বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি প্লাস্টিক দূষণ আজকের দিনে অন্যতম মারাত্মক পরিবেশগত হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘Ending Plastic Pollution’ অর্থাৎ ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’ হওয়াটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। দেশের ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, ভোক্তা সংস্কৃতির প্রসার ও শিল্প খাতের দ্রুত সম্প্রসারণের ফলে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে নদ-নদী, খাল-বিল, কৃষিজমি ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে।
গত দুই দশকে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে প্লাস্টিক ব্যবহার প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০০৫ সালে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ৩ কেজি, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ কেজিতে। রাজধানী ঢাকায় প্রতিবছর গড়ে মাথাপিছু ২২ দশমিক ২৫ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, এই হার জাতীয় গড়ের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। রাজধানীতে প্রতিদিন উৎপাদিত ৬ হাজার ৬৪৬ টন কঠিন বর্জ্যের মধ্যে প্রায় ৬৪৬ টনই প্লাস্টিক, যার একটি অংশ অপরিশোধিত অবস্থায় নালা, খাল কিংবা নদীতে গিয়ে জমে থাকে। ঢাকা থেকে উৎপন্ন প্লাস্টিক বর্জ্যের একটি বড় অংশ বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পৌঁছায়, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় জলাবদ্ধতা, বন্যা ও পানিদূষণ বাড়ছে।
প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ দিক হলো এর অদৃশ্য রূপ—মাইক্রোপ্লাস্টিক। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কেবল প্রাণিজগৎ নয়, মানবদেহের ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। ২০২২ সালে ইতালির এক গবেষণায় সুস্থ মায়ের বুকের দুধে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে। ভেঙে যাওয়া প্লাস্টিকের কণাগুলো মাছ, লবণ, এমনকি পানিতেও মিশে যাচ্ছে, যা মানবদেহে প্রবেশ করে ক্যানসার, হরমোন ভারসাম্যহীনতা ও প্রজনন সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। একইভাবে কৃষিজমিতে জমে থাকা প্লাস্টিক মাটির উর্বরতা হ্রাস করে ও শস্যের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়। প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস শিশু, বৃদ্ধ ও দুর্বল শ্বাসপ্রশ্বাসের রোগীদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এটি শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের প্রদাহ, এমনকি দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসযন্ত্রের রোগও সৃষ্টি করতে পারে। প্লাস্টিক দূষণজনিত রোগের চিকিৎসায় বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, যার পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও প্লাস্টিক দূষণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনের মতো জনপ্রিয় পর্যটন এলাকাগুলোতে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশগত ক্ষতির পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে নষ্ট করছে, যা পর্যটনশিল্পকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। ২০২৪ সালে জাতিসংঘের গ্লোবাল প্লাস্টিক চুক্তির আলোচনায় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য নিষিদ্ধের প্রস্তাব উঠেছে, যা বাংলাদেশের প্লাস্টিকশিল্পের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। যদিও এই চুক্তি এখনো চূড়ান্ত হয়নি, এটি বাংলাদেশের প্লাস্টিক রপ্তানি ও শিল্প খাতের ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এটি বাংলাদেশের জন্য পরিবেশবান্ধব টেকসই শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ হতে পারে।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ সরকার ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে পলিথিন ও পলিপ্রপিলিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে এবং ধাপে ধাপে একবার ব্যবহারযোগ্য অন্যান্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। নীতিগতভাবে এটি প্রশংসনীয় হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক বাধা। বাজারে টেকসই ও সাশ্রয়ী বিকল্পের অনুপস্থিতি, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতা নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি, মূলত আমাদের অসচেতনতা, কালোবাজারি ও দুর্নীতির কারণে।
প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় কেবল আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও টেকসই দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আরও দক্ষ ও কার্যকরভাবে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য হলেও, ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মাত্র ৩৭ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ, পৃথক্করণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণে রয়েছে ঘাটতি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো উচ্চবর্ধনশীল মহানগরগুলোতে উৎসস্থলেই বর্জ্য পৃথক্করণ বাধ্যতামূলক করা এখন জরুরি। একই সঙ্গে ‘স্মার্ট রিসাইক্লিং হাব’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ, বাছাইকরণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এই লক্ষ্য পূরণে সরকারি নীতিনির্ধারণ, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ও নাগরিক সচেতনতা—এ তিনটি স্তরেই সমান্তরালভাবে কাজ করতে হবে। একটি সমন্বিত ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিই পারে বাংলাদেশকে প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে।
জনসচেতনতা গড়ে তোলাও অত্যন্ত জরুরি। প্লাস্টিক দূষণ রোধে স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়া ও রেডিওতে নিয়মিত প্রচারাভিযান চালাতে হবে। মিডিয়ায় পরিবেশবান্ধব বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কর্মশালা, র্যালি ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান আয়োজনের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
প্লাস্টিক দূষণ রোধে পাটজাত পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে। সরকারি ভর্তুকি ও করছাড়ের মাধ্যমে ‘জুটন’ ব্যাগসহ অন্যান্য বায়োডিগ্রেডেবল পণ্য সহজলভ্য করা গেলে তা সাধারণ মানুষের জন্য টেকসই বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে একদিকে যেমন প্লাস্টিকনির্ভরতা কমবে, অন্যদিকে এটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে, বিশেষ করে ইউরোপের বাজারে, যেখানে বায়োডিগ্রেডেবল পণ্যের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে।
প্লাস্টিক দূষণ রোধে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোর ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, ওয়েস্ট কনসার্ন, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন, গ্রিন সেভার্স ও বিডি ক্লিনের মতো পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচ্ছন্নতা অভিযান, রিসাইক্লিং উদ্যোগ, সবুজায়ন ও গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে। এ ধরনের সংগঠনের উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত করতে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস–২০২৫ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্লাস্টিক দূষণ কেবল পরিবেশগত নয়, বরং অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটেও রূপ নিচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের প্রয়োজন সুসংহত কৌশল, শক্তিশালী নীতি এবং সর্বস্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। এখনই সময় এমন একটি বাংলাদেশ গড়ার, যেখানে পরিচ্ছন্নতা, পুনর্ব্যবহার ও পরিবেশবান্ধব জীবনধারাই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষাকবচ।
মুকিত মজুমদার চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ল স ট ক বর জ য র ব যবহ র পর ব শ আম দ র দ ধ কর র জন য সরক র ট কসই
এছাড়াও পড়ুন:
পরিবেশ-প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারে এখনই যা দরকার
খুব সাধারণ চোখে তাকালেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের বাস্তুতন্ত্র কী পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপকূলীয় ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র, নদী-হ্রদ-বিল ও জলাভূমির মতো স্বাদুপানির বাস্তুতন্ত্র, শালবন, চিরসবুজ বন এবং পার্বত্য এলাকার বনভূমি, অর্থাৎ স্থলজ বাস্তুতন্ত্র, পাহাড়ি অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র এবং মনুষ্যসৃষ্ট বাসস্থান, যেমন গ্রাম, শহর ও কৃষিজমি—সবই এখন প্রাকৃতিক পরিবর্তনের চেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে মানুষের আচরণের কারণে।
অতিরিক্ত মাছ ধরা, প্লাস্টিক ও পলিথিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার অভাব, রাসায়নিক ও তেলের দূষণ, বন ধ্বংস, অব্যবস্থাপনায় বনজ সম্পদের অপচয়, পাহাড় কাটা, প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস, গাছ-মাছ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বহিরাগত প্রজাতির আগমন, পর্যটন ও উন্নয়নের নামে ব্যয়বহুল প্রকল্প—এসব মিলেই বাস্তুতন্ত্রে নেতিবাচক পরিবর্তন আসছে। এটি এখন প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবর্তনের চেয়েও ভয়াবহ।
এ ধরনের ক্ষয় ঠেকাতে এখনই শক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি, গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্ষতির ধরন বুঝে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। আমাদের যা হারিয়েছি, তা আর হারাতে দেওয়া যাবে না। এটা হওয়া উচিত জাতিগতভাবে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না বাস্তুতন্ত্রের জীব ও জড় উপাদান একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। শক্তিপ্রবাহ, পুষ্টিচক্র, প্রজাতিগুলোর আন্তসম্পর্ক বাস্তুতন্ত্রকে কার্যকর রাখে। সুতরাং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা না করা মানেই আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের ঝুঁকিতে ফেলা। প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্যনিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার (ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন) একটি কার্যকর পথ। তবে এটি সহজ কিংবা তাৎক্ষণিক কোনো কাজ নয়, এটি সম্পন্ন করতে হলে আমাদের অর্থনীতি, কৃষি, খাদ্যাভ্যাসসহ জীবনযাত্রার নানা দিকেই পরিবর্তন আনতে হবে। এর সৌন্দর্য হলো এটি যেকোনো স্কেলে ঘটতে পারে এবং এতে সবারই ভূমিকা রয়েছে।
পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার মানে শুধুই গাছ লাগানো নয়। আমরা অনেকেই ভাবি, গাছ লাগানো মানেই পরিবেশ বাঁচানো। বাস্তবে শুধু গাছ লাগানোই যথেষ্ট নয়, কী গাছ লাগানো হচ্ছে, সেটা দেশি কি না, কোথায় লাগানো হচ্ছে, গাছের উপযুক্ত যত্ন হচ্ছে কি না—এসব বিবেচনাও গুরুত্বপূর্ণ। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তুতন্ত্র কীভাবে কাজ করে তা বোঝা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
সব সময় একটি পরিবেশকে তার অতীত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বা উচিতও নয়। যেমন আগে যেসব অঞ্চল বনভূমি ছিল, এখন সেগুলোর একটি বড় অংশ কৃষিজমি বা বসতিতে পরিণত হয়েছে। পরিবেশকে বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে, ঠিক যেমন সমাজ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউনেপ) তথ্যমতে, ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে যদি ৩৫ কোটি হেক্টর ভূমি ও জলজ বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা যায়, তবে বিশ্ব প্রায় ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের পরিবেশগত সেবা পেতে পারে এবং ১৩ থেকে ২৬ গিগাটন গ্রিনহাউস গ্যাস কমাতে পারে। এ অর্থনৈতিক লাভ বিনিয়োগের তুলনায় ৯ গুণ বেশি। অন্যদিকে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার ক্ষতি তিন গুণ বেশি।
বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব সব ক্ষেত্রেই—বন, কৃষিজমি, শহর, জলাভূমি ও সাগর পর্যন্ত। উদ্যোগ নিতে পারে সরকার, উন্নয়ন সংস্থা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কমিউনিটি এমনকি ব্যক্তিপর্যায়ের মানুষও। কারণ, ক্ষতির ধরন বহুমাত্রিক এবং এর উৎসও বিভিন্ন। বস্তুত পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার মানে একটি সার্বিক পরিবর্তন—শুধু প্রকৃতির নয়, আমাদের আচরণেরও। এটা রোগনিয়ন্ত্রণ, জীবিকা রক্ষা, দুর্যোগ মোকাবিলা, এমনকি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজিস) অর্জনের সঙ্গেও সরাসরি জড়িত।
জাতিসংঘ ঘোষিত ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের দশক (ইউএন ডকেড অন ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন) আমাদের আহ্বান জানায়, যাতে আমরা ইকোসিস্টেমের, অর্থাৎ পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষয় রোধ করি, ধ্বংস থামাই ও পুনরুদ্ধারে সক্রিয় হই। এত দিন ধরে আমরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ আমাদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পরিবেশ ও প্রতিবেশের যে ক্ষতি করেছি, তা পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বের সব কটি রাষ্ট্র আগামী এক দশক (২০২১-২০৩০) ধরে চেষ্টা করবে। এটি একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক জলবায়ু সমাধান (ন্যাচারাল ক্লাইমেট সলিউশন), যা অভিযোজন ও প্রশমনে সহায়তা করে এবং আমাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই পথ তৈরি করবে।
প্যারিস চুক্তি ও জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার (ন্যাপস) আওতায়, দেশগুলো তাদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানে পরিবেশ পুনরুদ্ধার অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এ ছাড়া আরইডিডি+, অর্থাৎ ‘রেড’ হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বন ধ্বংস ও বন নষ্ট হওয়া থেকে কার্বন নিঃসরণ কমানো। আর ‘+’ চিহ্নটি বোঝায় অতিরিক্ত কিছু বন-সম্পর্কিত কাজ, যেমন বনের ভালোভাবে দেখাশোনা করা, আর বনের কার্বন ধরে রাখা ও বাড়ানো, যেগুলো জলবায়ু রক্ষা করতে সাহায্য করে। ফলে রেড+ এর আওতায় বন সংরক্ষণ ও কার্বন মজুতের উন্নয়ন সম্ভব। তবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থায়ন, যা এখনো সীমিত। এ ক্ষেত্রে ‘ব্লেন্ডেড ফাইন্যান্স’ (সরকারি-বেসরকারি যৌথ অর্থায়ন) নিয়ে আলোচনা হলেও বাস্তবে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে আমরা অনেক সময় ধরে একটা চক্রেই যেন আটকে আছি—পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারের সমস্যার সমাধান শুধু গাছ লাগানোর মধ্যেই যেন আমরা খুঁজে পাচ্ছি! তা–ও বলা বাহুল্য যে যথোপযুক্ত উপায়ে নয়।
যা হোক, আমরা যদি বাস্তুতন্ত্রকে সত্যিকার অর্থে পুনরুদ্ধার করতে চাই, তবে শুধু গাছ লাগানো নয়, পুরো বাস্তুতন্ত্রের প্রেক্ষাপট বুঝে কাজ করতে হবে। সময় খুব কম। এখনই উদ্যোগ না নিলে ক্ষতির মাত্রা এমন জায়গায় পৌঁছাবে, যেখান থেকে ফেরা আর সম্ভব হবে না।
সম্প্রতি জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) সহায়ক সংস্থার ৬২তম অধিবেশনে (এসবি–৬২) অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। জার্মানির বন এ অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে কপ–৩০ (২০২৫) সম্মেলনের আগে অভিযোজন ও অর্থায়ন ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তুলে ধরার ও এ দৃষ্টিকোণও তুলে ধরা সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের অভিজ্ঞতা ও যৌক্তিক দাবিগুলো তুলে ধরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা বললেই চলবে না। এখন দরকার বাস্তবায়ন, অর্থায়ন ও আমূল আচরণগত পরিবর্তন। পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারের ঘোষিত দশকের (২০২১-২০৩০) মধ্যভাগে এসে আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করা উচিত, আমরা কি সত্যিই এগোচ্ছি? পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারকে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে গুরুত্ব না দিই, তাহলে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাব এক অস্থির, বিপন্ন ও অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ।
বিধান চন্দ্র পাল প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রভা অরোরা, ন্যাশনাল অপারেটর, ফাউন্ডেশন ফর এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন (এফইই), বাংলাদেশ এবং চেয়ার, মেইক এ ডিফারেন্স উইক সেলিব্রেশন গ্লোবাল কমিটি, সোসাইটি ফর ইকোলজিক্যাল রেস্টোরেশন (এসইআর)।
[email protected]