন সরকারই হতো। কিন্তু তারা এ দাবির সপক্ষে যথেষ্ট মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। কারণ, তাদের দাবি আদায়ে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত ছিল না। ফলে তাদের নিজেদের কর্মীদের সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার পরও তাদের এই ‘নির্বাচন চাই’ দাবিটির লড়াই হয়ে পড়েছিল বিএনপির কর্মী, সক্রিয় সমর্থক বনাম শেখ হাসিনার সংগঠন ও খুনে বাহিনীগুলোর।
এ লড়াইয়ে বিএনপি জেতেনি—তাদের এটা মেনে নিতে হবে। বরং শেখ হাসিনা বিএনপিকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছে। তাদের দলের নেতা খালেদা জিয়া, মির্জা ফখরুল ইসলামদের জেলে পুরেছে। খালেদা জিয়াকে বাস্তুচ্যুত করে বুলডোজার দিয়ে তার চার দশকের স্মৃতিময় আবাস গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিএনপিকে পরাজিত সৈনিকের মতো শেখ হাসিনার সাজানো তিনটি ভুয়া নির্বাচন মেনে নিতে হয়েছে।
হ্যাঁ, মানুষ ভোট দিতে না পেরে ক্ষুব্ধ ছিল, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছিল, কিন্তু বিএনপির ডাকে রাস্তায় নেমে তাদের হাতে ক্ষমতার চাবি হস্তান্তরের লড়াইয়ে জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত ছিল না।
বিএনপির অতীত কর্মকাণ্ড, নিজ দলেই গণতন্ত্রের ঘাটতি, জনগণের রাজনীতি না করে কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করা মানুষ পছন্দ করেনি বলে তাদের ডাকে সাধারণ মানুষ এমনকি ভোটাধিকার আদায়ের মতো একটি ন্যায্য দাবির সপক্ষেও সাড়া দেয়নি। বিএনপিকে এই বাস্তবতা বুঝতে হবে, মেনে নিতে হবে।
অপর দিকে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে একঝাঁক তরুণের ডাকে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, এর মধ্যে বিএনপির নেতা–কর্মীরাও ছিলেন। এই লাখ লাখ মানুষ তরুণ নেতাদের আহ্বানে, নেতৃত্বে গুলির সামনে জীবন দিতে দ্বিধা করেনি। কেন? তরুণেরা কি তাদের ‘নির্বাচন চাই’ বলে রাস্তায় আহ্বান করেছিলেন? না। তরুণেরা একটি বৈষম্যহীন সমাজের কথা বলেছেন। তরুণেরা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা সমূলে উৎখাতের কথা বলেছেন। তরুণেরা এসব দাবির সপক্ষে সাধারণ মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পেরেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষ তরুণদের বিশ্বাস করেছেন।
এই তরুণ নেতারা শেখ হাসিনামুক্ত বাংলাদেশের অন্যতম অংশীজন। এই তরুণদের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক শাখা উৎখাত হয়েছে, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা, বন্দোবস্তও উৎখাত হবে।
এখন বাংলাদেশের মুক্ত পরিবেশে কেউ কেউ বলছেন, এই তরুণেরা কোন ছার! বিএনপি সবচেয়ে বড় দল, সুতরাং তাদের কথামতো নির্বাচন হতে হবে তাদের সময়সীমায়। তরুণদের বিচার ও সংস্কারের দাবি হচ্ছে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র! অবিশ্বাস্য!
আমাদের কারোরই অতীত ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কেও সঠিক ধারণা থাকা সহায়ক হবে। এই নতুন বাংলাদেশে তরুণদের সঙ্গে তাদের আত্মত্যাগ, উদ্ভূত দাবিগুলোর প্রতি সম্মান দেখিয়ে নেগোশিয়েট করতে হবে।
তরুণেরা নির্বাচন চান, তবে ‘কেবলই নির্বাচন’ নয়। তরুণদের চাওয়াকে আগ্রাহ্য করলে সবারই বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। তরুণদের দাবিগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল হলে, সেগুলো বাস্তবায়নে তরুণদের সহায়তা করলে ইউনূস সরকার ঘোষিত সময়সীমায় নির্বাচন আদায়ে তরুণেরা আপনাদেরও আগে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
কিন্তু তরুণদের উপেক্ষা করবেন না। ক্ষমতায় না আসতেই তাঁদের ক্ষমতার ভয় দেখাবেন না। যাঁরা গুলির সামনে বুক পেতে দিতে দ্বিধা করেননি, যাঁরা মৃত্যুকে জয় করে এসেছেন, তাঁদের মৃত্যুভয় দেখাবেন না।
তরুণেরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলন করেননি। তাঁদের দল কখনো ক্ষমতা না পেলেও তাঁদের বিশেষ ক্ষতি কিছু হবে না। কারণ, ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়ে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে তাঁরা ঠিকই তাঁদের জায়গা করে নিয়েছেন।
সুতরাং ইতিহাসের কাছে তাঁদের বিশেষ আর কিছু পাওয়ার নেই, কিন্তু দেশকে তাঁদের দেওয়ার আছে অনেক কিছু। দেশেরও এই অসাধারণ তরুণদের কাছ থেকে সাহস, আত্মত্যাগের শিক্ষাসহ নেওয়ার আছে অনেক কিছু। সেই দায় মেটানোর তাগিদেই তরুণেরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো চান। কিন্তু তরুণদের ভয় দেখানোর যে ক্ষমতা আপনাদের নেই, সেই ক্ষমতার ভয় দেখাবেন না।
সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: তর ণ ন ত ব এনপ র ক ষমত র সরক র র সময়স ম র জন ত তর ণ র ভয় দ খ ই তর ণ করব ন ইউন স
এছাড়াও পড়ুন:
অপরাধ আমলে নেওয়ায় দুই বছরের সময়সীমার বিধান প্রশ্নে রুল
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের একটি ধারা প্রশ্নে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। ধারাটিতে অপরাধ আমলে নেওয়ায় দুই বছরের সময়সীমা উল্লেখ রয়েছে। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ রোববার এ রুল দেন।
২০১৭ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনের ১৮ ধারায় অপরাধ আমলে নেওয়ার সময়সীমা সম্পর্কে বলা হয়েছে। ধারাটি বলছে, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার দুই বছরের মধ্যে অভিযোগ করা না হলে আদালত ওই অপরাধ আমলে গ্রহণ করবে না।
ওই ধারার বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান গত মাসের শেষ দিকে রিটটি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে তিনি নিজেই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর মুহাম্মদ আজমী।
রুলে অপরাধের অভিযোগ আমলে নেওয়ায় দুই বছরের সময়সীমা আরোপ–সংক্রান্ত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ১৮ ধারা কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রুলের বিষয়টি জানিয়ে আবেদনকারী আইনজীবী ইশরাত হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষে বলে ইউনিসেফের প্রতিবেদনে এসেছে। আইনের ১৮ ধারায় সময়সীমা উল্লেখ করে দুই বছরের মধ্যে মামলা না করতে পারলে কোনো আদালত অপরাধ আমলে গ্রহণ করতে পারবে না বলা হয়েছে। অর্থাৎ বিচার করতে পারবে না। যে মেয়েটির ১১–১২ বছরে বিয়ে হয় তারপক্ষে দুই বছরের মধ্যে মামলা করা সব সময় সম্ভব না–ও হতে পারে। তখন সে নিজেই শিশু। দুই বছর পর আদালত বিচার করতে পারবে না এবং সময়সীমা আইনে বেঁধে দেওয়া সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী—এমন সব যুক্তিতে রিটটি করা হয়।