অভিযানকালে ডাকাতদলের তিন সদস্য সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার ওরফে নির্জনকে প্রথমে ছুরিকাঘাত করে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে ডাকাতরা সেনা কর্মকর্তার গলার ডান পাশে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে গুরুতম জখম করে। এতে তাঁর ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়। তখন বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা ছিলেন ওই সেনা কর্মকর্তা, কিন্তু এতেও তিনি রক্ষা পাননি। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় অভিযানের সময় সেনা কর্মকর্তা তানজিম ছারোয়ারকে এভাবে হত্যা করে ডাকাতরা। ছুরিকাঘাতে হত্যা করা তিন ডাকাত হলো- নুরুল আমিন, নাছির ও মোর্শেদ। 

গতকাল রোববার চকরিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পুলিশের দাখিল করা অভিযোগপত্রে এ তথ্য উঠে আসে।

জানা যায়, ২০২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়ায় ডাকাতি প্রতিরোধ অভিযানে গিয়ে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার (২৩)। 

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়ায় মাছ ব্যবসায়ী রেজাউল করিমের বাড়িতে ডাকাতি প্রস্তুতির গোপন সংবাদ পেয়ে রাত পৌনে তিনটার দিকে মেজর উজ্জ্বল মিয়ার নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী অভিযান চালায়। এ সময় ডাকাত দলের সদস্যরা যৌথ বাহিনী সদস্যদের দেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে তাদের দাঁড়ানোর জন্য বলেন এবং একটি ফাঁকা গুলি ছোড়েন। এ সময় অস্ত্রধারী ডাকাতদলের হেলাল উদ্দিন, নুরুল আমিন, আবদুল করিম, মোর্শেদ আলম, নাছির উদ্দিন ও মিনহাজ উদ্দিন গুলি করতে করতে পালিয়ে যান। তখন তানজিম ছারোয়ার তাদের ধাওয়া করেন। কিছু দূর গিয়ে একটি বাড়ির উঠানে তারের বেড়ায় বেধে ডাকাত মোর্শেদ আলম পড়ে গেলে তাকে ধরে ফেলেন সেনা কর্মকর্তা।

এ সময় ডাকাত নুরুল আমিন ও নাছির উদ্দিন ধরা পড়া মোর্শেদ আলম সেনা কর্মকর্তা তানজিমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। নুরুল আমিন, নাছির ও মোর্শেদ ছুরি দিয়ে তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করতে থাকেন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলার ডান পাশে ছুরি চালিয়ে দেওয়া হয়। এতে তানজিমের ফুসফুস পর্যন্ত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। গায়ে বুলেটপ্রুফ পোশাক থাকলেও তিনজনের ছুরিকাঘাতে রক্ষা পাননি তিনি। তখন ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে স্থানীয় লোকজন ও অভিযানকারী দলের সদস্যদের আসতে দেখে গুরুতর জখম অবস্থায় তানজিম ছারোয়ারকে ফেলে ডাকাতরা বেড়া টপকে পালিয়ে যায়। পরে মারাত্মক জখম অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ডুলাহাজারা মালুমঘাট খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতাল এবং সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে রামু ক্যান্টনমেন্টের সিএমএইচে নেওয়া হয়। চিকিৎসক তাঁকে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে মৃত ঘোষণা করেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ঘটনার অন্তত তিন–চার দিন আগে থেকে আসামি জালাল উদ্দিন, হেলাল উদ্দিন, মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ, আনোয়ার হাকিম, জিয়াবুল করিম, মো.

ইসমাইল হোসেন, নুরুল আমিন, নাছির উদ্দিন, আবদুল করিম, মোহাম্মদ সাদেক, আনোয়ারুল ইসলাম, মোর্শেদ আলম, শাহ আলম, আবু হানিফ, এনামুল হক, মো. এনাম, মো. কামাল ও মিনহাজ উদ্দিন একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে পূর্ব মাইজপাড়ার মাছ ব্যবসায়ী রেজাউল করিমের বাড়িতে ডাকাতির পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে ডাকাতির প্রস্তুতি নিলে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। এ সময় ডাকাতদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে সেনা কর্মকর্তা নিহত হন।

এ ঘটনায় ২০২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আবদুল্লাহ আল হারুনুর রশিদ বাদী হয়ে ১৭ জনের বিরুদ্ধে ডাকাতির প্রস্তুতিসহ চকরিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। চকরিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে একই আসামিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা করেন। মামলা দুটি তদন্তের দায়িত্ব পান চকরিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) অরূপ কুমার চৌধুরী। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দীর্ঘ চার মাসের তদন্ত শেষে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকায় এজাহারনামীয় ছয়জন আসামিকে বাদ দেন এবং নতুন করে সাতজনকে যুক্ত করে দুটি মামলায় মোট ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও চকরিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) অরূপ কুমার চৌধুরী বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, আসামিদের কললিস্ট পর্যালোচনা, গ্রেপ্তার আসামিদের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং গোপন তদন্তে লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার হত্যাকাণ্ডে ১৮ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। আদালতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করলে তা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া পলাতক ছয় আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও মালামাল ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। অভিযোগপত্রভুক্ত বাকি ১২ আসামি বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম র শ দ আলম ল কর ম চকর য় সদস য ত করত এ সময় তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

ভোগবাদী যুগে ইসলামে সুখের খোঁজ

আপনার বাড়িতে কি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের স্তূপ জমে আছে? জানেন কি, এর থেকে মুক্তির পথ আছে ইসলামের সরল জীবনধারায়? আধুনিক বিশ্বে ভোগবাদের তীব্র ঝড়ে আমরা প্রায়ই নিজেদের দেখি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরে।

নতুন ফ্যাশনের পোশাক, সর্বশেষ প্রযুক্তির গ্যাজেট বা মধ্যরাতে এক ক্লিকে কেনা অপ্রয়োজনীয় পণ্য—এসব আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইসলাম আমাদের ন্যূনতম একটি সরল জীবনধারার পথ দেখায়, যা পার্থিব লোভ থেকে মুক্ত করে আমাদের আল্লাহর পথে নিবেদিত হতে উৎসাহিত করে।

আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০সংযম কেন জরুরি

মিনিমালিজম বা ন্যূনতাবাদ এমন একটি জীবনধারা, যেখানে আমরা শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর নির্ভর করব এবং অতিরিক্ত ভোগবিলাস থেকে দূরে থাকব। ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ না হয়ে শুধু যেটুকু না হলেই জীবন চলে না, সেটুকু নিজের কাছে রাখব।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান, প্রত্যেক নামাজের সময় বেশভূষা সৌন্দর্য গ্রহণ করো, খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আ’রাফ, আয়াত: ৩১)।

এই আয়াত আমাদের জীবনে সংযম ও সরলতার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।

আরও পড়ুনদুনিয়ার ভোগ–বিলাস নিয়ে সুরা তাকাসুরের সতর্কতা১০ এপ্রিল ২০২৩

বিজ্ঞাপনের প্রলোভন আজকাল আমাদের অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার দিকে ঠেলে দেয়। প্রায়ই এমন জিনিস কিনে ফেলি, যেমন একটি ইউএসবি মগ হিটার বা জামাকাপড়, যা তারপর বছরের পর বছর অব্যবহৃত পড়ে থাকে।

বাড়িতে জমে থাকে প্যাকেট না খোলা গ্লাস–বক্স, অপঠিত বইয়ের স্তূপ। প্রশ্ন করে দেখি তো, আমাদের আসলেই কি এগুলো প্রয়োজন ছিল?

মহানবী (সা.)-এর সাদাসিধা জীবন

মহানবীজি (সা.) এবং তাঁর সাহাবারা সরল জীবনযাপনের উজ্জ্বল উদাহরণ। হজরত আয়েশা (রা.)-কে নবীজি বলেছিলেন, ‘হে আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো। ধনীদের সঙ্গে মেলামেশা থেকে সাবধান থাকো এবং কোনো পোশাককে তখনই জীর্ণ হয়ে গেছে মনে করো, যখন তুমি তাতে প্যাঁচ লাগিয়েছ (মানে যখন পুরোনো হয়ে যাওয়ার কারণে পেঁচিয়ে যায়)।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০)।

এই হাদিসে নবীজি (সা.) স্পষ্টভাবে সরল জীবনযাপন এবং অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।

ইসলাম আমাদের শেখায় যে পার্থিব সম্পদ ক্ষণস্থায়ী এবং এটি আমাদের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য প্রস্তুতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। নবীজি (সা.) কখনো অপ্রয়োজনীয় সম্পদ সঞ্চয় করেননি এবং সব সময় দানশীলতার মাধ্যমে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করেছেন।

দানের সংস্কৃতি

আজকের বিশ্বে ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের জীবনকে জটিল করে তুলেছে। ক্রেডিট কার্ড, সহজলভ্য ঋণ এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ করে। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, যেমন আমাদের দাদা-দাদিরা, সীমিত সম্পদের মধ্যে সরল জীবন যাপন করতেন। কিন্তু গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ আমাদের ভোগবাদী প্রবৃত্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুনখাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা০৯ জুন ২০২৫

কিন্তু ইসলাম আমাদের শেখায়, প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করা লোভ ও কৃপণতার দিকে নিয়ে যায়, যা একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়।

ইসলাম আমাদের জীবনকে সরল করার পাশাপাশি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করে। আমরা চাইলে মাসিক বাজেটের একটি অংশ দানের জন্য বরাদ্দ করতে পারি।

যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪

বিয়ের মতো উৎসবে আমরা বিলাসবহুল আয়োজনের পরিবর্তে সরলতা বেছে নিতে পারি। উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪)।

আমাদের ভালো কাজ এবং দানশীলতা পরকালে যেমন উপকারে আসবে, তেমনি সমাজের জন্যও হবে কল্যাণকর। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দানশীলতার দিকে মনোযোগ দিলে সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের জীবন উন্নত হবে।

ভোগবাদী জীবন মানুষকে অস্থির করে তোলে এবং ন্যূনতম খরচের জীবনধারা মানুষকে তৃপ্তির জীবন উপহার দেয়। এটি একই সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনেরও একটি পথ।

আমরা যদি আমাদের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আল্লাহর পথে ব্যয় করি, তবে তা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। ন্যূনতমবাদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের প্রকৃত সুখ পার্থিব সম্পদে নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের প্রস্তুতিতে নিহিত।

আরও পড়ুনআধুনিক এই প্রবণতার শিকড় ইসলামে২০ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ