চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়ার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম গেল ২৪ জানুয়ারি জুমার নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। চাহিদামতো চাঁদা না দেওয়ায় ১২ জনের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে ফেলে তাঁকে। এর কিছুদিন আগে কদলপুরে গুলি করা হয় আনোয়ার হোসেন বাচলুকে। মাথা ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তাঁর একটি পা নিশ্চল হয়ে আছে এখনও। নোয়াপাড়ায় সংঘর্ষের আরেক ঘটনায় পায়ে গুলি করা হয় মোহাম্মদ সুজনকে। সেই পায়ে এখন আর শক্তি পাচ্ছেন না সুজন। একইভাবে গুলি খেয়ে হাত অবশ যুবদল নেতা ফরিদের। 

গত ৫ আগস্টের পর খুন, অপহরণ, মারামারি, গোলাগুলির এক মহারণ চলছে চট্টগ্রামের রাউজানে। এ সময়েই অর্ধশত হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। মামলা হয়েছে ৩২টি। তবে গ্রেপ্তারের সংখ্যা মাত্র ৮। প্রতি ঘটনার নেপথ্যে উপজেলা বিএনপির ‘বড় দুই নেতা’ জড়িত থাকায় সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারে ‘আগ্রহ’ নেই পুলিশের।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সাড়ে ১৫ বছর রাউজানে ছড়ি ঘুরিয়েছেন সে সময়ের এমপি আওয়ামী লীগ নেতা ফজলে করিম চৌধুরী। গত ৫ আগস্ট পালাবদলের পর কারাবন্দি হন ফজলে করিম। তাঁর সাম্রাজ্য দখলে নিতে মরিয়া এখন উত্তর জেলা বিএনপির প্রভাবশালী দুই নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খন্দকার। এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে এ দুই নেতার নির্দেশে তাদের অনুসারীরাই বিবাদে জড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। চলছে হামলা-পাল্টা হামলা, হচ্ছে অপহরণ। এ জন্য উভয় নেতার কাছে সন্ত্রাসীরা এখন পাচ্ছে ‘ভিআইপি মর্যাদা’! ফজলে করিমের একসময়ের পালিত সন্ত্রাসী আজিজ উদ্দিন ও ইমন যোগ দেন গিয়াস কাদের গ্রুপে। ইকবাল ও জমিরের জায়গা হয় গোলাম আকবর গ্রুপে। এ সন্ত্রাসীদের হাতে আছে বিপুল অস্ত্র। আজিজ উদ্দিনের নামে হত্যা, অপহরণসহ ১৮ মামলা রয়েছে। ইকবাল ১২ মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। একটি হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বলে পুলিশ জানিয়েছে। 

চাঁদা না দেওয়ায় খুন

গত ২৪ জানুয়ারি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। সিসিটিভির ফুটেছে দেখা যায়, এই কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছে ১২ সন্ত্রাসী। জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই দিদার আলমের দাবি, সন্ত্রাসীদের চাঁদা না দেওয়ায় তাঁর ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই খুনের জন্য বিএনপির দু’গ্রুপ একে অপরকে দুষছে। গিয়াস কাদের সমর্থিত নোয়াপাড়া ইউনিয়নের বিএনপি নেতা কামাল উদ্দিন বলেন, গোলাম আকবর সমর্থিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সৌদিপ্রবাসী আজিজুল হক ও কারাবন্দি জানে আলম তাদের অনুসারী সন্ত্রাসীদের দিয়ে ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার ১০ দিন পর গত সোমবার ২৫-৩০ জনকে আসামি করে রাউজান থানায় মামলা হয়েছে। তবে গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। এদিকে রাউজানে হত্যা, সংঘর্ষ ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আজ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে গিয়াস কাদের অনুসারীরা।

অর্ধশত সংঘর্ষে আহত শতাধিক

৫ আগস্টের পর রাউজানে বিএনপির দু’গ্রুপের মধ্যে অর্ধশত হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২৬টি সংঘর্ষের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। সর্বশেষ ১৯ জানুয়ারি গ্রুপের মধ্যে দু’দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে উপজেলা সদরে। উপজেলা বিএনপি ও পৌর কমিটি গঠন নিয়ে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ৬ ডিসেম্বর বিজয় মেলা ঘিরে দু’পক্ষের ১১ জন আহত হয়। এ ছাড়া জলিলনগর, নোয়াপাড়া, বেরুলিয়া, কদলপুর ফকিরহাট এলাকায় একাধিক ঘটনায় ৫০ থেকে ৬০ জন আহত হন। গত সাড়ে পাঁচ মাসের সব ঘটনা আমলে নিলে আহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে শতকের ঘর। 

বিএনপির দু’পক্ষের অপহরণ 

গত সাড়ে পাঁচ মাসে বিএনপির দু’গ্রুপের মধ্যে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৯টি। গত ২৮ নভেম্বর নোয়াপাড়া থেকে গোলাম আকবর গ্রুপের তিনজনকে অপহরণ করে প্রতিপক্ষ। ২৩ ডিসেম্বর পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের বড়ঠাকুরপাড়া থেকে অপহরণ করে গিয়াস কাদের অনুসারীকে। এ ছাড়া গত ২৮ ডিসেম্বর পৌর যুবলীগের সহসভাপতি আরিফুল হক চৌধুরীকে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবিতে অপহরণ করা হয় চট্টগ্রাম নগরী থেকে। ১৮ জানুয়ারি রাউজানের কুণ্ডেশ্বরী থেকে অপহরণ করা হয় যুবলীগ নেতা লক্ষ্মীকান্তকে। ২৯ ডিসেম্বর নুরুল ইসলাম নামের একজনকে অপহরণ করা হয় আঁধারমানিক এলাকা থেকে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে সন্ত্রাসী ব্যবহার করে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

সন্ত্রাসীদের ‘ভিআইপি মর্যাদা’ 

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে শক্তি দেখাতে ব্যস্ত বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা। স্থানীয়রা বলছেন, উত্তর রাউজানে গিয়াস কাদেরের সমর্থনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন রফিকুল আলম বাচা, আজিজুল হক ও আজিজ উদ্দিন। দক্ষিণ রাউজানে বিধান বড়ুয়া, মোশারফ হোসেন ছোটন, কামাল উদ্দিন ও আবু তাহের। গোলাম আকবরের সমর্থনে উত্তর রাউজানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন ইকবাল ও জমির। দক্ষিণে হাজি আজিজুল হক ও জানে আলম। উরকিরচর ইউনিয়নের বাসিন্দা লোকমান হাকিম বলেন, বিএনপির দুই নেতার রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ও আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে শক্তি দেখাতে গিয়ে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় আছে। পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকাও রহস্যজনক।

কমিটি নিয়ে বিএনপির দু’গ্রুপ মুখোমুখি

উপজেলা বিএনপি ও পৌরসভা কমিটি গঠনে সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। গিয়াস কাদের গ্রুপের আপত্তির মুখে সে সম্মেলন স্থগিত করা হয়। পরে গত ১৪ জানুয়ারি সম্মেলন ছাড়াই উপজেলা ও পৌর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম প্রকাশ করে জেলা বিএনপি। উপজেলা কমিটিতে অধ্যাপক জসিম উদ্দিনকে সভাপতি ও আনোয়ার হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। পৌর কমিটিতে আবু আহম্মদকে সভাপতি ও ইফতেখার উদ্দিন খানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ঘোষিত কমিটির সবাই গোলাম আকবর গ্রুপের। গিয়াস কাদের সমর্থিত নেতাকর্মীরা এটিকে পকেট কমিটি উল্লেখ করে কমিটি বাতিল চেয়ে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে। এ নিয়ে ১৯ জানুয়ারি ঘোষিত কমিটির নেতারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে মতবিনিময় শেষে ফেরার পথে দু’দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

কারা কী বলছেন

সব অভিযোগ অস্বীকার করে গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘আমার সন্ত্রাসী বাহিনী নেই। মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য দিয়ে আমার সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা করছেন গোলাম আকবর। অথচ অনেক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছি। হাসিনা সরকারের পতনের পর সে রাতারাতি রাউজানে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে।’

গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, ‘রাউজানের মানুষ আর কোনো সন্ত্রাসের গডফাদারকে মেনে নেবে না। আর কাউকে চাঁদাবাজি করতে দেবে না। বিএনপিও এ সুযোগ আর দেবে না কাউকে। এ জন্য গিয়াস কাদেরকে এরই মধ্যে শোকজ করেছে দল। তাঁর ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে কেন্দ্রও।’

রাউজান উপজেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘গোলাম আকবর খন্দকার পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। রাউজানে যারা লুটপাট, হামলা ও অস্ত্রনির্ভর হয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, তারা গিয়াস কাদের গ্রুপের।’ চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহসভাপতি সাবের সুলতান কাজল বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে মরিয়া গোলাম আকবর খন্দকার। উনার জনপ্রিয়তা নেই রাউজানে। সে জন্য সন্ত্রাসীদের দিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন।’

রাউজান থানার ওসি এ কে এম সফিকুল আলম চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘যারা রাউজানে শান্তি নষ্ট করবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। বিএনপির দুই পক্ষকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি উন্নতির চেষ্টা করা হচ্ছে।’

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গ ল ম আকবর গ গ ল ম আকবর খ স ঘর ষ র ঘটন ব এনপ র দ র সমর থ উপজ ল করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

গাইবান্ধায় বাবা-মাকে মারধর করে এসএসসি পরীক্ষার্থীকে অপহরণ, অভিযুক্ত আটক

বাড়ির ভেতর ঢুকে বাবা-মাকে মারধরের পর এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) দুপুর ২টার দিকে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কামারদহ ইউনিয়নের বেপারীপাড়ায় ঘটনাটি ঘটে। বিকেল ৫টার দিকে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার ও মূল অভিযুক্ত আটক করে পুলিশ। 

অভিযুক্ত সঞ্চয় (২০) উপজেলার ফাঁসিতলা এলাকার মোঘলটুলী গ্রামের রাফিউল ইসলাম রাফির ছেলে।

ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, মঙ্গলবার দুপুরে গোবিন্দগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরেন ওই শিক্ষার্থী। কিছুক্ষণ পর সঞ্চয়সহ ১৫-২০ জন লাঠি নিয়ে বাড়িতে হামলা চালায়। তারা ঘরের দরজা-জানালাসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে এবং মালামাল লুট করে। এসময় বাধা দিতে গেলে হামলাকারীরা ওই শিক্ষার্থীর বাবা-মাকে মারধর ও কুপিয়ে আহত করে। পরে তারা শিক্ষার্থীকে টেনেহিঁচড়ে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যায়। 

আরো পড়ুন:

ধামরাইয়ে চালক-হেলপারকে মারধর করে তেলবাহী ট্রাক ছিনতাই 

সিরাজগঞ্জে সহপাঠীদের মারধরে আহত এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু

পুলিশ বিকেল ৫টার দিকে পার্শ্ববর্তী কামারদহ ফেলুপাড়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে চাঁন মিয়ার বাড়ি থেকে অপহৃত শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে। এসময় অভিযুক্ত সঞ্চয়কে আটক ও তার কাছে থাকা মোটরসাইকেল জব্দ করে পুলিশ। 

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে যাওয়া আসার পথে তাকে উত্ত্যক্ত করাসহ বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছিলেন সঞ্চয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত সঞ্চয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন তিনি। 

ঘটনাটি নিশ্চিত করে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি বুলবুল ইসলাম বলেন, “খবর পেয়ে পুলিশ উদ্ধার অভিযান চালায়। একটি বাড়ি থেকে শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা হয়। অভিযুক্ত সঞ্চয়কে আটক করা হয়েছে। মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।”

ঢাকা/মাসুম/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বসুন্ধরার চেয়ারম্যানসহ পরিবারের ২২ কোম্পানির শেয়ার ও ৭০টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ
  • দল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পেলেন গিয়াস কাদের ও গোলাম আকবর
  • আগারগাঁওয়ে সেনা অভিযানে অপহৃত ৪ কিশোর উদ্ধার
  • গিয়াস কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকারকে শোকজ
  • গাইবান্ধায় বাবা-মাকে মারধর করে এসএসসি পরীক্ষার্থীকে অপহরণ, অভিযুক্ত আটক
  • অপহরণে বাঁধা দেওয়ায় যুবককে গুলি করে হত্যা, আটক ৩
  • অপহৃতকে ছেড়ে দিয়ে পালানোর সময় অস্ত্র ও গুলিসহ অপহরণকারী আটক
  • ছাড়া পেলেন অপহৃত কৃষক, এক অপহরণকারী অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার