অজ্ঞতা, ভুল, ইচ্ছাকৃত অন্ধত্ব এবং আত্মঘাতী ভবিষ্যদ্বাণী। এগুলোই হচ্ছে ট্রাম্পের সব সিদ্ধান্তের ভিত্তি। আর সেসবের পরিণামও তাঁর ঘোষিত উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। হোয়াইট হাউসের প্রেসিডেন্টরা দায়িত্ব নেওয়ার পর ধাতস্থ হতে কিছুদিন সময় পান। কিন্তু ট্রাম্প নিজের কাজের ফল হিসেবেই হোয়াইট হাউসের ইতিহাসে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ‘হানিমুন পিরিয়ড’ পেলেন।
মার্কিন শুল্কনীতি ট্রাম্প বদলে দিচ্ছেন ব্যাপকভাবে। সেই বদল হিমবাহে ধাক্কা লাগা টাইটানিক জাহাজের মতো যুক্তরাষ্ট্রকে ডোবাবে বলে মনে হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের ওপর তাঁর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থাগুলো ইতিমধ্যে শেয়ারবাজারে ধস নামিয়েছে। শঙ্কা হচ্ছে মারাত্মক মূল্যস্ফীতির। অথচ ট্রাম্প তাঁর ভোটারদের এসবের ঠিক উল্টো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে আবার মহান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বড় করার নয়। কিন্তু তিনি কানাডা আক্রমণের হুমকি দিলেন। কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্য করার ইচ্ছা জাহির করলেন। কানাডা স্বাভাবিকভাবেই খুব ক্ষুব্ধ। তারা মার্কিন পণ্য বর্জন করছে এবং পাল্টা শুল্ক আরোপ করছে। ট্রাম্প একাই নতুন জীবন দিয়েছেন ঝামেলায় পড়া জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টিকে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধান মার্ক কার্নির নেতৃত্বে দলটি এবার ট্রাম্পবিরোধী ইস্যুতে নির্বাচনে জেতার ভালো সুযোগ তৈরি করেছে। অথচ পরিকল্পনাটা এমন ছিল না।
এদিকে গ্রিনল্যান্ডের ভোটাররা পুতিন-স্টাইলের সাম্রাজ্যবাদী দখলের প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়ে গত সপ্তাহে ট্রাম্পকে দূরে থাকতে বলেছেন। তাঁরা স্বাধীনতা নিয়ে নিশ্চিত নন। তবে তাঁরা মার্কিন (বা ড্যানিশ) নিয়ন্ত্রণ স্পষ্টভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ট্রাম্পের ইউক্রেন নীতিও আরেকটি বিপর্যয়। রাশিয়া হামলাকারী। অথচ ট্রাম্প শাস্তি দিচ্ছেন ভুক্তভোগীকে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিচ্ছে কেবল কিয়েভের ওপর। ফলে ভ্লাদিমির পুতিন আরও আক্রমণ বাড়ানোর সাহস পাচ্ছেন, বিশেষ করে কুরস্কে। আর ট্রাম্পকে বোকা বানিয়ে সময় নিচ্ছেন।
এই অন্যায় শাস্তির ফল হবে রাশিয়ার অযাচিত পুনর্বাসন, পুতিনের যুদ্ধাপরাধের জন্য কার্যত ক্ষমা, জোর করে দখল করা ভূখণ্ড ধরে রাখার একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ বিভাজন। প্রশ্নটা আবার উঠছে—এটা কি সত্যিই অনিচ্ছাকৃত? ট্রাম্প কি কারও আজ্ঞাবহ, কেজিবির এজেন্ট, নাকি নিছক নির্বোধ। গত সপ্তাহে এ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সম্ভবত তিনি জানেনই না তিনি কী করছেন। অথবা আদৌ কোনো পরোয়া করেন না। তা না হলে শুল্ক নিয়ে নিজের যুক্তি প্রমাণ করতে গিয়ে বৈশ্বিক মন্দা ডেকে আনার মানে কী? বা তিনি কীভাবে ভাবেন যে গাজায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে জাতিগতভাবে উচ্ছেদ করে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে?
ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য চীন। আর তিনি মস্কোকে বেইজিং থেকে আলাদা করতে চাইছেন। এটাও এক উল্টো ভাবনা। এই দুই রাষ্ট্রের লক্ষ্য এক—পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে দুর্বল করা ও দখল করা। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, ট্রাম্প তাদের এই লক্ষ্যে সাহায্য করছেন।
ট্রাম্প ও তাঁর অপরিণত উপদেষ্টারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন যে রাশিয়াকে এমন এক লজ্জাজনক বিজয় উপহার দিলে শান্তি আসবে না। বরং ভবিষ্যতে ন্যাটোর মিত্রদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন সংঘাত তৈরি হবে। এই নজির বিশ্বব্যাপী আরও সব আইন ভাঙার জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। হয়তো আসলেও তারা বুঝতেই পারছে না।
তেহরানকে হুমকি দিয়ে বলছেন, নতুন করে পারমাণবিক আলোচনা শুরু করো, নইলে ফল ভালো হবে না। এই ‘ধমক’ ইরানের নেতাদের আরও ক্ষিপ্ত করেছে। ফলে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সমভাবনা গেছে বেড়ে।‘ট্রাম্পের আগে আর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইতিহাস বিষয়ে এতটা অজ্ঞ ছিলেন না। ওনার আগে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এতটা অক্ষম ছিলেন না’—কথাগুলো বলেছেন রক্ষণশীল বিশ্লেষক ব্রেট স্টিফেনস। ‘গণতন্ত্র অন্ধকারে মারা যেতে পারে, একনায়কত্বেও মারা যেতে পারে। কিন্তু ট্রাম্পের অধীন গণতন্ত্র নির্বুদ্ধিতার হাতেও মরতে পারে।’ সবচেয়ে বড় কথা হলো ট্রাম্পের এই অজ্ঞতা ইচ্ছাকৃত।
ট্রাম্পের একের পর এক করে যাওয়া ভুলের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে পারমাণবিক অস্ত্রের দ্রুত বিস্তার। তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিরাপত্তা সুরক্ষা প্রত্যাহারের হুমকি দিচ্ছেন। তখন জার্মানি, পোল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের ব্যাপারে জরুরি আলোচনা করছে। ইরান, সৌদি আরব, তুরস্ক ও মিসরও একই কথা ভাবছে। যদিও তাদের কারণ ভিন্ন।
ট্রাম্প দাবি করেন যে তিনি পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে। বিশ্লেষক ডব্লিউ জে হেনিগান লিখেছেন, ‘তাঁর নীতিগুলো ঠিক উল্টো ফল দিচ্ছে। ট্রাম্পের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের আগ্রহ দ্রুত বেড়ে গেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতিরক্ষা দিতে পারবে—এ বিষয়ে তাদের আস্থা কমে গেছে।’
ইরানের ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে কীভাবে ট্রাম্প নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারেন। তিনি নিজেকে শান্তির দেবতা ভাবতে ভালোবাসেন। তাই তেহরানকে হুমকি দিয়ে বলছেন, নতুন করে পারমাণবিক আলোচনা শুরু করো, নইলে ফল ভালো হবে না। এই ‘ধমক’ ইরানের নেতাদের আরও ক্ষিপ্ত করেছে। ফলে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সমভাবনা গেছে বেড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের সামরিক সংঘাত এখন কেবল যেন সময়ের ব্যাপার।
ট্রাম্পের অনুসারীরা তাঁর ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে বরং সেগুলো অনুকরণ করছেন। তাঁর উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্তের ঘোরপ্যাঁচে অনুসারীরা নিজেদেরও হাস্যকরভাবে বিপদে ফেলছে। যেমন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং প্রযুক্তি-মিলিয়নিয়ার ইলন মাস্ক গত মাসে ইউরোপের ‘উদারপন্থীদের’ তীব্র আক্রমণ করে জার্মানির কট্টর-ডানপন্থী আফডি পার্টিকে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু এর ফল হয়েছে তাদের প্রত্যাশার পুরো বিপরীত।
জার্মান ভোটাররা নতুন ফ্যাসিবাদীদের প্রত্যাখ্যান করেছে। মাস্কের ব্যবসা বয়কট করা হচ্ছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন ট্রাম্প ও পুতিনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিচ্ছে। ভ্যান্স-মাস্কের এই অদ্ভুত রাশিয়া সমর্থন ইউরোপের কট্টর-ডানপন্থী রাজনীতিকদের, বিশেষ করে ব্রিটেনের নাইজেল ফারাজকেও বিভ্রান্ত করেছে। ফলে কিয়ার স্টারমারের মতো মধ্যপন্থী রাজনীতিকেরা ট্রাম্পবিরোধী হাওয়ার সুবিধা পাচ্ছেন।
এলোমেলোভাবে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে তাঁর ১০০ দিনের দিকে যতই এগোচ্ছেন, ততই তাঁর জনপ্রিয়তা কমছে। তিনি ইতিমধ্যে জো বাইডেনের চেয়ে কম জনপ্রিয় হয়ে গেছেন। ট্রাম্পের হানিমুন পিরিয়ড শেষ।
সাইমন টিসডাল অবজারভারের পররাষ্ট্রবিষয়ক ভাষ্যকার
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
একজন চা শ্রমিকের দিনে আয় ১৭৮ টাকা
হবিগঞ্জে ছোট-বড় মিলেয়ে চা বাগানের সংখ্যা প্রায় ৪১টি। এসব বাগানের বাসিন্দা প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে, স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ চা পাতা উত্তোলনে জড়িত।
চা বাগানে একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়। এর বিনিময়ে মজুরি পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো বাগানে নিয়মিত এই মজুরিও দেওয়া হয় না।
শ্রমিকদের দাবি, দৈনিক মজুরি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করতে হবে। বর্তমানে যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চলে না। প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে চা শ্রমিকদের নৈমিত্তিক ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে।
আরো পড়ুন:
বৈষম্য কেন? নারী শ্রমিকেরা পান না সমান মজুরি
ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা
সরেজমিনে কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকরা ছোট্ট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসবাস করেন। পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, দু-বেলা পেটভরে খেতে পারেন না।
শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘‘দুই বছর অন্তর চা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি ও সমস্যা নিয়ে চা বাগান মালিক পক্ষের সংগঠনের সঙ্গে চা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিনিধির বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে বৈঠক হয়েছে। সে সময় ৮ টাকা ৫০ পয়সা বৃদ্ধি পেয়ে মজুরি ১৭৮ টাকা ৫০ নির্ধারিত হয়েছে।’’
শ্রমিকদের কষ্টের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই টাকায় চলা যায় না। দেশের কোথাও এতো সস্তা শ্রমের দাম নেই। বর্তমানে একজন কৃষিশ্রমিক দিনে ৫০০-১০০০ টাকা আয় করেন, একজন রিকশাচালকের প্রতিদিনের আয় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। সেখানে একজন চা শ্রমিক পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। এজন্য তাকে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়।’’
চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে নাটক ও গানের মাধ্যমে দাবি জানিয়ে আসা জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি প্রতীক থিয়েটারের সভাপতি সুনীল বিশ্বাস বলেন, ‘‘দৈনিক ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা মজুরিতে শ্রমিকদের চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অচিরেই মজুরি ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হোক। এছাড়া, শ্রমিকদের আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’’
ঢাকা/রাজীব