Prothomalo:
2025-07-30@10:41:52 GMT

বাঘময়না আবিষ্কার

Published: 23rd, July 2025 GMT

গ্রামের নাম বাঘময়না! প্রথম দিন এ কথা শুনে চমকে গেছিলাম। দূর অতীত থেকে একঝলক আলো ও সুগন্ধ এসে আমাকে আনমনা করেছিল। সেই থেকে হঠাৎ হঠাৎ কোনো অলস মুহূর্তে একটা আবেগ আমার বুকে ঘন হয়ে ওঠে। কত কত প্রজন্ম, শত শত বছর আর টলটলা পানির সীমাহীন ধু ধু পৃথিবী চোখের সামনে ভেসে থাকে! তার মধ্যখানে কালো একটা দ্বীপ। ছোট্ট গ্রাম বাঘময়না। তারও আগে হিজল-জারুল-বরুনের ঘন জঙ্গল ছিল আর ছিল সাপ-শিয়াল-মেছোবাঘের রাজত্ব। উজানের পাহাড়ে লাগাতার বৃষ্টি হলে উৎসব ভাতার মতো বন্যার তোড়ে ভেসে আসত ২/১টা টিক্কাপড়া বাঘ কিংবা সাত-আট হাত লম্বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার! 

গ্রামের এই–এই দানব টাইপ পুরুষেরা সড়কি-বল্লম আর বিষবাঁশের লাঠি নিয়ে বাঘের মুখোমুখি হতো। তখন কয়জন পুরুষ ছিল বাঘময়নাতে? ২০-২২টা পরিবার। গ্রামপ্রধান ছিলেন ময়না মিয়া। হাওরে শত শত বিঘা জমি। এই মোটা গোঁফের গোছা, গোল গোল লাল চোখ, গব্দাগাব্দা হাত-পায়ের মানুষটা জোরে ডাক মারলে আশপাশের বিড়াল-কুকুর ভয়ে দৌড় মারত আর সাহস-শক্তিতে তিনি ছিলেন মহাবীর রামচন্দ্র। তাঁর নেতৃত্বেই দিনের বেলায় জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা বাঘকে ঘিরে ফেলা হতো কুড়ি মণ ওজন আর আধমাইল লম্বা দড়ির জাল দিয়ে। দিন-রাত পালা করে চলত পাহারা। এই–এই মরদ একেকজন। বোয়াল মাছের একবোল ভুনা সালুন দিয়ে দুই সের বিরন চালের ভাত কয়েক খাবলায় খেয়ে ফেলত। তাদের মাথার বাবরি, গোঁফের জৌলুশ আর হাঁকডাক শুনে বন্দী বাঘ জালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। তখন সবাইকে পেছনে রেখে লাঠি নিয়ে বাঘের সামনে দাঁড়াতেন ময়না মিয়া।

ভূগোল ও ইতিহাসের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা দেখতে দেখতে বর্তমানের দিকে তাকিয়ে দেখি হাওর নাই; রানি মাছ-আইড় মাছ, বাঁশের মতো মোটা মোটা বাইন মাছ দেখি না কত বছর! ডাহুক-কুড়াপক্ষীরাও বিপন্ন। বিপুল জনসংখ্যার চাপে হাওর এখন বর্ষায় বড় বড় বিল আর শীতে সবুজ মাঠ! সিমেন্টে ঢালাই করা রাস্তা আর বিদ্যুতের তার শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে পড়েছে হাওরের অঙ্গে অঙ্গে। হাওর নামে সুনামগঞ্জে যে বিস্ময়কর ঐশ্বর্য ছিল, আজ লুপ্তপ্রায়! 

দীর্ঘশ্বাস শুনে কানের কাছে ভূগোলের শিক্ষক আমাদের প্রিয় বিমল স্যার যেন পড়াতে শুরু করেন, সৃষ্টির পর থেকেই পৃথিবীর ভূমিক্ষয় শুরু হয়েছে। নদী ভরাট হতে হতে নালা আর পর্বত গলতে গলতে টিলা এবং আধুনিক সভ্যতা সেই ধ্বংস কিংবা রূপান্তরকে করছে শুধু বেগবান। ক্ষয়-ধ্বংস-বিলয় ও সৃষ্টি রহস্যময়ী প্রকৃতির ধর্ম।

একদিন রানিগঞ্জের বাউল সাবুল শাহর কাছে কথাটা বললাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাঘময়না দেখতে যাইবেন?’

‘হ;’ বলে আমি উৎসাহের চোখে বাউলের দিকে তাকাই।

‘আজকু মাছ মারা নাই, তাইলে চলুক্কা.

.. অই দিকে তিন মাইল দূরায় বাঘময়না।’ বাউল ভাই কুশিয়ারা নদীর ওপরের সেতু থেকে পশ্চিম দিকে হাত তুলে আমাকে দেখান। আমি শুধু দেখতে পাই মাইলের পর মাইল কালচে সবুজ গ্রাম। তাদের সবার মাথার ওপর চেপে বসে আছে মুঠোফোনের দুই-তিনটা আকাশসমান টাওয়ার।

মাত্র চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ! আমরা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে হাঁটতে শুরু করি। রাস্তার দুই পাশেই হাওরের পানি, কচুরিপানা, হঠাৎ হঠাৎ বাড়িঘর, ঝোপঝাড়, খাল-ডোবা... হাঁটুপানিতে শিশুরা মাছ ধরছে। মাথার ওপর আষাঢ়ের মেঘ-রোদের ছলচাতুরি। বাতাসে পানি-সাপ-ব্যাঙ আর কলমিপাতার গন্ধ! মনে আজব ভাব। মাঝেমধ্যে আষাঢ় মাসের আমছি (কুয়াশার মতো মিহি বৃষ্টি) আসে। আমরা পাত্তা দিই না। আঁকাবাঁকা পাকা পথ। হঠাৎ হঠাৎ ইজিবাইক শাঁ করে আমাদের পেছনে ফেলে বাঘময়নার দিকে ছুটে যায়। জিনস প্যান্ট আর গেঞ্জি গায়ে কালো কালো পোলাপান আনাগোনা করে। কেউ কেউ হাঁ করে আমার গোঁফের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরস্পর কানাকানি করে। আমি উপভোগ করি।

অধিকাংশই টিনশেড দালান। আম-জাম, হিজল-জারুল আর ইউক্যালিপ্টাসে ছাওয়া ছোট ছোট পাড়া, বাড়ির আশপাশে নোংরা–আবর্জনা, পলিথিন-প্লাস্টিকের জঞ্জাল পানিতে ভাসছে। এই সবের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ গোতুম মাছের মতো চকচকে কালো চামড়ার এক-দুইজন কালো শশী চোখে পড়ে। হাওরদেশে ফরসা মানুষ বিরল। রঙিন সালোয়ার-কামিজ, বাহারি ওড়না, ছোট-বড় সবার হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। হাওর কই?

তবু নিঃস্ব-গরিবের মতো খাবলা খাবলা হাওর দূর থেকে আমাদের দিকে এতিম এতিম চোখে তাকিয়ে থাকে। আমি নাম জিজ্ঞাসা করি। বাউল বলেন, ‘মই হাওর।’

‘এর অর্থ কী?’ আমি বাউল ভাইয়ের কাছে জানতে চাই।

‘এর মানে খালা। খালা হাওর!’ সাবুল শাহ বলেন।

প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া খালা হাওরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলি, তাই সে এত ছোট!

হাওরের নাম ও অর্থ জেনে মনটা আমার শান্তিতে জুড়িয়ে যায় আর শ্রদ্ধায় ঝুকে পড়ে আমাদের প্রাচীন পিতাদের দিকে। তাঁদের সমাজপতিরা কত গভীর হৃদয় আর সুন্দর চিন্তার মানুষ ছিলেন। তাই তো হাওরের নাম রেখেছেন মায়ের বোন খালা!

সামনে পড়ে আরেকটা গ্রাম। একই দৃশ্য। তাই আমরা ডানে-বাঁয়ে তাকাই না। সোজা সামনের দিকে নজর রেখে হাঁটি আর টুকটাক বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে আবার একটা হাওরে এসে পড়ি। আকৃতি-প্রকৃতিতে সে এখনো শ্রদ্ধাজাগানিয়া। পড়ন্ত বিকেলের রোদে সাদা চকচকে পানি। জোরালো বাতাসে ঢেউ ফুঁসছে। দূরের গ্রামগুলো নারীর চোখের ভ্রুভঙ্গির মতো বাঁক-খাওয়া কালো। হাওয়ায় গতর ভাসিয়ে উড়ছে কিছু কিছু পাখি। পানির আঁশটে গন্ধে মন কেমন কেমন করে। আমি মনে মনে লম্বা লম্বা গলাওয়ালা সারসের ঝাঁক, বুকসাদা খয়েরি রঙের কালিম পাখি তালাশ করি। কিন্তু চোখে পড়ে শুধু কানিবগ!

বাউল ভাইকে হাওরের নাম জিজ্ঞাসা করি। তিনি একটু হেসে বলেন, ‘পেলপোড়া হাওর।’

‘পেলপোড়া মানে?’ আমি অবাক গলায় জানতে চাই।

‘অনেক বছর আগের কতা...’ সাবুল শাহ বলতে শুরু করেন, ‘বোরখেতে কাম করার পরে কিছু মানুষ শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমনের শুকনা নাড়ায় আগুন দিল। আগুন পোহাইতে পোহাইতে এক ব্যাডার অন্ডকোষ পুইড়া গেল। সেই থাইকা এর নাম পেলপোড়া হাওর।’

চেয়ে দেখি, বাউল ভাই নির্বিকার। তাই আমি হেসে উঠতে গিয়েও চেপে যাই।

‘আগের দিনের পুরুষ মানুষরা আছিন সাহসী, শক্তিধর আর হাওরের বাতাসের মতন একরুখা।’ আমার মনের ভাব বুঝে সাবুল ভাই এই সব বলতে থাকেন।

আমরা হাঁটতেই থাকি। সেই-ই একই দৃশ্য! হৃদয় কী দেখতে চায় আর চোখ কী দেখায়! খালের ঘোলা পানিতে হাঁসেরা প্যাঁকপ্যাঁক করছে। একজন ঠেলা জাল দিয়ে পাশের খেতের হাঁটুপানিতে মাছ ধরছে। মাছ দেখার জন্য আমি রাস্তার পাশে দাঁড়াই। লোকটা জাল তুলে তন্ন তন্ন করে মাছ খোঁজে, তিঁতপুঁটি, দুধের শিশুর মতো ছোট ছোট টাকি মাছ, গোতুম মাছের পোনা ধরা পড়তে দেখে আমার দুঃখ লাগে।

আমার মন বুঝে বাউল ভাই মরমি গলায় বলতে থাকেন, ‘হেই-ই বাঘময়না কি আছে? কুশিয়ারা গাঙ্গেই খায়ালাইছে অর্ধেকটা। তারপরে ধরেন, মানুষ বাড়ছে, গ্রাম বাড়ছে... এইভাবে বাঘময়নারে ঘিরে পরত পরত আরও পাঁচ-ছয়টা গেরাম পত্তন হইছে।’

আমার উৎসাহ একেবারে মরে যায়। যেখানে কুশিয়ারা নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে, তার পাশে একটা বুড়ো জারুলগাছের নিচে আমরা বসে পড়ি। নদীর পার এদিকে ভাঙছেই। ওপারে জেগে ওঠা নতুন চরের পানিতে কয়েকটা বক সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতীক্ষা! তিতিক্ষা! নিষ্ঠাবান তাপসদের সামনে দিয়ে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছেন আজব এক গুরু। কেউ দেখে না, কেউ বুঝতে চায় না।

‘সেই-ই ডাকাইত–ডাকাইত পুরুষ নাই, বাঘময়নাও নাই।’

বাউল ভাইয়ের ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস আমার কানে লাগে। আমি সময়ের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকি আর যেন একটু একটু শুনতে পাই, পেলপোড়া হাওরের দিক থেকে ছুটে আসা বাতাসের সাথে রেশম–রেশম কান্নার মতো কিছু একটা বুঝি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে!

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব উল ভ ই আম দ র হ ওর র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

তারাকান্দা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চকচকে ভবনে সেবা চলে খুঁড়িয়ে

চারতলার চকচকে নতুন একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সামনে ফুলের বাগান, পাকা সড়ক। চমৎকার এক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হলেও এখানে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না মানুষ। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে আংশিক সেবা চালু হলেও প্রয়োজনীয় জনবলকাঠামোই অনুমোদন হয়নি। এর মধ্যেই চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। এটি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র।

সরেজমিনে এক দিন

২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তারাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স উদ্বোধন করা হয়। জরুরি ও বর্হিবিভাগ চালু হলেও এখনো আন্তবিভাগের সেবা চালু হয়নি। ২১ জুলাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে গেলে সেবা নিতে আসা কাজিউল ইসলাম নামের একজন বলেন, এখানে চিকিৎসাব্যবস্থা আরও উন্নত হওয়া দরকার। জটিল সমস্যা হলে ময়মনসিংহে যেতে হয়, এখানে যেন সেসব ব্যবস্থা করা হয়।

আরেক রোগী মুকুল খান বলেন, ‘সকাল ৯টায় আসলেও ১ ঘণ্টা বইয়া আছিলাম। পরে ডাক্তার আইলে দেইখ্যা ওষুধ দিছে।’ ১০টা ১১ মিনিটে চিকিৎসক দেখিয়ে বের হচ্ছিলেন বানিহালা গ্রামের আবু বক্কর সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ছোটখাটো ওষুখের সেবা পাই। বড় ধরনের অসুখের সেবা নেই। ডাক্তার নেই। রোগী ভর্তি চলে না। কোনো সিট নেই। আমরা যদি পূর্ণ সেবা না পাই, তাহলে হাসপাতাল করা না–করা তো একই কথা।’

রোগীরা কিছু সাধারণ সেবা পেলেও ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ভর্তির জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেলে যেতে হয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তারাকান্দা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চকচকে ভবনে সেবা চলে খুঁড়িয়ে