জ্যেষ্ঠ নেতাদের বেইমানির কারণে জাতীয় পার্টি সাতবার ভেঙেছে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির নবনিযুক্ত মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি বলেছেন, বিগত দিনেও কিছু সিনিয়র নেতা ও প্রেসিডিয়াম সদস্য জাতীয় পার্টির সঙ্গে বেইমানি করেছিল। এ কারণেই জাতীয় পার্টি সাতবার ভেঙেছে। কিন্তু জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সব সময় পার্টির সঙ্গে ছিল, তৃণমূল নেতা-কর্মীরা কখনোই জাতীয় পার্টির মূলস্রোতের বাইরে যায়নি।

আজ বুধবার দুপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ে দলের ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটির দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শামীম হায়দার পাটোয়ারী এ কথাগুলো বলেন।

এ প্রসঙ্গে শামীম হায়দার পাটোয়ারী গত ২৫ জুন দলের জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সভার কথা উল্লেখ করেন। ওই সভায় এই নেতারা দলের তিন কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মহাসচিব মো.

মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান বলে জাতীয় পার্টির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

এ বিষয়ে শামীম হায়দার পাটোয়ারী আজ বলেন, গত ২৫ জুন জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা ঢাকায় এসে দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের (জি এম কাদের) প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন প্রকাশ করেন। সেদিনই জাতীয় পার্টির আগামী দিনের পথচলার ফয়সালা হয়ে গেছে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের সততা ও স্বচ্ছতা জাজ্বল্যমান—মন্তব্য করে শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, তিনি পাঁচ বছর গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কেউ একটি দুর্নীতির অভিযোগ করতে পারেনি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারকে তিনি কর্তৃত্ববাদী সরকার বলতেন। আওয়ামী লীগ বারবার চেষ্টা করেও জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির মামলা করতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘পল্লিবন্ধু  হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনাপ্রধান ছিলেন, নয় বছর রাষ্ট্রপতি ছিলেন। পল্লিবন্ধু যখন ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন, তখন দেশের মানুষ রাষ্ট্রপতির স্নেহের ছোট ভাই জি এম কাদেরকে চিনতেন না। তিনি নিজ যোগ্যতাবলে বড় বড় পদে চাকরি করেছেন। কখনোই দুর্নীতি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। যতবার জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে, ততবারই তিনি সততার শক্তিতে স্বমহিমায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।’

গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে জি এম কাদের গত সোমবার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হককে প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেন। এর প্রতিক্রিয়ায় গতকাল মঙ্গলবার এই তিন নেতাসহ জাতীয় পার্টির ১৬ জন সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সংবাদ সম্মেলন করেন।

এর উল্লেখ করে শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, গতকাল একটি সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, কাউন্সিলে হেরে যাওয়ার ভয়ে নাকি জি এম কাদের কাউন্সিল করছেন না। কাউন্সিলে কারা থাকবেন? তৃণমূল নেতা-কর্মীরাই তো থাকবেন। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে জি এম কাদেরের পাশে আছেন। কাউন্সিলে জি এম কাদেরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো প্রার্থী কে? নেতা-কর্মীদের পাশে থেকে জাতীয় পার্টিকে আরও এগিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন শামীম হায়দার।

তাঁর এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক মীর আব্দুস সবুর আসুদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, আলমগীর সিকদার লোটন, শেরীফা কাদের, মনিরুল ইসলাম মিলন, মো. মমতাজ উদদীন, মইনুর রাব্বী চৌধুরী, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা নুরুল আজহার, খলিলুর রহমান, মনির উদ্দিন, ভাইস চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন, হুমায়ুন খান, চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি খন্দকার দেলোয়ার জালালী, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল হান্নান, দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় পার্টির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক মো. সামছুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সদস্যসচিব সুলতান আহমেদ সেলিম। এ সময় মহানগর উত্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প র স ড য় ম সদস য এম ক দ র র ক উন স ল ল ইসল ম কর ম র

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ