মানিকগঞ্জ জেলা কারাগার যেন ‘দুর্নীতির আখড়া’!
Published: 23rd, January 2025 GMT
সিংগাইর উপজেলার গোলাইডাঙ্গা গ্রামের ইদ্রিস আলী নিজের স্ত্রীকে নিয়ে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে এসেছেন হাজতি ছেলে শিপলুর সাথে সাক্ষাৎ করতে। নাম ঠিকানা দিয়ে সহজে সাক্ষাৎও পেয়েছেন, কোনো টাকা পয়সা লাগেনি। তবে সাক্ষাৎ করে আসার পর থেকেই নিজের চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি ইদ্রিস আলী। কী এমন কথা হয়েছে ছেলের সাথে, যা শুনে দরিদ্র ইদ্রিসের চোখের কোনে জল? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মিলেছে কারাগারে বন্দিদের দুঃসহ জীবনযাপনের এক ভয়াবহ চিত্র।
ইদ্রিস আলীর স্ত্রী বলেন, “ছোট ছেলে শিপলু একটি মামলার দুই নাম্বার আসামি। বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) আদালতে জামিন চাইলে তা না মঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণ করেন বিচারক। শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকায় সাক্ষাৎ করতে পারেননি। রবিবার (১৯ জানুয়ারি) ছেলের সাথে সাক্ষাৎ হয়। ছেলে তাকে জানান, যেকোনো মূল্যে তাকে যেনো জামিনে বের করা হয়। জেলের খাবার খেয়ে যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। খাবারের মান এতই নিম্নমানের!”
ইদ্রিস আলী বলেন, “আমরা গরিব কিন্তু জেলখানায় খাওয়ানোর মতো খাওন আমার পুলা কোনদিন খায় নাই। পুলাডা বারে বারে কইছে এই খাওন খাইলে মইরাও যাইতে পারে। যেমনেই হোক পুলারে যানি বাইর করি। দেহা অহনের পরে ক্যান্টিনের লাইগা ছয়শো ট্যাকা রোববার জমা দিছি, যানি একটু ভালো মতোন খাইতে পারে। মঙ্গলবারে পুলাডার জামিন অইছে। জেলখানায় পুলাডারে পানির মতন ডাইল, যা তা নিরামিষ, সকালে কোনো রকমের ছোট্ট রুটি দিতো। জেল খানায় আগে দেহা করবার আইলে দুইশো কইরা টাহা লাগতো, এহন লাগে না। এডা খুবই ভালো অয়ছে। তয় খাওয়ানোর মান আগের চাইয়্যা দিন দিন খারাপ অইছে।”
শুধু ইদ্রিস আলীই এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন বিষয়টি এমন নয়। মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারের সামনে হাজতিদের বহু আত্মীয় খাবারের মান ভালো নয় বলে দুঃখ করেছেন। ফলে তারা ক্যান্টিনের জন্য পিসিতে টাকা জমা দিয়ে আসেন।
তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে প্রাপ্ত নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, বন্দিদের সকালের খাবারে সপ্তাহের চার দিন সবজি-রুটি, দুই দিন খিচুড়ি ও একদিন হালুয়া-রুটি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। সকালের খাবারে হাজতিদের রুটির ওজন ৯০ গ্রাম ও কয়েদিদের রুটির ওজন ১২০ গ্রাম। খিচুড়িতে হাজতিদের খিচুড়ির চাউলের ওজন ৯০ গ্রাম ও কয়েদিদের ১২০ গ্রাম এবং সবজির ওজন উভয়ের জন্য ১৫০ গ্রাম করে থাকবে।
দুপুরের খাবারে হাজতিদের ২৪৭.
এসব খাবারের সাথে মাসে ১০ দিন মাংস ও অন্যান্য দিন মাছ দেওয়ার নিয়ম। এরমধ্যে পাঁচ দিন গরুর মাংস, চার দিন মুরগির মাংস, একদিন ছাগি/খাসির মাংস, অন্যান্য দিনগুলোতে বিভিন্ন প্রকারের মাছ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।
মাছ ৩৬.৪৫ গ্রাম, গরুর মাংস ৩৮.৭৮ গ্রাম, খাসির মাংস ৩৬.৪৫ গ্রাম এবং মুরগির মাংস ৩৭.৯০৮ গ্রাম দেওয়ার নিয়ম। খাবার পরিবেশনের এসব নিয়ম কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই বলে জানান জামিনে বের হয়ে আসা আসামিরা।
দেড় মাসের বেশি সময় জেলে থেকে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর জামিনে বের হয়েছেন শিবালয়ের হারেজ। তিনি বলেন, “নতুন জেল সুপার একদিন ঘুইরা দেইখ্যা যারা রান্দন বারন করে তাগো ডাইক্যা আনছিলো। তাগো ডাইক্যা জিগাইলো খাওন এতো কম দেওয়া অয় ক্যান? তারপর কয়দিন খাওনের পরিমাণ বাড়ছিলো। আমরা তো আর জানি না কতটুকুন খাওন আমাগো দিবো, আমরা তো আর নিয়ম জানি না। আমাগো যা দিছে তাই খাইছি। তয় একটু মাংস সপ্তাহে দুইবার পায়ছি কিন্তু খাসির মাংস দেড়মাসের মধ্যে একবারও পাই নাই। কয়বার মাংস পাওয়ার নিয়ম তাতো জানি না।”
এদিকে জেলা কারাগারে অসুস্থ বন্দিদের সেবায় একজন সহকারী সার্জন ও একজন ডিপ্লোমা নার্সের পদ থাকলেও ওই পদে কর্মরত নেই কোনো চিকিৎসক ও নার্স। বন্দিদের সেবায় রয়েছে ২০ শয্যা বিশিষ্ট কারা হাসপাতাল ও একজন ফার্মাসিস্ট। অসুস্থ বন্দিদের সেবায় কারা হাসপাতাল করা হলেও টাকার বিনিময়ে সেখানে চলছে আয়েশি জীবন যাপন।
এমন অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে আদালত প্রাঙ্গণ এলাকা ও জেলা কারাগার এলাকায় পরিচয় গোপন রেখে অনুসন্ধান করেছে রাইজিংবিডির এই প্রতিবেদক।
অনুসন্ধান বলছে, পাঁচ হাজার টাকা দিলে এক মাসের জন্য কারা হাসপাতালের শয্যা বরাদ্দ পাওয়া যায়। ব্যক্তি বিশেষে এ টাকা উঠানামা করলেও ঘুষ ছাড়া কেউ শয্যা পায় না। আসামিকে প্রথমদিন ওয়ার্ডে কাটাতে হয়, আগের দিন ঘুষের টাকা দিলেই পরের দিন থেকে কারা হাসপাতালে আরাম আয়েশে থাকতে পারেন হাজতি। এক মাসের আগে জামিন হয়ে গেলে ওই টাকা ফেরত দেওয়া হয় না। একদিন থাকলেও পাঁচ হাজার, এক মাস থাকলেও পাঁচ হাজার। তবে কারাগারের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারিরা অপরিচিত কারো সাথে এ টাকার লেনদেন করেন না। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে নির্দিষ্ট পরিচিত লোকজনের সাথে তারা লেনদেন করেন।
আবু তালেব গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর জামিন পেয়েছেন। নভেম্বরের ৩ তারিখ থেকে তিনি ৪৬ দিন জেলে ছিলেন। ওই সময়ে কারাগারে একাধিক দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে ফিরেছেন তিনি। আবু তালেব বলেন, “প্রতিটি ওয়ার্ডে রাইটারসহ কয়েকজন দায়িত্বে থাকেন। এসব দায়িত্বরত ব্যক্তিরা বন্দিদের কাছে বিছানার জন্য পনেরশ’ টাকা দাবি করেন। যার কাছে যেভাবে পারে টাকা নেয়। টাকা না দিলে টয়লেটে থাকতে হবে বলেও হুমকি দেন। একবার জেল সুপার পরিদর্শনে এলে আনোয়ার নামের এক বন্দী এসব বিষয় তাকে জানান। তারপর ওয়ার্ডের দায়িত্বরা বন্দিদের সাথে আরো বেপরোয়া আচরণ শুরু করে। জেল সুপার পরিদর্শনে খাবার কম দেওয়ায় অসন্তুষ্ট প্রকাশ করলে কয়েকদিন খাবারের পরিমাণ বেড়েছিলো। আসলে কী পরিমাণ বরাদ্দ থাকে তা বন্দিদের পক্ষে জানা সম্ভব না।”
অপর আসামি নজরুল ব্যাপারী বলেন, “দেড় মাসের বেশি সময় কারাগারে ছিলাম। টাকা ছাড়া কোনো বিছানা বা চাদর কিছুই দেয় না। টাকা না দিলে মেঝেতে ছালা বিছিয়ে ঘুমাতে হয়। ওদের কাছে টাকাই সব। জেলখানার খাবারের মান ভালো হলে ক্যান্টিন চলবে কীভাবে? ওদের খাবার যদি ভালো হতো, তাহলে তো বন্দিদের আর ক্যান্টিনের খাবার কিনে খেতে হতো না।”
মানবাধিকার কর্মী মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “কোনো আসামি সাজা পেলেও তাদের মৌলিক অধিকার খর্ব করা যাবে না। সরকার নির্ধারিত সুযোগ সুবিধা বন্দিদের নিশ্চিত করা কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এসব সুযোগ সুবিধা দিতে বন্দিদের কাছ থেকে কারাগারের অসাধু কর্তা ব্যক্তিরা টাকা ঘুষ নিয়ে থাকেন। যা মানবিধার লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও অন্যায়। আসামিদের বিচার করবে আদালত। কিন্তু এসব অন্যায়ের সাথে জড়িতদের বিচার করবে কে? যাদের টাকা আছে, তারা কারাগারে বেশি সুযোগ সুবিধা পাবে, এটা মোটেও ঠিক না।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি ইকবাল হোসেন কচি বলেন, “জেলা কারাগার এখন বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট। সাক্ষাৎ করতে আগে টাকা লাগতো, এখন লাগে না এমন দৃশ্য দেখিয়ে ভিতরে ঠিকই দুর্নীতির আখড়া বানিয়ে রেখেছে। সবার চোখে ধুলো দিয়ে এমন অনিয়ম চলছে। জেলের ভিতরে টাকাওয়ালারা ঘুষ দিয়ে হাসপাতালে আরাম আয়েশে থাকে, আর গরিবরা টাকা না থাকায় প্রাপ্য তোষক-বালিশের অধিকার টুকুও পায় না। এমন অনিয়ম বন্ধে কারা পরিদর্শনকারীদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।”
এসব অনিয়মের বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির খান বলেন, “খাবারের মান নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন খাবারের মান খুবই ভালো। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বন্দিরা বিছানা পাবেন। কেউ টাকা নিয়ে থাকলে অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কারা হাসপাতালে টাকার বিনিময়ে থাকার সুযোগ নেই। তারপরও কেউ অভিযোগ দিলে বিষয়টি খতিয়ে দেখব। বন্দিদের সেবা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি।”
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “কারাগার পরিদর্শন করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কোথাও কোনো অনিয়ম, ঘাটতি থাকলে সাথে সাথে তা ঠিক করা হচ্ছে। তারপরও কোনো অসাধু কর্মকর্তা অনিয়মের সাথে জড়িত কিনা সে বিষয় খতিয়ে দেখা হবে। কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঢাকা/এস
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম ন কগঞ জ জ ল স ক ষ ৎ কর র জন য থ কল ও ওজন র র ওজন একদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
শুল্ক কমেছে, বাংলাদেশে স্বস্তি
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশের ওপর দেশটির আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসের এক ঘোষণায় এ কথা বলা হয়। বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কহার কমে প্রতিযোগীদের কাছাকাছি অবস্থানে আসার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক।
২৯ জুলাই থেকে তিন দিনের আলোচনা ও দর-কষাকষির শেষ দিন ৩১ জুলাই এ ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭০টি দেশের ওপর ১০ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসে।
পাল্টা শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ নামিয়ে আনতে বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকেও বেশ কিছু সুবিধা দিতে হয়েছে। একদিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পান গত ২১ জানুয়ারি। এর দুই মাস পর গত ২ এপ্রিল হঠাৎ বিশ্বের ৭০ দেশের জন্য বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। অনেকেই ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে একধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলে সমালোচনা করেছেন।
প্রথমে গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা হয় ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক। মাঝখানে তিন মাস স্থগিত রাখার পর ৮ জুলাই তা কমিয়ে ট্রাম্প ৩৫ শতাংশ করেন। বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ করায় মোট শুল্কহার দাঁড়াবে এখন ৩৫ শতাংশে।
দর-কষাকষির মাধ্যমে ঘোষিত শুল্কহার কমিয়ে আনাকে ঐতিহাসিক চুক্তি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের আলোচকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে আলোচনা করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন আলোচকদের মধ্যে আরও ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে বলেছে, অনেক বিষয় জড়িত থাকায় শুল্ক আলোচনার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয়টি শুধু শুল্ক কমানোর সঙ্গেই যুক্ত ছিল না; বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্যঘাটতি ও নিরাপত্তা–সংক্রান্ত মার্কিন উদ্বেগও ছিল এর সঙ্গে। সমাধানের বিষয়টি নির্ভর করছিল একটি দেশের সদিচ্ছার ওপরও।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা গতকাল প্রথম আলোকে জানান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকব এবং যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আমরা ২০ শতাংশের নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম।’
প্রতিযোগী দেশগুলোর শুল্কহারযুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
বাংলাদেশের সমান ২০ শতাংশ ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কা এবং ১৯ শতাংশ হার নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কম রয়েছে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের হারও ১৯ শতাংশ। তাইওয়ানের ওপর ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ; জাপান, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৪১ শতাংশ শুল্কহার সিরিয়ার ওপর। বেশি হার আরোপ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে লাওস ও মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ; সুইজারল্যান্ডের ওপর ৩৯ শতাংশ; ইরাক ও সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ এবং লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিচ্ছে বাংলাদেশসরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেশন পুরোপুরি মেনে চলারও অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে দেশটি থেকে দাম বেশি দিয়ে হলেও বছরে সাত লাখ টন করে গম কেনা হবে পাঁচ বছর ধরে। ইতিমধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি।
দেশটি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আগে থেকেই আমদানি করা হচ্ছে। তা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৯ থেকে ১১ জুলাই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সফল না হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে, সেসব পণ্যের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ১৭ থেকে ২৩ জুলাই সপ্তাহব্যাপী অনলাইনে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়েই তিনি বৈঠকগুলো করেন।
গত ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (প্রকাশ না করার চুক্তি) করার কারণে সরকারি প্রতিনিধিদলে অন্য কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ভেতরে-ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
সরকারের আহ্বানে সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে। এসব সভায় তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেন তাঁরা। বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ১৩ কোটি ডলারে ৩ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রায় ১০ কোটি ডলারের সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
এ ছাড়া ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ১৯ হাজার টন তুলা আমদানির সমঝোতার চুক্তি করেছে বস্ত্র খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কার্গিল ইনকরপোরেটের কাছ থেকে এশিয়া কম্পোজিট ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে ৬ হাজার টন আমদানির এমওইউ করেছে। একই দরে একই পরিমাণ তুলা আমদানির এমওইউ করেছে সালমা গ্রুপও। এ ছাড়া মোশাররফ গ্রুপ মার্কিন লুইস ড্রেফাস গ্রুপ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ৭ হাজার টন তুলা আমদানির এমওইউ করেছে।
কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ২০ শতাংশ শুল্কহার ঠিক করতে পেরেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, এটাই হচ্ছে প্রধান কারণ।’
ট্রেড ইউনিয়ন, মজুরি, শ্রমিক নিপীড়ন, মামলা—এসব বিষয় আলোচনায় উঠেছিল কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে। শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখতে জোর দিয়েছে তারা। আমরা আইএলও কনভেনশন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ জন্য শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চলছে।’
‘অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা’ওয়াশিংটনে দর-কষাকষিতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টা শুল্ক কমার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, তাতে বাংলাদেশ বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে রেহাই পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘সময়সীমার মধ্যেই জটিল আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। নইলে ৩৫ শতাংশের গুরুভার বহন করে যেতে হতো।’
খলিলুর রহমান আরও বলেন, প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান অথবা যত্সামান্য বেশি এবং ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য এখন প্রতিযোগিতামূলক থাকবে। তৈরি পোশাকশিল্প ও এর ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টার উদ্দেশে ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় তিনি (শেখ বশিরউদ্দীন) সমালোচকদের হতাশ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আল্লাহ তাঁকে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, যাতে তিনি দেশকে সেবা দিতে পারেন, হোক তা সরকারে বা বেসরকারি খাতে।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। তবে আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই, বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্যকৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির প্রথম আলোকে বলেন, একটি বিশ্বশক্তির চাপের মুখে এই সাফল্য অর্জনের জন্য সরকার ও আলোচক দলের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন। এটি সম্ভবত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে কঠিন লড়াইগুলোর একটি ছিল, যা পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন তাঁরা।