Samakal:
2025-07-11@18:59:47 GMT

পোশাক বদলালেই কি পুলিশ বদলাবে?

Published: 4th, February 2025 GMT

পোশাক বদলালেই কি পুলিশ বদলাবে?

পোশাক তো বদলাতেই হয়। ধুলোবালিতে নোংরা হলে বদলাতে হয়; আবহাওয়া অনুযায়ী বদলাতে হয়; হাল ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়েও বদলাতে হয়। ষাটের দশকের শেষ দিকে ‘টেডি’ পোশাক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল; সত্তরের দশকে ‘বেলবটম’। এখন আর সেসব কেউ পরে না। ফ্যাশন বদলেছে; বদলেছে পোশাক। মানুষ কিন্তু তেমনই আছে; বদলায়নি। কেউ কেউ অবশ্য বদলেছে; পোশাকের কারণে নয়; বদলেছে অন্তর্সত্তা। আসলে মানুষের বদলটা ঘটে ভেতর থেকেই; পোশাক থেকে নয়।

ইদানীং কথা চলছে পুলিশ বাহিনীর পোশাক বদলের। অনেক জল্পনাকল্পনার পর চূড়ান্ত হয়েছে নতুন পোশাক। ২০ জানুয়ারি সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে এমনটিই জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.

) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা রকমের মন্তব্য চলছে। কেউ কেউ বলছেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে পুলিশ বাহিনীর আচরণের কারণে পোশাকের পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছিল। কেউবা আবার এতে ষড়যন্ত্রের আভাসও দেখছেন।

যতটুকু জানা যায়, ২০২০ সাল থেকেই পুলিশের বর্তমান পোশাক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা চলছিল। ২০২১ সালের শুরুর দিকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের জন্য বেশ কয়েকটি পোশাকের ট্রায়ালও হয়। তার পরও নানা কারণে নতুন পোশাক পাননি পুলিশ সদস্যরা। এরই মাঝে পতন ঘটে গেছে সরকারের। ধরে নেওয়া যায়, আগের সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায়ই বর্তমান সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে।
অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশে পুলিশের ইউনিফর্মের রং ছিল খাকি। ব্রিটিশ অফিসার স্যার হ্যারি লুমসডেনের পরামর্শে ১৮৪৭ সালে এটি চালু হয়। তার একশ বছর পর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান হয়েছে; কিন্তু পুলিশের পোশাকের রং খাকিই রয়ে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশেও খাকি রং চালু ছিল। 

বাংলাদেশ পুলিশের পোশাকে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ২০০৪ সালে; মহানগরগুলোয় হালকা জলপাই রং, জেলা পুলিশের গাঢ় নীল। র‍্যাবের কালো ও এপিবিএনের পোশাক তৈরি করা হয় খাকি, বেগুনি আর নীল রঙের মিশ্রণে। এমনকি ২০০৯ সালেও কিছুটা পরিবর্তন আসে। প্রতিবারই এর পেছনে ‘অকাট্য যুক্তি’ দেখানো হয়েছে।
যে যুক্তিতেই পুলিশের পোশাক পরিবর্তন হোক না কেন; গত অর্ধশতাব্দীতে পুলিশের আচরণে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন এসেছে? উনিশ শতকের মাঝামাঝি আনুষ্ঠানিক যাত্রার সময় থেকেই পুলিশ বাহিনী শাসক শ্রেণির লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে যেহেতু আজকের মতো রাজনৈতিক ‘ক্যাডার’ ছিল না; পুলিশই ছিল শাসক শ্রেণির ভরসা। পুলিশ কাজটি দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে গেছে। 

আশা করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর অন্তত স্বাধীন দেশের উপযোগী পুলিশ বাহিনী গড়ে উঠবে। কিন্তু তা ঘটেনি। না ঘটারই কথা। কারণ স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে শাসক বদলালেও শাসকের শ্রেণি বদলায়নি। শাসক শ্রেণি তার শ্রেণিস্বার্থেই তা হতে দেয়নি। সেই হিসাবে বলা যায়, যতদিন শাসক শ্রেণির চরিত্র বদল না হবে; পুলিশের গুণগত পরিবর্তন আশা করা বাহুল্য হয়েই থাকবে।

বলা হয়– পুলিশ জনগণের বন্ধু। বন্ধুই তো হওয়ার কথা! কিন্তু হতে পারেনি। হতে দেওয়া হয়নি। কারণটা খুবই স্পষ্ট। রাষ্ট্র নিজেই যেখানে শোষণের মাধ্যম, পুলিশ যে মাধ্যমের হাতিয়ার; সেখানে পুলিশ জনগণের বন্ধু হয় কেমন করে? মানুষ আসলে পুলিশকে ভয় পায়; যেমন ভয় পেয়েছে ব্রিটিশ আমলে, তেমনি পাকিস্তান আমলে। এখনও তেমনটিই চলছে। ভয়কে জিইয়ে রেখে বন্ধু হওয়া যায় না। কিন্তু পুলিশের প্রতি এই ভয়টা শাসক শ্রেণির খুব প্রয়োজন। প্রয়োজন ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। গণতন্ত্রহীন কিংবা দুর্বল গণতন্ত্রের দেশে পুলিশ কখনও জনগণের বন্ধু হতে পারে না।
আমাদের দেশে সুবিদিত, পুলিশকে ম্যানেজ করতে পারলে অনেক কিছু ম্যানেজ করা যায়। পুলিশ হাতে থাকলে নির্বাচনে জেতা যায়; প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা যায়; জমির দখল নেওয়া বা উচ্ছেদ করা; ইত্যাকার কাজ! এ কারণে প্রবল পরাক্রমশালী মন্ত্রী-এমপিরা পর্যন্ত পুলিশকে সমঝে চলেন। চলতে তারা বাধ্য। কারণ স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে জনগণের ক্ষমতায়নও ঘটেনি। সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক; জনগণ কেবলই ‘প্রজা’। আসল রাজা ‘রাষ্ট্র’। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোতে আরোহণে পুলিশের সহযোগিতা অনিবার্য।
নিজেদের অনিবার্যতা সম্পর্কে পুলিশও বিলক্ষণ সচেতন। তাই তারাও সুযোগ গ্রহণ করে। কিছুদিন আগেই কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলায় বিএনপির কর্মিসভায় হাজির হয়ে নিজেকে আওয়ামী লীগ আমলে নির্যাতিত দাবি করে বক্তৃতা করলেন থানার ওসি মঈনুল ইসলাম (সমকাল, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪)। বোঝাতে চাইলেন, তিনি বিএনপির লোক। 

মঈনুল ইসলাম মনে করেছেন, রাজনীতির যে অবস্থা, তাতে আগামী নির্বাচনে বিএনপিরই ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই তিনি এখন থেকেই ভবিষ্যতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন। এ ধরনের কাজ আমরা আওয়ামী লীগ আমলেও দেখেছি। পুলিশ সদস্যরা আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জন্য ভোটের প্রচারণা করেছেন। বিরোধী দল মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করেছেন। 
২০২৩ সালের আগস্টে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানার ওসি তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের জন্য প্রকাশ্যেই ভোট চেয়ে বক্তৃতা করেছিলেন। একই কাজ করেছিলেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থানার ওসি। তিনিও আওয়ামী লীগকে নিজের দল দাবি করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে বক্তব্য দেন। এসব খবর সে সময়কার পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু সরকার তা গায়ে লাগায়নি। কেনইবা লাগাবে! সরকারি দল আর পুলিশ– ইতিহাসের সব পর্যায়েই মিলেমিশে রাষ্ট্র নামে শোষণযন্ত্রকে পাহারা দিয়ে আসছে। সম্পর্কটি তাই সিমবায়োটিক; দু’পক্ষই লাভবান তাতে। যতদিন এই সম্পর্ক ভাঙা না যাবে, পোশাক বদলে কোনো কাজ হবে না।

মোদ্দাকথা, পোশাকের ক্ষেত্রে যতই পরিবর্তন আনা হোক; রাষ্ট্র নিজে যতদিন জনগণের বন্ধু না হবে, ততদিন পুলিশও বন্ধু হবে না। হতে পারবে না। সবার আগে তাই রাষ্ট্রকে জনগণের হতে হবে। কিন্তু চরিত্র না বদলালে রাষ্ট্রও জনগণের হবে না। তাই রাষ্ট্রের চরিত্রকে বদলাতে হবে সর্বাগ্রে। শোষক পুঁজির মালিকানা ভেঙে রাষ্ট্রকে নিয়ে আসতে হবে জনগণের মালিকানায়। লিখতে হবে নতুন খতিয়ান। তখনই কেবল পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু। মানুষ তখন পোশাকের দিকে নয়, তাকাবে পোশাকের ভেতরের মানুষটার দিকে।

মোশতাক আহমেদ: কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, জাতিসংঘ

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য ক ষমত আওয় ম বদল ত ক বদল বদল ছ

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনীতির নীতিহীনতা

আমাদের দেশে পার্টির শেষ নেই। নানান পার্টি। একেকটির একেক চরিত্র—চান্দা পার্টি, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, গ্যাঞ্জাম পার্টি, ফার্স্ট পার্টি, থার্ড পার্টি, ব্যান্ড পার্টি। আছে নানান নামের পলিটিক্যাল পার্টি। এদের মধ্যে আবার ওয়ানম্যান পার্টিও আছে। তবে যে হারে পার্টির সংখ্যা বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে নতুন পার্টির নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

এমনই এক পার্টির নেতার কল্পিত সাক্ষাৎকার, যেখানে সাংবাদিকের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘এই যে আপনি পার্টি করেছেন, সারা দেশের মানুষ তো আপনাকে চিনবে না।’ নেতা সগর্বে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন—

: আপনি কোন যুগে বাস করেন, ভাই? আপনি খালি বলেন, আপনিও একটা পার্টির জন্ম দেবেন, দেখবেন কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক শ ক্যামেরা হাজির হয়ে গেছে। ব্রেকিং নিউজ হবে, বিভিন্ন চ্যানেলের স্ক্রলে আপনার নাম যাবে, টক শোতে ঘন ঘন ডাক পড়বে। প্রচারের জন্য আপনাকে কিছুই করতে হবে না, তারাই নানা রং লাগিয়ে সুন্দর সুন্দর শিরোনামে নিউজের সঙ্গে সঙ্গে কনটেন্টও ছাড়বে। সারা দেশে পয়সা ছাড়া খবর পৌঁছে যাবে।

: কিন্তু রাজনীতিতে তো খরচাপাতি আছে?

: এইটাও কোনো সমস্যা নয়, মতলববাজ ব্যবসায়ীরা বসে আছে ইনভেস্ট করার জন্য। সুতরাং টাকার অভাব হবে না।

: তারা টাকা দেবে কেন, তাদের লাভ?

: তারা দান করবে, আপনি তাদের কুকীর্তির লাইসেন্স প্রদান করবেন।

: কিন্তু দল করে আপনার লাভ?

: আমি নেতা হলাম। কথা বললেই নানান রঙের কয়েক ডজন মাইক্রোফোন আমার সামনে সাজানো থাকবে। ম্যালা চ্যানেল তো, ওদেরও খবর দরকার। ভোট পাই না পাই, আজকাল কিন্তু ‘ওয়ানম্যান পার্টি’রও কদর আছে। একসময় এদের অনেকে মন্ত্রীও ছিলেন। ওনারা জোটে যান, তবে ভোটে হারেন।

গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। তাই ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে নীতিমান রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে কথা নয়, কাজ দিয়ে। যাতে সুসময়েই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে

: কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে যদি সমস্যায় পড়েন?

: সুর চেঞ্জ করে ফেলব। স্ট্রেট পল্টি।

: নির্বাচন এলে কী করবেন?

: এই চামড়ার মুখে যত প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব সব দেব।

: কিন্তু প্রতিশ্রুতি যদি রক্ষা না করেন?

: জনগণ জানে, নির্বাচনের আগে অনেকেই অনেক কথা বলে। ওই সব মনের কথা নয়, মুখের কথা। জনগণ এসব বিশ্বাস করে না।

: জনগণ কি আপনার সঙ্গে আছে?

: আছে কি না জানি না, তবে সবাই সবকিছুই জনগণের ওপর দিয়া চালিয়ে দেয়, আমিও দিলাম। রাজনীতির নীতি কজন মেনে চলে?

আসলেই রাজনীতি করলে একটি নীতির প্রশ্ন আসে। সেই নীতির প্রতি কতজনের প্রীতি আছে, কতজনের ভীতি আছে, আর কজন সেই নীতিকে ইতি করে দিয়েছেন, সেই ইতিহাস অনেকেরই জানা।

যাঁরা এই রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেন, তাঁরা নেতা। তবে এই নেতা ও নীতিকে অনেকে সমার্থক করে ফেলেন। মনে রাখতে হবে, নেতার কথাই নীতি নয়, নীতির ধারক হচ্ছেন নেতা। তবে আমাদের এখানে অনেক নেতার প্রিয় নীতির নাম দুর্নীতি, যা মহামারির রূপ ধারণ করেছে।

নীতি শব্দের আগে ‘দু’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে শব্দটি তৈরি হয়েছে। যা অন্যায়, অনিয়ম, নীতিবিরুদ্ধ, সেটাই দুর্নীতি। দুর্নীতির প্রধান কারণ হচ্ছে লোভ।

অক্সফোর্ড গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঙ্ক বুকম্যান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে বটে; কিন্তু সবার লোভ মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।’ এই লোভের কারণে অনেকেই দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। দেখা দেয় আর্থিক বিশৃঙ্খলা। ফলে দুর্নীতির গতি আর নীতির দুর্গতি অতিশয় ক্ষতির প্রভাব ফেলে সর্বত্র। কারণ, মানুষ তাকেই ভালোবাসে, যার নীতি ও আদর্শ আছে। সে জন্য রাজনীতিতেও দেখা যায় কেউ গালি খায়, কেউ তালি পায়।

কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কথা চিন্তা করুন। ভদ্রলোক প্রায় ১০ বছর শাসনক্ষমতায় ছিলেন। তারপর পদত্যাগ করলেন, কিন্তু দেশত্যাগ নয়। বরং পদত্যাগের পর তিনি নির্ভয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষের মতো। বিভিন্ন শপে গিয়ে কেনাকাটা করছেন। সেই ছবিও ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। ট্রুডোর এই জীবনযাত্রা থেকে অনেক রাজনীতিবিদেরই অনেক কিছু শেখার আছে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক ময়দানে খুব গুরুত্বপূর্ণ নেতা কিংবা ব্যক্তির ভাষণ দেওয়ার আগে নানান বিশেষণ দেওয়া হয়, যেমন এবারে ‘ঐতিহাসিক ভাষণ’ দেবেন ‘সংগ্রামী জননেতা’, ‘বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর’, ‘জ্বালাময়ী বক্তা’...ইত্যাদি। সব বিশেষণ লিখতে গেলে লেখা বড় হয়ে যাবে। এসব শব্দ এখন আর তেমন গুরুত্ব বহন করে না।

এখন যে কারও ভাষণকে ঐতিহাসিক ভাষণ, যত ফ্যাসফেসে কণ্ঠই হোক না কেন, বলা হয় বলিষ্ঠ কণ্ঠ। তবে জ্বালাময়ী শব্দটির সঙ্গে আমি একমত। কারণ, বেশির ভাগ রাজনৈতিক ভাষণই এখন জ্বালাময়ী, যা শুনলে আমাদের শরীরে জ্বালা ধরে যায়। যদিও রাজনৈতিক এসব জ্বালাযন্ত্রণার মধ্যেই আমাদের বসবাস।

রাজনীতিতে মনোনয়ন-বাণিজ্য ও ভোট বিক্রি অত্যন্ত গর্হিত একটি দুর্নীতি। নির্বাচনী প্রচারণা যেমন ব্যয়বহুল, নির্বাচনে মনোনয়নও একটি লেনদেনভিত্তিক প্রক্রিয়া, যা একধরনের রাজনীতির নীতিহীনতা। আসছে নির্বাচন—ভয়, না জানি কোন মাত্রায় এই লেনদেন হয়!

দুর্নীতিপ্রেমিক রাজনীতিবিদেরা তাদের নানান কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায়, যা নিয়মনীতির চূড়ান্ত লঙ্ঘন। ফলে প্রতিবাদে জেগে ওঠে জনতা। আর জনতা জাগলে এই ধরাকে সরা জ্ঞান করা অরাজকদের পরাজিত হতে হয়। আর এই পরাজিত শক্তির কী পরিণতি হয়, তা তো আমরা স্বচক্ষে দেখেছিই। এসব কারণেই হলো অভ্যুত্থান, গঠিত হলো নতুন সরকার। একের পর এক চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় সরকারের সামনে। দিন যতই যায়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ছোট ছোট গোষ্ঠী নতুন নতুন দাবি নিয়ে হাজির হয়। এসব আন্দোলনকারীর কাছে যেন জিম্মি হয়ে পড়ে সরকার। জিম্মি হয় সাধারণ মানুষ।

ক্ষোভ, বিক্ষোভ, অনশন, অবস্থান, মানববন্ধন, কর্মবিরতিসহ নানান কর্মসূচিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশ, দেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সবকিছুই। রাজনৈতিক অচলা অবস্থা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। পরিস্থিতি ঠেকাতে সিরিজ বৈঠক করেও সময়মতো সুরাহা হয় না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির দিকে যেন কারোরই নজর নেই। শাহবাগ থেকে যমুনা আন্দোলনের নতুন ঠিকানা।

একসময় পুলিশের গাড়ি দেখলেই আন্দোলন-মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত। আর এখন পুলিশ যেন দর্শক। হাতে লাঠি থাকলেও অন্যায়ের পিঠে ওঠে না। দেখে মনে হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের কোনো কাজ নেই। চারদিকে মবের ভয়, না জানি কখন কী হয়। এই মব কারও কাছে ভায়োলেন্স, কারও কাছে জাস্টিস। সুযোগসন্ধানীরা তৎপর। চান্দাই যেন এখন বড় ধান্দা। যে যেভাবে পারছে এই সুযোগে কার্য উদ্ধার করছে।

বৈশাখ গেল, দুটি ঈদ গেল। নানা রকম কর্মসূচি হলো। কেউ আনন্দ পেল, কেউ কষ্ট পেল, কেউ কেউ সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। চরিত্র পাল্টানোর প্রতিযোগিতায় অনেকেই এগিয়ে গেল। দিন যতই যাচ্ছে, ‘দালাল’-জাতীয় ব্যক্তিদের জায়গা শক্ত হচ্ছে। মিশে যাচ্ছে পরিবর্তনের স্রোতে। মুখোশ পাল্টে সাজছে ভালো মানুষ। এই কাতারে শিল্পী, সাংবাদিক, আমলা, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই আছেন। সাধারণ মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে এসব সার্কাস দেখছে।

এই করতে করতে শুরু হলো নির্বাচন-যুদ্ধ। ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে সরকারি অবস্থানের পক্ষ নিল কেউ কেউ। কেউ আবার চরম বিপক্ষে। গণতন্ত্রের জন্য সোচ্চার আওয়াজ। কিসের গণতন্ত্র? কেমন গণতন্ত্র? যারা গণতন্ত্রের জন্য মাঠ গরম করছে, তারা কি আচার-আচরণ কিংবা দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক?

কর্মীরা রাজপথে থাকে, নীতিনির্ধারণে তাদের ভূমিকা নেই। ফলে সংসদেও দেখা যায় তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতিফলন। রাজনৈতিক দলের কাজ কী? শাসন? দখল? দুর্নীতি? নাকি জনগণের সেবা? তারা কার কাছে জবাবদিহি করবে? জবাবদিহি শব্দটাই যেন উধাও। তাই সংসদে স্পিকারের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে কিংবা ‘না’ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘না’ জয়যুক্ত হয়েছে। ‘হ্যাঁ’-কে ‘না’ বলার কিংবা ‘না’-কে ‘হ্যাঁ’ বলার সাহস কারও নেই। ফলে হাতের তালুতে আঘাত পেলেও সব শক্তি ঢেলে টেবিল চাপড়ে সম্মতি বা অসম্মতি জানায়।

ডিসেম্বরে, নাকি ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন, এ নিয়ে তর্কবিতর্ক, শোডাউন আর টক শোর দাপটে বাজার গরম হয়ে ওঠে। কেউ বলেন বিচার সময়সাপেক্ষ আর সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং এর ওপর নির্ভর করে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা যাবে না।

ঈদের সময় ঘোষিত হলো, এপ্রিলের শুরুতে হবে নির্বাচন। ব্যস, শুরু হয়ে গেল মিটিং-মিছিল, ‘মানি না মানি না’ স্লোগান। আর কেউবা ঘোষিত সময়ের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করলেন। কিন্তু ‘মানি না’ দলের শোডাউন বেশ জুতসই হওয়ায় জাতি চিন্তিত হয়ে পড়ল—আমাদের ভাগ্যে কি আদৌ নির্বাচন আছে? আবারও খই ফোটা শুরু হলো টক শোতে। শুধু টিভি চ্যানেলেই নয়, ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলেও টক শো, দর্শক শো, নেতা শো, সাংবাদিক শো—শোয়ের শেষ নেই। একই ব্যক্তির নানান নামে নানান শো চলতে থাকে। মাঝেমধ্যে চিন্তা হয়, মানুষ এত কথা বলে কী করে? কারণ ব্যবসা। যত কথা তত ভিউ, যত ভিউ তত ব্যবসা। অর্থাৎ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা যত বাড়ে, অশান্তি যত বাড়ে, টক শোর টক এবং টকারও তত বাড়ে।

একই ব্যক্তি কত ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়ে দিচ্ছেন, কী হলে কী হবে, কী না হলে কী ঘটবে। কী উচিত, কী অনুচিত। একজন অভিনয়শিল্পীর চেয়ে ‘টক’-শিল্পীদের পর্দায় উপস্থিতি বেশি, ফলে তারাও অভিনয় তারকার মতো ‘টক’ তারকা। সময়ের পরিবর্তনে টকারও বদলেছে। কিছু পুরোনো মুখের প্রস্থান, নতুন মুখের আগমন ঘটেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন চলন্ত গাড়িতে ব্রেকের মতো সবকিছুই থেমে গেল। কারণ লন্ডনের একটি বৈঠক, যেখানে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেল। এই ইঙ্গিতে রাজনৈতিক রণসংগীতের সমাপ্তি ঘটল।

রাজনৈতিক তর্জনগর্জনে কিছুটা বিরতি দেখা দিলে টকাররাও চিন্তিত হয়ে পড়লেন টক শো চলবে কী করে? সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে কী নিয়ে কথা বলবেন? ইস্যু কী? অনুসন্ধানে বেরিয়ে এল এক নতুন ইস্যু। নির্বাচনের তারিখের মধ্যে খোঁজ পাওয়া গেছে দুটি শব্দ ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’। ব্যস, আবার গরম হয়ে উঠল টক শোর আসর। এটা যদি সেটা হয়, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। ‘যদি’, ‘কিন্তু’ থেকে এখন আবার তারিখ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। শুরু হয়েছে কূটনৈতিক তৎপরতা। টক শোতে নতুন সুর।

কথায় আছে, ‘কথায় কথা বাড়ে’, কেউ আবার এই কথা ধরে ভিন্ন অর্থ করে। ‘যত মত তত পথ’—এটি একসময় ছিল সুবচন। সেই বচনে পচন ধরলে মূল অর্থের চেয়ে ভুল অর্থের আশঙ্কাই বেশি।

‘কথা কম কাজ বেশি’—বাক্যটি অনেকেই মনে রাখতে পারেন না। তাই তর্কে কেউ কারও কাছে হারেন না। অনেকে এটাও ভুলে যান যে শ্রোতাদের মধ্যেও তাঁদের চেয়ে জ্ঞানী বা গুণী মানুষ থাকতে পারে। এমন মানুষও থাকতে পারে, যাদের কাছে এসব কথার কোনো মূল্য নেই, প্রয়োজনও নেই। কারণ, তারা উদয়াস্ত জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত।

তবে ভবিষ্যতে একটি ভেজালবিহীন নির্বাচনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। তাই ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে নীতিমান রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে কথা নয়, কাজ দিয়ে, যাতে সুসময়েই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

হানিফ সংকেত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন কর‌তে দে‌ব না: হেফাজ‌ত
  • জামায়াতের জাতীয় সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে মহানগরী জামাতের মিছিল
  • ‘জুলাই ঘোষণাপত্রকে’ সংবিধানের মূল নীতিতে স্বীকৃতি দেওয়ার পদক্ষেপের নিন্দা রিজভীর
  • পাথর মেরে হত্যা, আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে: জামায়াত
  • খাল কেটে কুমির আনার অধিকার সরকারকে কেউ দেয়নি: জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় নিয়ে মামুনুল হক
  • বিচার-সংস্কার ছাড়া জনগণ নির্বাচন মানবে না: নাহিদ
  • বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন
  • শক্তিশালী নির্বাচিত নির্বাহী বিভাগ কেন জরুরি
  • রাজনীতির নীতিহীনতা
  • খুলনায় এনসিপির সমাবেশে ২০ হাজার লোক সমাগমের প্রস্তুতি