ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠন করার একটি প্রচেষ্টার কথা তখন রাজনৈতিক মহলে আলোচিত ছিল। বৃহস্পতিবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের এক ফেসবুক পোস্ট সেটা নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি করল।

নাহিদ ইসলাম বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) দুপুর ১২টা ১১ মিনিটে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে বলেছেন, ‘বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল সম্প্রতি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জাতীয় সরকারের কোনো প্রস্তাবনা ছাত্রদের পক্ষ থেকে তাদের দেওয়া হয় নাই। তারা অন্য মাধ্যমে এ প্রস্তাবনা পেয়েছিল। এই বক্তব্যটি সত্য নয়। ৫ আগস্ট রাতের প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছিলাম, আমরা অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার করতে চাই। সেই প্রেস ব্রিফিংয়ের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আমাদের ভার্চ্যুয়াল মিটিং হয়। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার ও নতুন সংবিধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তারেক রহমান এ প্রস্তাবে সম্মত হননি এবং নাগরিক সমাজের সদস্যদের দিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাজেশন দেন। আমরা ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের কথা বলি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে।’ নাহিদ পোস্টে আরও বলেন, ‘৭ আগস্ট ভোরবেলা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বাসায় আমরা উনার সাথে অন্তর্বর্তী সরকার ও উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে আলোচনা করি। উপদেষ্টা পরিষদ শপথ নেবার আগে তারেক রহমানের সাথে আরেকটি মিটিংয়ের প্রস্তাবিত উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নিয়ে আলোচনা/পর্যালোচনা হয়।’

নাহিদের এই বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাহিদ ইসলাম যে দাবি করেছেন, সেটা ঠিক নয়। বললেই তো হবে না। জাতীয় সরকারের ব্যাপারে আমাদের দল থেকে কোনো কথা বলা হয়নি। তারেক রহমান সাহেবের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছে কি না, সেটা আমরা জানি না।’

নাহিদ যে সাক্ষাৎকারের কথা তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের সেই সাক্ষাৎকার গত ২৬ জুলাই প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়। তাতে মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, ‘(বৈষম্যবিরোধী) ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ওই ৫ আগস্টের পর, জাস্ট ওই দিনই বা তার পরের দিন আমাদের কোনো দেখাই হয়নি। জাতীয় সরকার তৈরি করার প্রস্তাবটা ছাত্রদের কাছ থেকে আসেনি, অন্য মহল থেকে আসতে পারে। কিন্তু ছাত্রদের কাছ থেকে এই প্রস্তাব আসেনি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ওই দিন রাতে এক নম্বর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বেসরকারি টেলিভিশন ‘চ্যানেল ২৪’-এর মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য দেন। এটাকেই নাহিদ প্রেস ব্রিফিং বলে উল্লেখ করেছেন।

 শিবির নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তাঁর এই ফেসবুক পোস্টে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা মো. আবু সাদিক কায়েমেরও সমালোচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘শিবির নেতা সাদিক কায়েম সম্প্রতি একটা টক শোতে বলেছেন, ছাত্রশক্তির গঠনপ্রক্রিয়ায় শিবির যুক্ত ছিল, শিবিরের ইনস্ট্রাকশনে আমরা কাজ করতাম। এটা মিথ্যাচার।’

নাহিদের ভাষ্য, ‘গুরুবার আড্ডা’ পাঠচক্রের সঙ্গে জড়িত একটা অংশ এবং ঢাবি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে পদত্যাগ করা একটা অংশ মিলে ছাত্রশক্তি গঠিত হয়। সঙ্গে জাবির (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) একটা স্টাডি সার্কেলও যুক্ত হয়। একটা নতুন ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুবার আড্ডা পাঠচক্রে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা হয়েছে। এরপর নাহিদ লেখেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসে আট বছর রাজনীতি করেছি। ফলে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব সংগঠন ও নেতৃত্বকে আমরা চিনতাম এবং সব পক্ষের সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল। সেই কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। যোগাযোগ, সম্পর্ক বা কখনো সহযোগিতা করা মানে এই নয় যে তারা আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল।’

প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির সমন্বয়কদের অধিকাংশ ছিলেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামের একটি ছাত্রসংগঠনের নেতা। নাহিদ সেই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব ছিলেন। ছাত্রশক্তির উদ্যোক্তারা প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সমমনা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা, মতবিনিময় বা আড্ডার আয়োজন করতেন। সেটাকে তাঁরা ‘গুরুবার আড্ডা’ নাম দিয়েছিলেন।

নাহিদ তাঁর ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ‘সাদিক কায়েম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিলেন না। কিন্তু ৫ আগস্ট (২০২৪) থেকে এই পরিচয় ব্যবহার করেছেন সাদিক কায়েম। অভ্যুত্থানে ছাত্রশিবিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে সাদিক কায়েমকে সংবাদ সম্মেলনে বসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সাদিক কায়েমরা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ঢালাও প্রচার করেছেন যে এই অভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরই নেতৃত্ব দিয়েছে; আমরা সামনে শুধু পোস্টার ছিলাম। অভ্যুত্থানে শিবিরের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করেনি, কিন্তু এই অভ্যুত্থান শিবিরের একক নয়, শিবিরের ইনস্ট্রাকশন বা ডিরেকশনেও হয়নি। আমরা সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেই সিদ্ধান্ত নিতাম।’

নাহিদের এমন বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে শিবিরের নেতা সাদিক কায়েম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নীতিনির্ধারণ, মাঠপর্যায়ে সমন্বয়সহ বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মাহফুজ আলম (বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা), নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদদের (সরকারের উপদেষ্টা) সঙ্গে আমাদের আলাপ হতো। সমন্বয়ক তালিকা যখন তৈরি করা হয়, তখন এটা নিয়েও মাহফুজের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়। এরপর ১৯ জুলাই থেকে ১ আগস্ট (২০২৪) পর্যন্ত প্রথম সারির সমন্বয়কদের অনুপস্থিতিতে কর্মসূচি প্রণয়ন, তা গণমাধ্যমে পৌঁছানো, সমন্বয়কদের সেইফ হোমে রাখার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছি।’

সাদিক কায়েম দাবি করেন, সে সময় সম্ভাব্য সব অংশীজন, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি যোগাযোগ রেখেছিলেন। তাঁর মতে, নাহিদ ইসলাম এসব কথাবার্তা বলে নিজেই নিজের ক্ষতি করছেন।

 ২ আগস্ট রাতে সমন্বয়কদের চাপ সৃষ্টি

একই ফেসবুক পোস্টে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ের এমন একটি বিষয় সামনে এনেছেন, যা এর আগে শোনা যায়নি। নাহিদ লিখেছেন, ‘২ আগস্ট (২০২৪) রাতে জুলকারনাইন সায়েররা (প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান) একটা আর্মি ক্যু করে সামরিক বাহিনীর একটি অংশের হাতে ক্ষমতা দিতে চেয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্যে কথিত সেইফ হাউসে থাকা ছাত্র সমন্বয়কদের চাপ প্রয়োগ করা হয়, থ্রেট করা হয়, যাতে সেই রাতে ফেসবুকে তাঁরা সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করেন; আমাদের সঙ্গে যাতে আর কোনো যোগাযোগ না রাখেন। রিফাতদের (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান সভাপতি রিফাত রশিদ) বিভিন্ন লেখায় এ বিষয়ে বলা হয়েছে। আমাদের বক্তব্য ছিল এক দফার ঘোষণা মাঠ থেকে, জনগণের মধ্য থেকে দিতে হবে। আর যারা এভাবে চাপ প্রয়োগ করছে, তাদের উদ্দেশ্য সন্দেহজনক।’

নাহিদ আরও লেখেন, তাঁদের ভেতর প্রথম থেকে এটা স্পষ্ট ছিল যে ক্ষমতা কোনোভাবে সেনাবাহিনী বা সেনাবাহিনী-সমর্থিত কোনো পক্ষের কাছে দেওয়া যাবে না। এতে আরেকটা এক-এগারো হবে, আওয়ামী লীগ ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হবে এবং দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এটিকে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থান হিসেবে সফল করতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সামনে এগোতে হবে। ৫ আগস্ট থেকে তাঁরা এ অবস্থান ব্যক্ত করে গিয়েছেন।

 জুলকারনাইন সায়েররা ৫ আগস্টের পর বারবার তাঁদের বিরুদ্ধে পাল্টা নেতৃত্ব দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন বলেও অভিযোগ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি লিখেছেন, ‘সে ক্ষেত্রে সাদিক কায়েমদের ব্যবহার করেছে এবং তারা ব্যবহৃতও হয়েছে। সায়েরদের এ চেষ্টা অব্যাহত আছে। কলরেকর্ড ফাঁস, সার্ভেইলেন্স (নজরদারি), চরিত্রহনন, অপপ্রচার, প্রোপাগান্ডা—হেন কোনো কাজ নেই, যা হচ্ছে না। বাংলাদেশে সিটিং মন্ত্রীদের (বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের) বিরুদ্ধে যত অপপ্রচার হচ্ছে, এ দেশের ইতিহাসে এ রকম কখনো হয়েছে কি না, জানা নেই। কিন্তু মিথ্যার ওপর দিয়ে বেশি দিন টেকা যায় না, এরাও টিকবে না।’

ফেসবুকে নাহিদের অভিযোগের বিষয়ে জুলকারনাইন সায়ের বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন অভিযোগ শোনা সত্যিই হাস্যকর। এই বক্তব্যটি শুধু মিথ্যা ও ভিত্তিহীনই নয়, বরং এটি ছিল তাদের নিয়মিতভাবে মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশিত অপকর্মগুলো থেকে জনদৃষ্টি সরানোর একটি সস্তা চেষ্টা। এমন ভিত্তিহীন অভিযোগের জবাব দেওয়া আমার জন্য লজ্জাজনক।’

এর আগে বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার দিকে জুলকারনাইন সায়ের ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘নাহিদ ইসলাম, আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, আমি বৈষম্যবিরোধী চাঁদাবাজ রিয়াদকে (চাঁদাবাজির অভিযোগে সম্প্রতি গ্রেপ্তার আবদুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান) কোনো রকমের সার্ভেইলেন্সে (নজরদারি) রাখিনি। আর সে চাঁদা আনতে গিয়ে যে সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, সেটা লাগানোতেও আমার কোনো ভূমিকা নেই।’ তিনি নাহিদকে উদ্দেশ করে আরও লিখেছেন, ‘আপনি আমার ওপর ক্ষেপে গেছেন, কারণ আপনাকে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে যে রিয়াদকে ধরিয়ে দিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নাকি আমার।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বার্ষিকী যখন পালিত হচ্ছে, তখন নাহিদ ইসলামের এই ফেসবুক পোস্ট রাজনীতিতে হঠাৎ করে নানা আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। হঠাৎ এমন পোস্ট দেওয়ার কারণ জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে নাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, যা বলার ফেসবুক পোস্টে বলেছেন। এ বিষয়ে এখন আর কিছু বলতে চান না।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ফ সব ক প স ট সমন বয়কদ র ত র ক রহম ন জ ত য় সরক র ন হ দ ইসল ম ছ ত রশক ত প রথম আল প রস ত ব আগস ট র উপদ ষ ট ৫ আগস ট সরক র র আম দ র র জন ত বল ছ ন য গ কর কর ছ ন প রক শ র সমন স গঠন র একট ফখর ল

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা

মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে প্রায়ই বিজ্ঞান, স্থাপত্য বা শাসনব্যবস্থার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু এর মানবিক দিক অধরা রয়ে যায়। বিশেষ করে দরিদ্রদের প্রতি দয়া ও চিকিৎসাসেবার গল্প আড়ালে রয়ে গেছে সব সময়।

মুসলিম সভ্যতায় কীভাবে দরিদ্র ও অসুস্থদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা, আশ্রয় এবং মানসিক সান্ত্বনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা এক অপূর্ব কাহিনি।

বিমারিস্তান: দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসার আশ্রয়

মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবায় ‘বিমারিস্তান’ নামের হাসপাতাল ছিল একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। এগুলো শুধু চিকিৎসার জায়গা ছিল না, বরং দরিদ্রদের জন্য বিনা মূল্যে আশ্রয়, খাদ্য ও যত্নের ব্যবস্থা ছিল। বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত নগরে, বিশেষ করে বড় রাজধানীগুলোতে বিমারিস্তান ছিল। দামেস্কে বিমারিস্তানের নাম ছিল ‘নুরি’, বাগদাদে ‘আদুদি’।

প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহ.)

প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকের সময়, ৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি এতে চিকিৎসক নিয়োগ করেন এবং তাঁদের বেতনের ব্যবস্থা করেন। সমাজের স্বাস্থ্য রক্ষায় কুষ্ঠরোগীদের জন্য পৃথক স্থানে বিনা মূল্যে খাদ্য ও যত্ন দেওয়া হতো।

অন্ধদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা ও সাহায্যকারী নিয়োগ করা হতো। খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।’ (ইবনে আসাকির, তারিখে দিমাশক, ৪৪/১২৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

আরও পড়ুন“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”০১ অক্টোবর ২০২৫

ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালও ছিল, যা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হতো। দূরবর্তী অঞ্চলে মহামারি মোকাবিলায় ৪০টি উটের কাফেলায় চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হতো।

মিসরে প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় আহমদ ইবন তুলুনের সময়, ৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে, ফুসতাতে। এর নাম ছিল ‘বিমারিস্তান আতিক’।

এর জন্য ওয়াক্‌ফ তহবিল রাখা হয়েছিল, এবং শর্ত ছিল যে এটি শুধু সাধারণ মানুষের জন্য, সৈন্য বা দাসদের জন্য নয়। এর বার্ষিক খরচ ছিল ৬০ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)। ইবন তুলুন নিজে প্রতি সপ্তাহে এটি পরিদর্শন করতেন এবং জুমার দিনে মুসল্লিদের জন্য জরুরি সেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে ছিল ১ লাখের বেশি বইয়ের গ্রন্থাগার। (মাকরিজি, খিতাত, ২/৪০৫, দারু সাদির, কায়রো, ১৮৫৩)

সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবি বিমারিস্তান ‘নাসিরি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে মিসর ও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বিমারিস্তান ছিল মনসুর কালাউনের প্রতিষ্ঠিত বিমারিস্তান, ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। এখানে নারী-পুরুষ সবার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল, চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা ছিল না। এখানে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো।

সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। রাতের দীর্ঘ সময় রোগীদের জন্য কষ্টকর হতো, তাই ফজরের আজান দুই ঘণ্টা আগে দেওয়া হতো, যাতে রোগীরা সকালের আশায় উৎফুল্ল হয়। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।

সুস্থ হওয়ার পর রোগীদের পোশাক ও কিছু টাকা দেওয়া হতো, যাতে তারা তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে না বাধ্য হয়। এই বিমারিস্তান ২০০ জনের বেশি দরিদ্র রোগীকে বাড়িতে চিকিৎসা দিত। (মাকরিজি, খিতাত, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৭)

দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসাগ্রন্থ

মুসলিম সভ্যতার চিকিৎসকেরা লক্ষ করেন, চিকিৎসা কখনো কখনো ধনীদের কাছে ব্যবসায় পরিণত হন। তাই তাঁরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তারা নিজেরা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে বা ছোট চিকিৎসকেরা তাদের সহজে চিকিৎসা দিতে পারেন। এই গ্রন্থগুলোয় স্থানীয় ও সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতো; কারণ, ভারত বা চীন থেকে আমদানি করা ওষুধ ছিল দামি।

আরও পড়ুনইসলামে দারিদ্র্য দূরীকরণের ৮টি ব্যবহারিক উপায়০২ নভেম্বর ২০২৫

আবু বকর আর-রাজি: তিনি দরিদ্রদের প্রতি অসাধারণ দয়া দেখাতেন এবং তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করতেন। তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন: ‘বুরউ সা’আত’ (তাৎক্ষণিক চিকিৎসা) এবং ‘মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব’ (যার কাছে চিকিৎসক নেই), যাকে ‘তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন’ (দরিদ্রদের চিকিৎসা) বলা হয়।

তিনি লিখেছেন, ‘অনেক চিকিৎসক ওষুধ ও খাবারের কথা লেখেন, যা শুধু রাজাদের ভান্ডারে পাওয়া যায়। আমি সাধারণ ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে চিকিৎসার একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লিখতে চাই, যাতে সবাই এর সুবিধা পায়।’ (আল-রাজি, মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব, পৃষ্ঠা ১৫, দারুল কুতুব, বৈরুত, ১৯৮৫)

মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো।

ইবনে জাজ্জার কায়রাওয়ানি: তিনি কখনো দরিদ্রদের কাছ থেকে চিকিৎসার ফি নিতেন না। তিনি তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন গ্রন্থে লিখেছেন, ‘দরিদ্ররা স্বাস্থ্য ও রোগ–সম্পর্কিত বইয়ের সুবিধা পায় না। তাই আমি এমন একটি গ্রন্থ লিখলাম, যাতে সহজলভ্য ওষুধ দিয়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করা যায়।’ (ইবনে জাজ্জার, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ১০, দারুল ফিকর, কায়রো, ১৯৯০)

ইবনে আকফানি: তিনি গুনইয়াতুল লাবিব ফি গাইবাতিত তাবিব (চিকিৎসক না থাকলে জ্ঞানীর সম্পদ) গ্রন্থে জরুরি রোগের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য রক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন।

জামালুদ্দিন ইউসুফ মাকদিসি: তিনি ‘তিব্বুল ফুকারা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ধনীরা সুস্বাদু খাবার খায়, তাই তাদের রোগ বেশি। দরিদ্ররা সাধারণ খাবারে সন্তুষ্ট থাকে, তাই তাদের রোগ কম। কিন্তু দরিদ্ররা অসুস্থ হলে তাদের জন্য সহজ ও সস্তা ওষুধ দরকার।’ (মাকদিসি, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ৮, দারুল মারিফা, বৈরুত, ১৯৯২)

মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো। চিকিৎসকেরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে তারা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে। এই ঐতিহ্য দেখায়, ইসলামি সভ্যতা কেবল জ্ঞান বা শক্তিতে নয়, মানবিকতা ও দয়াতেও শ্রেষ্ঠ ছিল।

আরও পড়ুনআপনার মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিচ্ছেন তো২১ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ