এক সপ্তাহ ধরে আমেরিকা ও ইউরোপের সম্পর্ক বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইউরোপ নিয়ে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র পরিষ্কার করেছে, তারা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার জন্য আলোচনা করতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্র চায় ইউরোপ তার নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজে নিক। এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন আভাস দিয়েছে, তারা চায় ইউরোপ ও আমেরিকার রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন একটি জোট গড়ে উঠুক। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের এ ধরনের টানাপোড়েন এর আগে অনেকবার দেখা গেলেও সাধারণত কিছুদিন পর পরিস্থিতি আগের মতো হয়ে যেত। কিন্তু এবারের ঘটনা ভিন্ন। 

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ট্রাম্পের কর্মকর্তারা ইউরোপের নেতাদের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিয়েছেন। এটি সম্মেলনজুড়ে উত্তেজনা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের কথাবার্তা শুনে তখনই সবাই বুঝতে পারছিলেন, ইউরোপের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।

এখন প্রশ্ন উঠছে, ইউরোপ কি নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষায় শক্তিশালী ভূমিকা নিতে পারবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বড় রাজনৈতিক খেলায় একপ্রকার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করবে? অন্যদিকে ইউক্রেন কি এ দফায় রাশিয়ার দখল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে? আরও প্রশ্ন উঠছে, যদি পশ্চিমা দেশগুলোর ঐক্য ভেঙে যায়, রাশিয়া যদি আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে ও যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়, তাহলে এর প্রভাব সারা বিশ্বের রাজনীতিতে কেমন হবে? 

এ পরিস্থিতি শুধু ইউরোপের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত বুধবার থেকে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, তিনি ও ভ্লাদিমির পুতিন মিলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শেষ করার জন্য আলোচনার একটি পরিকল্পনা করেছেন। এ খবর শোনার পর ইউরোপ ও ইউক্রেন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কারণ, তারা ভয় পাচ্ছিল এই ভেবে যে তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, অথচ তাদের এই আলোচনার অংশই করা হয়নি। 

ব্রাসেলসে ন্যাটো সদর দপ্তরে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ঘোষণা করেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউক্রেনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইউরোপকেই সামলাতে হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা খুবই সীমিত থাকবে। এই ঘোষণায় ইউরোপের দেশগুলো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কারণ, তারা মনে করে, এ ধরনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তারা যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। এ ছাড়া হেগসেথ বিদ্যমান মার্কিন নীতির বিপরীত অবস্থান নিয়ে বলেন, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হবে না।

বিষয়টি পরিহাসের, কারণ ২০০৮ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রথমবার ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। অবশ্য জার্মানি ও ফ্রান্স তখন এর বিরোধিতা করেছিল। কারণ, তারা মনে করত, এতে রাশিয়া ক্ষুব্ধ হতে পারে। 

ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে আলোচনার চ্যালেঞ্জ বিশাল। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাস যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে। কারণ, পুরো প্রক্রিয়া এখনো গঠনপর্বে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করছে না। তবে গত সপ্তাহের ঘটনাগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের এমন এক বড় প্রচেষ্টার সূচনা হিসেবে দেখতে হবে, যার লক্ষ্য ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের শর্ত পুনর্মূল্যায়ন করা। ট্রাম্প প্রশাসন এ ক্ষেত্রে কত দূর এগোতে পারবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। 

মিউনিখের মঞ্চে যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স প্রবেশ করেন, তখন উপস্থিত সবাই দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা জানতে চাইছিলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের ইউক্রেন বিষয়ে প্রকৃত পরিকল্পনা কী? কিন্তু তাঁরা ভ্যান্সের মুখে যা শুনলেন, তা ইউরোপে কোনো আমেরিকান রাজনৈতিক নেতার দেওয়া সবচেয়ে বিতর্কিত ভাষণগুলোর একটি হয়ে থাকবে। 

ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি কিছু না বলে জেডি ভ্যান্স একধরনের আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। তিনি অভিযোগ তোলেন, ইউরোপ মুক্ত মতপ্রকাশ দমন করছে এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে। তিনি বলেন, তারা ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দলগুলোর অগ্রযাত্রা রোধ করছে। ভ্যান্সের এই বক্তব্য যেন গলিত সিসার মতো শ্রোতাদের ওপর নেমে আসে। গণতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থিত ইউরোপীয় নেতাদের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। ভ্যান্স ইচ্ছা করেই সবাইকে হতবাক করতে চেয়েছিলেন, এটি স্পষ্ট। তবে তিনি অপমান করার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি দুটিই করেছেন—অবাকও করেছেন, অপমানও করেছেন। 

 বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথা বলেছেন ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার স্টাব। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে বলেছেন, ইউরোপের মতামত ছাড়াই যদি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে ইউরোপের নিরাপত্তাব্যবস্থার নতুন রূপরেখা তৈরি করে, তাহলে সেটি হবে আরেকটি ইয়াল্টা মুহূর্ত (‘ইয়াল্টা মুহূর্ত’ বলতে মূলত ১৯৪৫ সালের ইয়াল্টা সম্মেলনের প্রসঙ্গ বোঝানো হয়)। তবে তিনি চেয়েছেন সেটিকে একটি ‘হেলসিংকি মুহূর্তে’ পরিণত করতে, যেখানে ভবিষ্যৎ শান্তি ও সম্পর্কোন্নয়নের নীতিমালা নির্ধারণ করা হবে। 

অন্যদিকে কিছু নেতা ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এবং নিজের পথ অনুসরণ করে ইউক্রেনের জন্য যুদ্ধ জয় করার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছিলেন। এ ধরনের বক্তব্যগুলো তিন বছর আগে বাস্তবভিত্তিক ছিল, তবে আজকের দিনে এর বাস্তবতার অভাব ইউরোপের সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এর ফলে ইউরোপের নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ সুরক্ষিত করার চেষ্টা ব্যাহত হতে পারে। 

এদিকে এশিয়ার দুই বড় দেশ চীন ও ভারত পশ্চিমের এই পরিবর্তন দেখে বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। পশ্চিমের এই বিভাজন দেখে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই খুব শান্তভাবে বক্তব্য দিয়েছেন। আসলে চীন নিজেই দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমের মধ্যে এমন বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর হয়তো কিছুটা সতর্ক ছিলেন; তবে তাঁকেও আশাবাদী মনে হয়েছে। চীন ও ভারতের মতো দেশগুলোর জন্য পশ্চিমের এই বিভক্তি এমনই এক সংকেত, যা তাদের ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে যে বাকি এই শতাব্দী তাদেরই হবে। 

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সৌদি আরবে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে পুতিন ও ট্রাম্পের পরবর্তী আলোচনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এই দুই নেতার আলোচনায় মূলত ইউক্রেন ও সমগ্র ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে পারে। অন্যদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ইউরোপীয় নেতাদের একত্র করার চেষ্টা করছেন, যাতে তাঁরা এই সংকট মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেন। তবে তা করা অত্যন্ত কঠিন হবে। 

ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে আলোচনার চ্যালেঞ্জ বিশাল। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাস যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে। কারণ, পুরো প্রক্রিয়া এখনো গঠনপর্বে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করছে না। তবে গত সপ্তাহের ঘটনাগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের এমন এক বড় প্রচেষ্টার সূচনা হিসেবে দেখতে হবে, যার লক্ষ্য ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের শর্ত পুনর্মূল্যায়ন করা। ট্রাম্প প্রশাসন এ ক্ষেত্রে কত দূর এগোতে পারবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। 

এটুকু স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির এই মৌলিক সম্পর্ক পরিবর্তনের পথে রয়েছে। আর এর সঙ্গে আধুনিক গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও জড়িয়ে আছে। 

ক্রিস্টোফার এস চিভিস কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের আমেরিকান স্টেটক্রাফট প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো ও পরিচালক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পরর ষ ট রমন ত র র পরর ষ ট ইউক র ন র র ইউর প ইউর প র কর ছ ন ন র পর মন ত র র জন ত আম র ক র জন য ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা

মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে প্রায়ই বিজ্ঞান, স্থাপত্য বা শাসনব্যবস্থার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু এর মানবিক দিক অধরা রয়ে যায়। বিশেষ করে দরিদ্রদের প্রতি দয়া ও চিকিৎসাসেবার গল্প আড়ালে রয়ে গেছে সব সময়।

মুসলিম সভ্যতায় কীভাবে দরিদ্র ও অসুস্থদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা, আশ্রয় এবং মানসিক সান্ত্বনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা এক অপূর্ব কাহিনি।

বিমারিস্তান: দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসার আশ্রয়

মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবায় ‘বিমারিস্তান’ নামের হাসপাতাল ছিল একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। এগুলো শুধু চিকিৎসার জায়গা ছিল না, বরং দরিদ্রদের জন্য বিনা মূল্যে আশ্রয়, খাদ্য ও যত্নের ব্যবস্থা ছিল। বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত নগরে, বিশেষ করে বড় রাজধানীগুলোতে বিমারিস্তান ছিল। দামেস্কে বিমারিস্তানের নাম ছিল ‘নুরি’, বাগদাদে ‘আদুদি’।

প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহ.)

প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকের সময়, ৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি এতে চিকিৎসক নিয়োগ করেন এবং তাঁদের বেতনের ব্যবস্থা করেন। সমাজের স্বাস্থ্য রক্ষায় কুষ্ঠরোগীদের জন্য পৃথক স্থানে বিনা মূল্যে খাদ্য ও যত্ন দেওয়া হতো।

অন্ধদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা ও সাহায্যকারী নিয়োগ করা হতো। খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।’ (ইবনে আসাকির, তারিখে দিমাশক, ৪৪/১২৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

আরও পড়ুন“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”০১ অক্টোবর ২০২৫

ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালও ছিল, যা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হতো। দূরবর্তী অঞ্চলে মহামারি মোকাবিলায় ৪০টি উটের কাফেলায় চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হতো।

মিসরে প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় আহমদ ইবন তুলুনের সময়, ৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে, ফুসতাতে। এর নাম ছিল ‘বিমারিস্তান আতিক’।

এর জন্য ওয়াক্‌ফ তহবিল রাখা হয়েছিল, এবং শর্ত ছিল যে এটি শুধু সাধারণ মানুষের জন্য, সৈন্য বা দাসদের জন্য নয়। এর বার্ষিক খরচ ছিল ৬০ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)। ইবন তুলুন নিজে প্রতি সপ্তাহে এটি পরিদর্শন করতেন এবং জুমার দিনে মুসল্লিদের জন্য জরুরি সেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে ছিল ১ লাখের বেশি বইয়ের গ্রন্থাগার। (মাকরিজি, খিতাত, ২/৪০৫, দারু সাদির, কায়রো, ১৮৫৩)

সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবি বিমারিস্তান ‘নাসিরি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে মিসর ও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বিমারিস্তান ছিল মনসুর কালাউনের প্রতিষ্ঠিত বিমারিস্তান, ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। এখানে নারী-পুরুষ সবার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল, চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা ছিল না। এখানে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো।

সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। রাতের দীর্ঘ সময় রোগীদের জন্য কষ্টকর হতো, তাই ফজরের আজান দুই ঘণ্টা আগে দেওয়া হতো, যাতে রোগীরা সকালের আশায় উৎফুল্ল হয়। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।

সুস্থ হওয়ার পর রোগীদের পোশাক ও কিছু টাকা দেওয়া হতো, যাতে তারা তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে না বাধ্য হয়। এই বিমারিস্তান ২০০ জনের বেশি দরিদ্র রোগীকে বাড়িতে চিকিৎসা দিত। (মাকরিজি, খিতাত, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৭)

দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসাগ্রন্থ

মুসলিম সভ্যতার চিকিৎসকেরা লক্ষ করেন, চিকিৎসা কখনো কখনো ধনীদের কাছে ব্যবসায় পরিণত হন। তাই তাঁরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তারা নিজেরা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে বা ছোট চিকিৎসকেরা তাদের সহজে চিকিৎসা দিতে পারেন। এই গ্রন্থগুলোয় স্থানীয় ও সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতো; কারণ, ভারত বা চীন থেকে আমদানি করা ওষুধ ছিল দামি।

আরও পড়ুনইসলামে দারিদ্র্য দূরীকরণের ৮টি ব্যবহারিক উপায়০২ নভেম্বর ২০২৫

আবু বকর আর-রাজি: তিনি দরিদ্রদের প্রতি অসাধারণ দয়া দেখাতেন এবং তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করতেন। তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন: ‘বুরউ সা’আত’ (তাৎক্ষণিক চিকিৎসা) এবং ‘মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব’ (যার কাছে চিকিৎসক নেই), যাকে ‘তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন’ (দরিদ্রদের চিকিৎসা) বলা হয়।

তিনি লিখেছেন, ‘অনেক চিকিৎসক ওষুধ ও খাবারের কথা লেখেন, যা শুধু রাজাদের ভান্ডারে পাওয়া যায়। আমি সাধারণ ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে চিকিৎসার একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লিখতে চাই, যাতে সবাই এর সুবিধা পায়।’ (আল-রাজি, মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব, পৃষ্ঠা ১৫, দারুল কুতুব, বৈরুত, ১৯৮৫)

মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো।

ইবনে জাজ্জার কায়রাওয়ানি: তিনি কখনো দরিদ্রদের কাছ থেকে চিকিৎসার ফি নিতেন না। তিনি তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন গ্রন্থে লিখেছেন, ‘দরিদ্ররা স্বাস্থ্য ও রোগ–সম্পর্কিত বইয়ের সুবিধা পায় না। তাই আমি এমন একটি গ্রন্থ লিখলাম, যাতে সহজলভ্য ওষুধ দিয়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করা যায়।’ (ইবনে জাজ্জার, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ১০, দারুল ফিকর, কায়রো, ১৯৯০)

ইবনে আকফানি: তিনি গুনইয়াতুল লাবিব ফি গাইবাতিত তাবিব (চিকিৎসক না থাকলে জ্ঞানীর সম্পদ) গ্রন্থে জরুরি রোগের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য রক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন।

জামালুদ্দিন ইউসুফ মাকদিসি: তিনি ‘তিব্বুল ফুকারা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ধনীরা সুস্বাদু খাবার খায়, তাই তাদের রোগ বেশি। দরিদ্ররা সাধারণ খাবারে সন্তুষ্ট থাকে, তাই তাদের রোগ কম। কিন্তু দরিদ্ররা অসুস্থ হলে তাদের জন্য সহজ ও সস্তা ওষুধ দরকার।’ (মাকদিসি, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ৮, দারুল মারিফা, বৈরুত, ১৯৯২)

মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো। চিকিৎসকেরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে তারা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে। এই ঐতিহ্য দেখায়, ইসলামি সভ্যতা কেবল জ্ঞান বা শক্তিতে নয়, মানবিকতা ও দয়াতেও শ্রেষ্ঠ ছিল।

আরও পড়ুনআপনার মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিচ্ছেন তো২১ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ