নজিরবিহীন বিক্ষোভ, হট্টগোল বিএসইসিতে
Published: 6th, March 2025 GMT
নজিরবিহীন বিক্ষোভ ও হট্টগোলের পর শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদসহ চার কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করেছেন সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিএসইসি কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে তারা জানিয়েছেন, পুরো কমিশন, অর্থাৎ চেয়ারম্যান ও চার কমিশনার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত বৃহস্পতিবার (আজ) থেকে কর্মবিরতি পালন করবেন তারা।
জানা গেছে, গতকাল বেলা ১১টায় কমিশনের কিছু কর্মকর্তা বিএসইসি ভবনের ছয়তলায় জড়ো হয়ে তুমুল হট্টগোল শুরু করেন। এক পর্যায়ে তারা পাঁচতলায় চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের অবরুদ্ধ করে তাদের পদত্যাগ দাবি করেন। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ওই ফ্লোরে প্রবেশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেন। কমিশন কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা ও মূল ফটক বন্ধ করে দেন। পুলিশকে খবর দিলে তারা ঢুকতে পারেনি। পরে সেনাবাহিনীর একটি দল এসে বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে অন্তত পাঁচ কর্মকর্তাসহ সাতজন আহত হন। আহত কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন, রাকিবুর রহমান, সুলতান সালাউদ্দিন, আরিফুল ইসলাম, চেয়ারম্যানের পিএস জাহাঙ্গীর, ইলেকট্রিশিয়ান মাহবুব প্রমুখ। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় পরে বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা ভবন ত্যাগ করেন।
বিএসইসির কয়েকজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, গত মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ করে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আদেশ জারি করা হয়। সাইফুর রহমান বিএসইসির অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। বুধবার সকালে এ খবর শুনে কিছু কর্মকর্তা বিক্ষুব্ধ হন। যদিও বেশ কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত আগস্টে তাঁকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসিডি) করে কমিশন।
সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ইস্যুকে কেন্দ্র করে গতকাল কর্মকর্তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেও আগে থেকেই নানা কারণে বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন কর্মকর্তারা। সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, বিতর্কিত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ১২৭ কর্মকর্তার বিষয়ে উচ্চ আদালতে চলমান মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে কমিশনের শীর্ষ নেতৃত্ব যথেষ্ট আন্তরিক নন। এ কারণে সহকারী পরিচালকরা আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন।
কর্মকর্তাদের আরও অভিযোগ, কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা কমিশনের আইনকানুনের বাইরে গিয়ে বেশ কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছেন। তারা কর্মকর্তাদের কোনো পরামর্শ শোনেন না। উল্টো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি অহরহ অশোভন আচরণ করেন। অতি সম্প্রতি সাবেক দুই কমিশনের সময়কার বেশ কিছু অনিয়মের ওপর যে তদন্ত হয়েছে, তার ভিত্তিতে কমিশন কর্মকর্তাদের গুরুদণ্ড হিসেবে ধরে বিধিবহির্ভূতভাবে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছে। এতে সিনিয়র-জুনিয়র সব কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ হন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিকেলে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুল আলম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে চার দফা দাবি তুলে ধরেন। তাদের দাবি, জরুরি সভা করে নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানের বাধ্যতামূলক অবসরের অবৈধ আদেশ প্রত্যাহার করতে হবে। বিতর্কিত তদন্ত প্রতিবেদনের নামে কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শোকজ বন্ধ করতে হবে এবং আগের শোকজ প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে হবে। ১২৭ জনের নিয়োগের ব্যাপারে আইনজীবী নিয়োগ এবং তিন দিনের মধ্যে আপিল করে কমিশনের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অশোভন, অপেশাদারমূলক দুর্ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং ক্ষমা চাইতে হবে। উল্লেখিত চার দাবি মানা না হলে পদত্যাগ না করা পর্যন্ত পুরো কমিশনের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম, আনোয়ারুল ইসলাম এবং রিপন কুমার দেবনাথ উপস্থিত ছিলেন।
পুরো পরিস্থিতির বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে ফোন করা হলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে কমিশনের শীর্ষ এক কর্মকর্তা দাবি করেন, উপযুক্ত কারণ থাকায় আইন মেনে নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কমিশন যখন পুরোনো শেয়ার কারসাজিসহ সুনির্দিষ্ট ১২টি ইস্যুতে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে, তখন কিছু কর্মকর্তা পরিকল্পিতভাবে কমিশনে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি করছে।
ওই কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কর্মকর্তাদের কোনো বক্তব্য থাকলে তারা কমিশনের কাছে বলতে পারত। কিন্তু তারা অবরুদ্ধ করে ফেলে। প্রথমে লিফট ও সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে। পরে পুরো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিলে শীতাতপ ব্যবস্থাও বন্ধ হয়। রোজার সময় তাদের নিজেদের কথা চিন্তা করে হলেও অন্তত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও শীতাতপ ব্যবস্থা চালুর অনুরোধ করেন। তাতেও তারা সাড়া দেননি। কর্মকর্তাদের দাবি অনুযায়ী পদত্যাগ করবেন কিনা– এমন প্রশ্নে বিএসইসির শীর্ষ ওই কর্মকর্তা সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দেননি।
বিএসইসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
গতকাল সন্ধ্যায় বিএসইসির পক্ষ থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমকর্মীদের পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বর্তমান কমিশন শেয়ারবাজারের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় বিএসইসির কিছু উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তা-কর্মচারী অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিগত দিনের শেয়ারবাজারের বিভিন্ন অনিয়ম অনুসন্ধানে কমিশন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ১২টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির অনিয়ম তদন্ত করে। এ পর্যন্ত তদন্ত কমিটি সাতটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়া চলমান, যার আওতায় রয়েছে শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং বিএসইসির কিছু কর্মকর্তা। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ বছর চাকরি সমাপ্ত করায় বিধি অনুযায়ী কমিশনের নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে গত ৪ মার্চ অবসর দেওয়া হয়।
এসব ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে কিছু উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তা বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের কমিশন বোর্ডরুমে চলমান সভায় জোরপূর্বক ঢুকে অবরুদ্ধ করে। তারা কমিশনের মূল ফটকে তালা দেয়, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বন্ধ করে দেয় এবং বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এভাবে অরাজক ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে এবং পেশিশক্তি প্রদর্শন করে। একই সঙ্গে তারা সদ্য যোগ দেওয়া চেয়ারম্যানের পিএসকে (সরকারের সিনিয়র সহকারী সচিব) লাঞ্ছিত করে।
নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুল আলমের বক্তব্য
গতকাল সন্ধ্যায় জানতে চাইলে বিএসইসির মাহবুবুল আলম সমকালকে জানান, নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর কমিশনের আদেশ অবৈধ। কারণ, যে ধারায় অবসরের আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা সরকারের এখতিয়ার; কমিশনের নয়। কমিশনের নিজস্ব চাকরিবিধি আছে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে আইনি প্রক্রিয়ায় তদন্ত ও শুনানির সুযোগ দিয়ে অবসরে পাঠানোর সুযোগ আছে।
মাহবুবুল আলম বলেন, সব কর্মকর্তার অভিযোগ, বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা কর্মকর্তাদের ছোটখাটো বিষয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। তারা বিগত কমিশনের সময়কার অন্যায়-অপরাধের জন্য সব কর্মকর্তাকে অপরাধী ভাবেন এবং সেভাবে আচরণ করেন। এতে সবার মধ্যে কর্মস্পৃহা কমে গেছে।
কর্মকর্তাদের বিজ্ঞপ্তি
কর্মকর্তাদের পক্ষে বিএসইসির পাল্টা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে বিএসইসির অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। তাতে কমিশনের বর্তমান নেতৃত্বকে অথর্ব বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গতকাল তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেছেন। এর সুরাহা না করে পুলিশ ও সেনাবাহিনী দিয়ে লাঠিচার্জ ও হামলা চালিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আহত করার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। নিজ কর্মস্থলে লাঠিচার্জ ও হামলার শিকার হওয়া বিএসইসি তথা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অন্য সবার মতো বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আশা করেছিলেন, শেয়ারবাজার ও এর নিয়ন্ত্রক সংস্থায় সুদিন ফিরবে। কিন্তু তা হয়নি। আগের কমিশন যেভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জোর করে আইনবহির্ভূত কাজে বাধ্য করত, এই কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনাররাও একই উপায়ে তাদের ব্যক্তিগত এজেন্ডা হাসিল করছেন। মৌখিক নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ না করলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গালাগাল, দুর্ব্যবহার ও কারণ দর্শানোর মাধ্যমে প্রশাসনিকভাবে হয়রানি করা হয়।
কমিশনের একজন নির্বাহী পরিচালককে নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর যে প্রক্রিয়া, তা বিএসইসি চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের স্বেচ্ছাচারী ও ব্যক্তিগত আক্রোশের উদাহরণ জানিয়ে বলা হয়, কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তার তদন্ত হতে পারে এবং প্রমাণসাপেক্ষে আইনানুযায়ী ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় যে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু খেয়ালখুশিমতো ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করার জায়গা শেয়ারবাজার না।
এমতাবস্থায় পুঁজিবাজারের উন্নতি, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণসহ কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে কাজ করার স্বার্থে ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ ও অন্য কমিশনারদের পদত্যাগ দাবি করা হচ্ছে। না হলে বৃহস্পতিবার থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করবেন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এসইস কর মকর ত দ র ন কর মকর ত র কর মকর ত ব এসইস র ক কর মকর ত র শ য় রব জ র র পদত য গ কর ত দ র ব যবস থ র অন য অন য য় কর ত র র ওপর তদন ত গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়েছিল সংবিধানে, তা–ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে আপিল বিভাগে এ–সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল–পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্র দেখিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে—দেশের জনগণ এমন বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ওপর আজ রোববার ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিএনপি মহাসচিবের আপিল–সংক্রান্ত শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন।
সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বেলা ১১টা থেকে মাঝে বিরতি দিয়ে ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিন রাখা হয়েছে। এদিন বিরতির পর শুনানি শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে আসেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে বসে এই শুনানি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। তার আগে সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
ওই রায়ের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও আপিল বিভাগের রুলসের ব্যত্যয় ঘটেছে দাবি করে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়ে সইয়ের আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করে। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের (বিচারপতিদের রায়ে সই করা) আগে সরকার সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের বলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে, যা দেশবাসীর জানা। দেশের বিবেকবান মানুষ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এই সংবিধান সংশোধনকে সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটি জনগণের বিরুদ্ধে বড় ষড়যন্ত্র।’
বিএনপির একসময়ের আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) দেশের প্রচলিত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সর্বশেষ (পূর্ণাঙ্গ রায়) রায় দেন, যা প্রথমে দেওয়া রায়ের (শর্ট অর্ডার সংক্ষিপ্ত রায়) সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’
শুনানিতে অবসরের পর রায়ে সই প্রসঙ্গ
অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করলে তার আইনগত মূল্য কী হবে—এ প্রসঙ্গ ওঠে শুনানিতে। বিরতির পর শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিবের অপর আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায় ঘোষণা ও রায়ে সই করা দুটি ভিন্ন বিষয়। রায় ঘোষণার সময় এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে যা ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।
দেওয়ানি কার্যবিধি, আপিল বিভাগের রুলস ও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘শর্ট অর্ডারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে পার্থক্য, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেছেন একজন বিচারপতি। এই বিচারপতিও বলেননি অবসরের পরে বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়টি অবৈধ হয়েছে। স্বাক্ষর পরে করেছেন বলে রায় অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করতে পারবেন না কিংবা কত দিনের মধ্যে সই না করলে সেটি অবৈধ হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।’
রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে কোনো বিচারপতি যখন কোনো রায় দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দিলে ছোটখাটো দাড়ি, কমা, শব্দ বাদ পড়েছে—এগুলো ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই সেটি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) ছাড়া হবে না, যার ওপর শুনানি চলছে।’
এ মামলায় সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। ওই প্রসঙ্গে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, ‘অবসরের পর রায়ে সই করলে তা বাতিল বা অকার্যকর হবে না। যেদিন প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করলেন, সেই তারিখ হচ্ছে মূল। এটি হচ্ছে রায়ের তারিখ। কবে সই করলেন, এটি প্রাসঙ্গিক নয়। আপিল বিভাগের রুলসে বলা আছে, এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) বিধান কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগের জন্য সিপিসি প্রযোজ্য নয়।’
মামলার পূর্বাপর
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।
পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।