ভুল সিদ্ধান্তে রাজস্ব না বেড়ে উল্টো কমবে
Published: 12th, February 2025 GMT
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে সরকার করজাল না বাড়িয়ে পরোক্ষ করের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। ফলে অতি প্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়েছে। ভুল সময়ে এসে সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বেশি ক্ষতির মুখে পড়বেন। উৎপাদন ও বিক্রি কমে যাওয়ায় কমবে ব্যবসা। তাতে রাজস্ব আয় না বেড়ে উল্টো কমে যাবে।
বুধবার রাজধানীর গুলশানে এমসিসিআই কার্যালয়ে জাগো নিউজ আয়োজিত ‘ভোক্তার কাঁধে বাড়তি করের বোঝা: উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। গত ৯ জানুয়ারি সরকার বিস্কুট, বেভারেজসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে এই গোলটেবিলের আয়োজন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। ২০১৮ সালের সিপিডির এক গবেষণার বরাতে তিনি বলেন, বছরে কোটি টাকার বেশি আয় করেন এমন ৬৭ শতাংশ মানুষ এখনও করজালের বাইরে। সরকার করজাল না বাড়িয়ে পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়িয়ে দুর্নাম কুড়িয়েছে। রাজস্ব বাড়াতে আইএমএফের চাপে সরকার পরোক্ষ কর বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০-২৫ ধরে কর প্রশাসন অটোমেশন করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। সংস্কারে যেন কর প্রশাসনের কোনো আগ্রহ নেই। এখানে ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত থাকতে পারে। নিজেদের এমন অসংগতি দূর করতে না পারলে কিংবা নিয়মের প্রতিপালন করতে না পারলে কর আদায় বাড়বে না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড.
তার মতে, অর্থনীতিতে যেসব নীতি নেওয়া হচ্ছে সেগুলো একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পৃক্ততা নেই। চিন্তাভাবনা না করে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। যেমন- ভ্যাটের হার বৃদ্ধি। এর পেছনে আইএমএফের ঋণে রাজস্ব বাড়ানোর শর্ত ছিল। মনে রাখতে হবে, আশির দশক থেকে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক যেসব প্রেসক্রিপশন দিয়েছে সেগুলো কোনো কাজে আসেনি। সবগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এবারও ব্যর্থ হতে যাচ্ছে।
করহার বাড়িয়ে বিশ্বের কোনো দেশেই রাজস্ব বাড়ানো হয় না বলে মন্তব্য করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ।
তিনি বলেন, করহার কমালে বিনিয়োগ বাড়ে। তাতে উৎপাদন ও চাহিদা বেড়ে যায়। ভোগ বাড়লে রাজস্ব বাড়বেই। তার মতে, কর বাড়ালে দেশের ব্যবসার পরিবেশ তথা বিনিয়োগে কী প্রভাব পড়বে তা পর্যালোচনা করেই বাড়ানো উচিত। অসময়ে কর বাড়ালে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘুরেফিরে তা ভোক্তার ঘাড়েই পড়ে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে পাঁচটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বড় আকারে রাজস্ব ঘাটতি, ব্যাংকে তারল্য সংকট, বিনিয়োগে স্থবিরতা ও বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া। এগুলো সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সরকার বিপদে পড়বে।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এখনও বিভিন্ন বাজারে ও সড়কে চাঁদাবাজি হচ্ছে। চাঁদাবাজি কমলে পণ্যের দাম কমবে। তাতে মূল্যস্ফীতিও কমে যাবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য রেজাউল হাসান বলেন, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে অনেকেই অটোমেশনের কথা বলেন। কিন্তু অতীতে এনবিআরের কর্মকর্তারাই মূলত এটি চায়নি। এখন কতটুকু চায় সেটা দেখার বিষয়।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ালে পণ্যের দর যেভাবে বাড়ে বিপরীতে এসব ক্ষেত্রে ছাড় দিলে সে হারে কমে না।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, যারা নিয়মিত কর দেন তাদের ওপর করের বোঝা বাড়ানো হচ্ছে। তাতে এক সময় করের চাপে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যবসা বন্ধ হলে রাজস্ব আয় নিয়ে বিপদ বাড়বে।
বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া, ভ্যাট-ট্যাক্সের জাঁতাকলে ব্যবসায়ীরা বিস্কুটের প্যাকেট আর কত ছোট করবে, প্যাকেটে বিস্কুটের পরিমাণ আর কত কমাবে? এভাবে কমাতে কমাতে এক সময় তো খালি প্যাকেট দিতে হবে।
বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, সুপারশপে বাড়তি ভ্যাট, কাছেই অন্য দোকানে ভ্যাট নেই। এতে সুপারশপে বিক্রি কমেছে। দেশের ২০ লাখ দোকানির সিংহভাগই ভ্যাটের বাইরে। এই বৈষম্য দূর করলে সরকারের টাকার অভাব হবে না।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়াতে ব্যবসায়ীদের দরকার আছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কর-ভ্যাটের হার যুক্তিযুক্ত হলে দেশ সুন্দরভাবে চলবে। বছরের মাঝপথে এসে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ালে পণ্যের দাম বাড়বে। তাতে মানুষের কষ্ট বাড়বে।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি এম এ হাশেম বলেন, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক আরোপে দাম বেড়ে গেলে পণ্য কেনা কমিয়ে দেবেন ভোক্তা। কোম্পানিগুলো কৃষিপণ্য সংগ্রহ কমিয়ে দেবে। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষক।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র র কর ব ড় ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
দোষ বিয়ারিং প্যাডের নয়, যারা লাগিয়েছে কিংবা বুঝে নিয়েছে, তাদের: ডিএমটিসিএল এমডি
মেট্রোরেল চালুর আগে নিরাপত্তার পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা (সেফটি অডিট) ছাড়াই যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকার মেট্রোরেলের। এর মধ্যে বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে একজন পথচারী মারা গেছেন। এবার নতুন করে নিরাপত্তার নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
বিয়ারিং প্যাড পড়ে পথচারীর মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর আজ সোমবার সকালে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেলের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেলের আগে সেফটি অডিট হয়নি। তাই সেফটি অডিট করতে চাইছি। যত দ্রুত করা যায়, সেটা আমরা করব। থার্ড পার্টিকে (তৃতীয় পক্ষ) দিয়ে এই অডিট করানো হবে। ইউরোপীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়েই করানো হবে। আমাদের কাছে ফ্রান্সের দুটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। সেফটি অডিট করার জন্য আমরা খুব শিগগির টেন্ডারের প্রক্রিয়ায় যাব।’
এক বছর আগে ঢাকার মেট্রোরেলের স্তম্ভের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার পর গত ২৬ অক্টোবর ফার্মগেটে আরেকটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু হয়। এরপর ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় শাহবাগ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ছিল।
বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ার পর এগুলোর নিরাপত্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, ‘বিয়ারিং প্যাড হঠাৎ করে পড়ে যায়নি। এটা হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার জিনিস নয়। যেহেতু এটা নিয়ে তদন্ত চলছে, ফলে এ বিষয়ে আমি জাজমেন্টাল হতে চাই না। তবে যেটা হতে পারে, সেটা বলতে পারি, ডিজাইন ফল্ট হতে পারে। যে জিনিসের ওপর বসানোর কথা বলা হয়েছিল, যা যা দেওয়ার কথা ছিল, সেটা বসানো হয়নি। যে ডিজাইনে হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়তো ঠিকাদার করেনি। যে পরামর্শককে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা হয়তো ঠিক করে জিনিসটা বুঝে নেয়নি। এই চারটা কারণে হতে পারে অথবা এর মধ্যে কোনো একটা কারণেও হতে পারে।’
ফারুক আহমেদ আরও বলেন, ‘দোষ কিন্তু বিয়ারিংয়ের নয়। বিয়ারিং যে লাগিয়েছে, সেটি বাজেভাবে লাগানো হয়েছে কি না? যার আসলে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল, সে বুঝে নিয়েছে কি না, সেগুলো এখন দেখতে হবে।’
আরও পড়ুনবৃষ্টির পানি ঢোকে, এসি বিকল হয়, মেট্রোরেল ব্যবস্থায় ৪৫ সমস্যা০২ নভেম্বর ২০২৫এসব কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য হাজার কোটি টাকায় বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা আছে জানিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘প্রথম ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেবেন পরামর্শক। আমাদের বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পরামর্শকদের। তখন এই কাজগুলো কিছুটা তাড়াহুড়া হয়েছে। কেন হয়েছে, সেটার উত্তর তো আমি দিতে পারব না। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই অংশে অনেক ডিফেক্ট আছে। ফলে সেটা এখনো আমরা বুঝে নিইনি।’
ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, যেখানে বিয়ারিং প্যাড পড়ে গিয়েছিল, ওই অংশের ত্রুটি সারিয়ে দেওয়ার সময়সীমা (ডিফেক্ট লায়াবেলিটি) গত জুন পর্যন্ত ছিল। কিন্তু ডিএমটিসিএল তাদের এই সময়সীমা গ্রহণ করেনি। কারণ, এখনো অনেক বড় ত্রুটি রয়ে গেছে। যত সমস্যা আছে, এগুলো ঠিকাদারকে মেরামত করতে হবে। এ জন্য ‘ডিফেক্ট লায়াবেলিটি’ দুই বছর বাড়ানোর জন্য ঠিকাদারকে বলা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেলের সব কটি পিলার পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে জানিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, এর আগে পুরো পথের বিয়ারিং প্যাডের ছবি ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে তোলা হয়েছে। এরপর কর্মকর্তারা সরেজমিনে নিরীক্ষা করেছেন। যেসব স্থানে ত্রুটি শনাক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে। ডিএমটিসিএলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, যেখানে ত্রুটি বা সমস্যা পাওয়া যাবে, সেখানে বিয়ারিং প্যাড অবশ্যই পরিবর্তন করা হবে।
আরও পড়ুনমেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড কী, খুলে পড়ার কারণ কী হতে পারে২৬ অক্টোবর ২০২৫চার বছর আগে তাড়াহুড়া করে ঢাকার মেট্রোরেল চালু করা হয়েছিল দাবি করে ফারুক আহমেদ বলেন, প্রকল্পটি চালুর আগে ন্যূনতম ছয় থেকে নয় মাসের পরীক্ষামূলক চলাচল নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল। তিন বছরে মেট্রোরেল চালু হবে বা পাঁচ বছরে মেট্রোরেল সম্পূর্ণ হবে—এ ধরনের ধারণা আসলে ভুল। কোনো মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য সব ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পর ছয় থেকে সাত বছর লাগে। এর আগে প্রকল্প প্রণয়ন, সম্ভাব্যতা যাচাই ও অন্যান্য প্রস্তুতিতে চলে যায় তিন বছর।
২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের যে লক্ষ্যমাত্রা আগে নেওয়া হয়েছিল, তা কিসের ভিত্তিতে হয়েছে, তা তার বোধগম্য নয় বলে মন্তব্য করেন ডিএমটিসিএলের এমডি।
নতুন মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প তাহলে মুখ থুবড়ে পড়ছে কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘মেট্রোরেল প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েনি। মেট্রোরেল আমাদের লাগবে। আমাদের লক্ষ্য হলো, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এই প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়। সরকারের উদ্দেশ্য হলো একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা, যাতে একাধিক প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারে এবং কম খরচে উন্নত মানের মেট্রোরেল নির্মাণ সম্ভব হয়। মেট্রোরেল আমাদের করতেই হবে; তবে তা হবে স্মার্ট ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে।’
আরও পড়ুনবিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে ফার্মগেটে একজন নিহত, মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ২৬ অক্টোবর ২০২৫