Samakal:
2025-06-18@21:17:54 GMT

পোশাক বদলালেই কি পুলিশ বদলাবে?

Published: 4th, February 2025 GMT

পোশাক বদলালেই কি পুলিশ বদলাবে?

পোশাক তো বদলাতেই হয়। ধুলোবালিতে নোংরা হলে বদলাতে হয়; আবহাওয়া অনুযায়ী বদলাতে হয়; হাল ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়েও বদলাতে হয়। ষাটের দশকের শেষ দিকে ‘টেডি’ পোশাক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল; সত্তরের দশকে ‘বেলবটম’। এখন আর সেসব কেউ পরে না। ফ্যাশন বদলেছে; বদলেছে পোশাক। মানুষ কিন্তু তেমনই আছে; বদলায়নি। কেউ কেউ অবশ্য বদলেছে; পোশাকের কারণে নয়; বদলেছে অন্তর্সত্তা। আসলে মানুষের বদলটা ঘটে ভেতর থেকেই; পোশাক থেকে নয়।

ইদানীং কথা চলছে পুলিশ বাহিনীর পোশাক বদলের। অনেক জল্পনাকল্পনার পর চূড়ান্ত হয়েছে নতুন পোশাক। ২০ জানুয়ারি সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে এমনটিই জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.

) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা রকমের মন্তব্য চলছে। কেউ কেউ বলছেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে পুলিশ বাহিনীর আচরণের কারণে পোশাকের পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছিল। কেউবা আবার এতে ষড়যন্ত্রের আভাসও দেখছেন।

যতটুকু জানা যায়, ২০২০ সাল থেকেই পুলিশের বর্তমান পোশাক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা চলছিল। ২০২১ সালের শুরুর দিকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের জন্য বেশ কয়েকটি পোশাকের ট্রায়ালও হয়। তার পরও নানা কারণে নতুন পোশাক পাননি পুলিশ সদস্যরা। এরই মাঝে পতন ঘটে গেছে সরকারের। ধরে নেওয়া যায়, আগের সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায়ই বর্তমান সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে।
অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশে পুলিশের ইউনিফর্মের রং ছিল খাকি। ব্রিটিশ অফিসার স্যার হ্যারি লুমসডেনের পরামর্শে ১৮৪৭ সালে এটি চালু হয়। তার একশ বছর পর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান হয়েছে; কিন্তু পুলিশের পোশাকের রং খাকিই রয়ে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশেও খাকি রং চালু ছিল। 

বাংলাদেশ পুলিশের পোশাকে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ২০০৪ সালে; মহানগরগুলোয় হালকা জলপাই রং, জেলা পুলিশের গাঢ় নীল। র‍্যাবের কালো ও এপিবিএনের পোশাক তৈরি করা হয় খাকি, বেগুনি আর নীল রঙের মিশ্রণে। এমনকি ২০০৯ সালেও কিছুটা পরিবর্তন আসে। প্রতিবারই এর পেছনে ‘অকাট্য যুক্তি’ দেখানো হয়েছে।
যে যুক্তিতেই পুলিশের পোশাক পরিবর্তন হোক না কেন; গত অর্ধশতাব্দীতে পুলিশের আচরণে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন এসেছে? উনিশ শতকের মাঝামাঝি আনুষ্ঠানিক যাত্রার সময় থেকেই পুলিশ বাহিনী শাসক শ্রেণির লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে যেহেতু আজকের মতো রাজনৈতিক ‘ক্যাডার’ ছিল না; পুলিশই ছিল শাসক শ্রেণির ভরসা। পুলিশ কাজটি দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে গেছে। 

আশা করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর অন্তত স্বাধীন দেশের উপযোগী পুলিশ বাহিনী গড়ে উঠবে। কিন্তু তা ঘটেনি। না ঘটারই কথা। কারণ স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে শাসক বদলালেও শাসকের শ্রেণি বদলায়নি। শাসক শ্রেণি তার শ্রেণিস্বার্থেই তা হতে দেয়নি। সেই হিসাবে বলা যায়, যতদিন শাসক শ্রেণির চরিত্র বদল না হবে; পুলিশের গুণগত পরিবর্তন আশা করা বাহুল্য হয়েই থাকবে।

বলা হয়– পুলিশ জনগণের বন্ধু। বন্ধুই তো হওয়ার কথা! কিন্তু হতে পারেনি। হতে দেওয়া হয়নি। কারণটা খুবই স্পষ্ট। রাষ্ট্র নিজেই যেখানে শোষণের মাধ্যম, পুলিশ যে মাধ্যমের হাতিয়ার; সেখানে পুলিশ জনগণের বন্ধু হয় কেমন করে? মানুষ আসলে পুলিশকে ভয় পায়; যেমন ভয় পেয়েছে ব্রিটিশ আমলে, তেমনি পাকিস্তান আমলে। এখনও তেমনটিই চলছে। ভয়কে জিইয়ে রেখে বন্ধু হওয়া যায় না। কিন্তু পুলিশের প্রতি এই ভয়টা শাসক শ্রেণির খুব প্রয়োজন। প্রয়োজন ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। গণতন্ত্রহীন কিংবা দুর্বল গণতন্ত্রের দেশে পুলিশ কখনও জনগণের বন্ধু হতে পারে না।
আমাদের দেশে সুবিদিত, পুলিশকে ম্যানেজ করতে পারলে অনেক কিছু ম্যানেজ করা যায়। পুলিশ হাতে থাকলে নির্বাচনে জেতা যায়; প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা যায়; জমির দখল নেওয়া বা উচ্ছেদ করা; ইত্যাকার কাজ! এ কারণে প্রবল পরাক্রমশালী মন্ত্রী-এমপিরা পর্যন্ত পুলিশকে সমঝে চলেন। চলতে তারা বাধ্য। কারণ স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে জনগণের ক্ষমতায়নও ঘটেনি। সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক; জনগণ কেবলই ‘প্রজা’। আসল রাজা ‘রাষ্ট্র’। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোতে আরোহণে পুলিশের সহযোগিতা অনিবার্য।
নিজেদের অনিবার্যতা সম্পর্কে পুলিশও বিলক্ষণ সচেতন। তাই তারাও সুযোগ গ্রহণ করে। কিছুদিন আগেই কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলায় বিএনপির কর্মিসভায় হাজির হয়ে নিজেকে আওয়ামী লীগ আমলে নির্যাতিত দাবি করে বক্তৃতা করলেন থানার ওসি মঈনুল ইসলাম (সমকাল, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪)। বোঝাতে চাইলেন, তিনি বিএনপির লোক। 

মঈনুল ইসলাম মনে করেছেন, রাজনীতির যে অবস্থা, তাতে আগামী নির্বাচনে বিএনপিরই ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই তিনি এখন থেকেই ভবিষ্যতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন। এ ধরনের কাজ আমরা আওয়ামী লীগ আমলেও দেখেছি। পুলিশ সদস্যরা আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জন্য ভোটের প্রচারণা করেছেন। বিরোধী দল মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করেছেন। 
২০২৩ সালের আগস্টে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানার ওসি তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের জন্য প্রকাশ্যেই ভোট চেয়ে বক্তৃতা করেছিলেন। একই কাজ করেছিলেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থানার ওসি। তিনিও আওয়ামী লীগকে নিজের দল দাবি করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে বক্তব্য দেন। এসব খবর সে সময়কার পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু সরকার তা গায়ে লাগায়নি। কেনইবা লাগাবে! সরকারি দল আর পুলিশ– ইতিহাসের সব পর্যায়েই মিলেমিশে রাষ্ট্র নামে শোষণযন্ত্রকে পাহারা দিয়ে আসছে। সম্পর্কটি তাই সিমবায়োটিক; দু’পক্ষই লাভবান তাতে। যতদিন এই সম্পর্ক ভাঙা না যাবে, পোশাক বদলে কোনো কাজ হবে না।

মোদ্দাকথা, পোশাকের ক্ষেত্রে যতই পরিবর্তন আনা হোক; রাষ্ট্র নিজে যতদিন জনগণের বন্ধু না হবে, ততদিন পুলিশও বন্ধু হবে না। হতে পারবে না। সবার আগে তাই রাষ্ট্রকে জনগণের হতে হবে। কিন্তু চরিত্র না বদলালে রাষ্ট্রও জনগণের হবে না। তাই রাষ্ট্রের চরিত্রকে বদলাতে হবে সর্বাগ্রে। শোষক পুঁজির মালিকানা ভেঙে রাষ্ট্রকে নিয়ে আসতে হবে জনগণের মালিকানায়। লিখতে হবে নতুন খতিয়ান। তখনই কেবল পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু। মানুষ তখন পোশাকের দিকে নয়, তাকাবে পোশাকের ভেতরের মানুষটার দিকে।

মোশতাক আহমেদ: কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, জাতিসংঘ

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য ক ষমত আওয় ম বদল ত ক বদল বদল ছ

এছাড়াও পড়ুন:

স্থানীয় স্বশাসন জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য অপরিহার্য

গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হতে চলেছে। ‘বিচার’, ‘সংস্কার’, ‘নির্বাচন’– এই তিনটি বিষয় এখন ‘টক অব দ্য নেশন’। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে যে যুগান্তকারী সংস্কার ও বিশাল সম্ভাবনা জন্ম নিয়েছিল, সেই পথে স্বাধীন দেশ এগোয়নি। তবে এই বঞ্চনার জন্য ‘একাত্তর’-এর স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পথ দায়ী নয়। বরং সেই ‘ব্যবস্থা’ ও ‘বন্দোবস্ত’ থেকে দেশকে দূরে নিয়ে যাওয়ার কারণেই আজ স্বপ্নভঙ্গ-রুগ্‌ণতা-অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তা থেকে পরিত্রাণের জন্যই জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। যেনতেন ‘সংস্কার’ দ্বারা এই পরিত্রাণ সম্ভব হবে না। এসব নিয়ে গভীর আলোচনা প্রয়োজন। আজ শুধু সংস্কারের ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে ওঠা, রাষ্ট্র, প্রশাসন সমাজের ‘গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ’ তথা জনতার অধিকতর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে স্বশাসিত সংস্থার ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার বিষয়টি সম্পর্কে কিছু আলোচনা।

সমাজে স্থানীয় স্বশাসনের ব্যবস্থাটি সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত। রাজা-মহারাজারা রাজ্য চালাতেন। রাজ্যের-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ভাঙাগড়া চলত। এসবের মাঝেই শান্ত লয়ে আপন তালে প্রবাহিত হতো গ্রামভিত্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক-সামাজিক-প্রশাসনিক এককগুলো। অনেকেই একে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ বলে বিশেষায়িত করেছেন। গ্রামের এই ফল্গুধারায় লালিত হতো তারই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়ে ওঠা বিশেষ ধরনের স্থানীয় স্বশাসিত ব্যবস্থার গণসংস্থাগুলো। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভগ্নরূপে টিকে থাকা মাতবর, সর্দার, পঞ্চায়েত ইত্যাদির মধ্যে সেই প্রাচীন ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি কিছুটা খুঁজে পাওয়া যেত।

যুগ যুগ ধরে চলে আসা সেই স্বশাসিত স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার ওপর প্রথম বড় ধাক্কা আসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রসারিত করার রাজনৈতিক প্রয়োজনে তারা বিদ্যমান স্থানীয় স্বশাসন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিয়েছিল। সেই উদ্দেশ্যে ১৮৮৫ সালে প্রবর্তিত হয় ইউনিয়ন বোর্ড। এগুলোকে পরিণত করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ‘স্থানীয় চৌকি’তে। তবে যেসব কাজ প্রাচীনকাল থেকে স্বশাসিত সংস্থাগুলো পরিচালনা করত, ইউনিয়ন বোর্ড সেসব কাজও করত।
ব্রিটিশদের সৃষ্ট ইউনিয়ন বোর্ড, জেলা বোর্ড ইত্যাদির উত্তরাধিকার বহন করেই সমকালীন ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদের গঠনধারা রচিত। আইয়ুব আমলে মৌলিক গণতন্ত্র চালুর নামে এদের দলীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার আরও গভীরে টেনে আনা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর সংবিধানে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সেসব বিকৃতি দূর করে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মর্মবাণীর ভিত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানের সেই বিধান আজও বাস্তবায়িত হয়নি। যে গায়েবি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্রের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ আগাগোড়া ছিল ও রয়েছে, তারা তা বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। এখনও তারাই তা হতে দিচ্ছে না।

তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র স্থানীয় স্তরসহ সর্বত্র প্রধান ‘প্লেয়ার’ হিসেবে থাকায় একদিকে আমলাতন্ত্র, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রভৃতি বড় বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো স্থানীয় সংস্থার ওপর কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট থেকেছে। বিভিন্ন ভাতা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক নিয়োগ, রাস্তা-কালভার্টসহ নানা প্রকল্পের কাজ স্থানীয় সংস্থার মাধ্যমে করতে হয়। এগুলোই ‘পাওয়ার’ দেখানোর ‘আসল’ জায়গা। তাই আমলা ও এমপিরা একেবারেই নারাজ এসব বিষয়ে তাদের বিদ্যমান কর্তৃত্ব ছাড়তে। এই পাওয়ারের সঙ্গে রয়েছে আর্থিক স্বার্থের ব্যাপারও। সেটা তারা স্বেচ্ছায় হাতছাড়া করতে রাজি নন।
এমপিরা মনে করেন, তারাই ‘আসল’ নির্বাচিত প্রতিনিধি; মেয়র বা চেয়ারম্যানরা আবার কে? শেষোক্তরা নির্বাচিত, তবে সেই নির্বাচন ‘কম দামের’। তাই জনগণের প্রতিনিধি হলেও তারা এমপিদের ‘জুনিয়র’ পার্টনার মাত্র। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কর্তাদের ভাবনা হলো, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিতরাও যেহেতু ‘সরকার’, তাই তারা দেশের ইউনিটারি (এককেন্দ্রিক) সরকার ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের স্থানীয় শাখা মাত্র। সেসব জনপ্রতিনিধিকে তাই আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে ওপর থেকে নিচ বরাবর প্রবাহিত ‘আসল’ সরকারের কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে কাজ করতে হবে। বলা যায়, দুই গালে দুই তরফের বিরাশি সিক্কা ওজনের চপেটাঘাত খেয়ে দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অবস্থা আজ চিৎপটাং হওয়ার মতো। 
যুক্তি দেওয়া হয়, এককেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামোর দেশে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব একক কেন্দ্রে থাকাই স্বাভাবিক। তাই কেন্দ্রের হাতে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা সংরক্ষণ নিশ্চিত করার পর অবশিষ্ট ক্ষমতা যদি কিছু থাকে, কেবল সেটুকুই স্থানীয় সরকারের হাতে অর্পণ করা যেতে পারে।

এরূপ প্রস্তাবনার বিপরীত ধারণা হলো, সংবিধানমতে– ‘প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ’। তাই ক্ষমতার প্রধান ভিত্তি হতে হবে জনগণের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা তৃণমূলের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো। এসব সংস্থা বাস্তব প্রয়োজনে কিছু অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ (প্রতিরক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, জ্বালানি-খনিজ-বিদ্যুৎ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক সম্পর্ক ইত্যাদি) বিষয়ের কর্তৃত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে স্বেচ্ছায় প্রদান করবে। এ ধারণা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার হলো স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর কাজের সহায়ক ঊর্ধ্বতন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ। 
সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি শীর্ষক অংশের ৯ নম্বর ধারায় লেখা হয়েছে, ‘...রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিগণ সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহ দান করিবেন...।’ ‘সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধি’ এবং তাদের ‘সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান’ শব্দগুলো থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির মর্মকথা স্পষ্ট হয়ে যায়। তারপর ১১ নম্বর ধারায় গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘...এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এখানে বিষয়টি আরও সুনির্দিষ্ট হয়েছে ‘সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে’ শব্দগুলো ব্যবহারের দ্বারা।

সংবিধানের চতুর্থভাগের (নির্বাহী বিভাগ সংক্রান্ত ভাগ) তৃতীয় পরিচ্ছেদে ‘স্থানীয় শাসন’ শীর্ষক অংশের ৫৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনভার প্রদান করা হইবে।’ এ থেকে স্পষ্ট– ইউনিয়ন স্তরে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা স্তরে উপজেলা পরিষদ, জেলা স্তরে জেলা পরিষদ ইত্যাদির ওপর সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় শাসনভার অর্পিত হবে। উক্ত কোনো স্তরের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেই সংসদ সদস্য অথবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে কর্তৃত্ব প্রদানের প্রশ্ন আসতে পারে না।
স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে তাদের মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্তির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এমন আইন করতে হবে যেন জাতীয় বাজেটের ৩০% থেকে ৪০% সরাসরি এসব প্রতিষ্ঠানের হাতে যায়। একটি স্বাধীন সংস্থা থাকতে পারে যে, এসব প্রতিষ্ঠানের কে কতটুকু অর্থ পাবে তা নির্ধারণ ও বরাদ্দ করবে। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ‘নিচের স্তর থেকে উপরমুখী’ ধারা প্রযুক্ত হবে, উন্নয়ন দর্শনে যা অধিকতর বাস্তবসম্মত ধারা হিসেবে বিবেচিত।

দেশের বুর্জোয়া দলগুলো লুটেরা ধনতন্ত্রের যে ধারায় দেশ চালাচ্ছে তার সঙ্গে জনগণের স্বার্থের মৌলিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাই জনগণের ক্ষমতায়ন ও সেই লক্ষ্যে ক্ষমতার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ বুর্জোয়া দলগুলোর স্বার্থের পরিপন্থি। স্বশাসিত স্থানীয় সরকারের ইস্যুটি তাই স্পষ্টতই লুটেরা ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমাজ বিপ্লব সংগঠিত করার কর্তব্যের সঙ্গে জড়িত। অন্যান্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের ইস্যুতেও তাই সমাজ বিপ্লবীদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সংগ্রাম করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেটুকু পার্লামেন্টারি সংগ্রাম চালানোর সুযোগ আছে তা নিতে হবে, নিঃসন্দেহে। তবে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রকের অবস্থানে অধিষ্ঠিত করার জন্য এবং সেগুলোর প্রকৃত ক্ষমতা প্রসারিত করার জন্য সমাজ বিপ্লবের কর্মীদের গণসংগ্রামও চালিয়ে যেতে হবে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা ‘অনেকের পছন্দ হয় নাই’: মির্জা ফখরুল
  • নেতানিয়াহুকে অভিযান চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করছি: ট্রাম্প
  • লন্ডনের বৈঠক পছন্দ না হওয়ায় আলোচনায় আসেনি একটি দল: মির্জা ফখরুল
  • স্থানীয় স্বশাসন জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য অপরিহার্য
  • ‘মিমির মানবিক আচরণে চোখে পানি চলে এসেছিল’
  • ১১৮ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
  • ‘হায়া’ মানে শুধু শালীনতা নয়
  • এ পর্যন্ত ১১৮ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
  • যুবকদের মসজিদমুখী করার ৫টি উপায়
  • ইশরাক হোসেনের কাছে দায়িত্বশীল ও পরিপক্ব আচরণ প্রত্যাশা করব: উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ