কারিগরি শিক্ষার্থীদের প্রতি অবহেলা: ন্যায়বিচার কোথায়
Published: 4th, April 2025 GMT
বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত অবহেলার শিকার। দক্ষ জনশক্তি তৈরির অন্যতম ক্ষেত্র হওয়া সত্ত্বেও কারিগরি শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে, যা শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নয়, দেশের শিল্প ও অর্থনীতির জন্যও হুমকিস্বরূপ। সম্প্রতি ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদোন্নতিতে অনিয়ম, ২০২১ সালের বিতর্কিত নিয়োগ, উচ্চশিক্ষার সীমাবদ্ধতা ও কর্মসংস্থানের সংকট—এসব ইস্যু কারিগরি শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে। তবু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ। প্রশ্ন হলো, আমরা কবে এ অবিচারের অবসান ঘটাব?
অবহেলার শিকড় কত গভীরকারিগরি শিক্ষা বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে এটি যেন উপেক্ষিতই থেকে গেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের ৬০-৭০ শতাংশ জনশক্তি কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ। অথচ বাংলাদেশে এই হার মাত্র ১৪ শতাংশ। সরকার প্রতিনিয়ত কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে কথা বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। পর্যাপ্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, দক্ষ প্রশিক্ষকের সংকট, অপ্রতুল ল্যাব–সুবিধা, নিম্নমানের পরীক্ষাব্যবস্থা, অবৈধ নিয়োগ ও প্রমোশনের অনিয়ম—এসব কারণে কারিগরি শিক্ষার্থীরা আজ হতাশ, বিক্ষুব্ধ।
ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের অবৈধ প্রমোশন: মেধার অবমূল্যায়নসম্প্রতি কারিগরি ছাত্র আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের অবৈধ প্রমোশন ও বিতর্কিত নিয়োগ বাতিলের দাবি তুলেছে। জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের অবৈধ প্রমোশন উচ্চশিক্ষিত ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য অবমাননাকর। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করছে, একটি অযোগ্য গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য পেশাদারদের হেয় করছে, যা কারিগরি শিক্ষার গুণগত মান নষ্ট করছে।
শুধু তা–ই নয়, শিক্ষার্থীদের দাবি উপেক্ষা করে ২০২১ সালে রাতের আঁধারে সংশোধিত নিয়োগবিধি বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যা পুরো প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ অনিয়ম রোধে বিচার চাইলে শিক্ষার্থীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, পরীক্ষা বর্জন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাহলে কারিগরি শিক্ষার্থীদের ন্যায়বিচারের জন্য কোথায় যেতে হবে?
উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানে বৈষম্য: আমরা কি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত। ডুয়েট ছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের জন্য তেমন কোনো আসন নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলেও ৫-৮ লাখ টাকা খরচ করতে হয়, যা অনেকের সামর্থ্যের বাইরে। অথচ সাধারণ শিক্ষায় উচ্চশিক্ষার অসংখ্য সুযোগ আছে।
অন্যদিকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য যেখানে সরকারি চাকরির অসংখ্য পদ রয়েছে, সেখানে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য পদসংখ্যা খুবই কম। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বঞ্চিত করা হয়, কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য করা হয়, এমনকি কখনো কখনো বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের অধীন করে রাখা হয়। তাহলে কি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা শুধুই শ্রম দেবে, কিন্তু মর্যাদা পাবে না?
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি: ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইবিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা দাবি করেছে—
১.
২. ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টর পদবি পরিবর্তন করতে হবে।
৩. ২০২১ সালের বিতর্কিত নিয়োগ বাতিল করতে হবে।
৪. অবৈধ নিয়োগের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. কারিগরি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে।
৬. ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য সরকারি চাকরির সুযোগ বাড়াতে হবে।
শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, তাদের স্বপ্ন, পরিশ্রম ও ভবিষ্যৎকে বারবার নষ্ট করা হচ্ছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা পরীক্ষা বর্জন ও প্রতিটি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
কর্তৃপক্ষের করণীয়: ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোকসরকারের উচিত অবিলম্বে এ সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
বিতর্কিত নিয়োগ ও প্রমোশন বাতিল করে স্বচ্ছ নিয়োগব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য সরকারি চাকরিতে আলাদা কোটা রাখতে হবে।
অধিকসংখ্যক কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে।
কারিগরি শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন টেকসই করতে হলে কারিগরি শিক্ষাকে অবহেলা করা যাবে না। আজ যারা কারিগরি শিক্ষাকে অবহেলা করছে, ভবিষ্যতে তারাই দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে ভুগবে। তাই আর নয় অবহেলা, শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এখনই!
তানভীর হাসান মন্ডল
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থী, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র জন য সরক র অবহ ল
এছাড়াও পড়ুন:
চিম্বুকে ভালুকের আক্রমণে একজন আহত, ৫ বছরে ১০ জন হামলার শিকার
বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কের পোড়াবাংলা পটোসিংপাড়ায় আজ শুক্রবার সকালে ভালুকের আক্রমণে একজন গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁকে উদ্ধার করে বান্দরবান সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
বন বিভাগ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ২০২১ সাল থেকে ভালুকের আক্রমণ বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে ১০ জন আক্রমণের শিকার হয়েছেন। আক্রমণের শিকার ব্যক্তিদের অধিকাংশ ম্রো জনগোষ্ঠীর। ভালুকের কারণে আহত হওয়ার ঘটনায় আবেদন না করায় এই পর্যন্ত কেউ ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পোড়াবাংলা পটোসিংপাড়ার কাইনপ্রে ম্রো (৩৫) পাড়া থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে জুমখেতে কাজ করতে যান। সেখানে জুমের পাশে কলাবাগানে কাজ করার সময় হঠাৎ কালো রঙের একটি ভালুক তাঁর ওপর আক্রমণ করে। ভালুকটি তাঁর পেটে ও মুখে আঘাত করতে থাকে। তাঁর চিৎকারে আশপাশে জুমের লোকজন এগিয়ে আসেন।
আহত কাইনপ্রে ম্রোর ভাই তনরুই ম্রো জানিয়েছেন, আশপাশের লোকজনের এগিয়ে আসা দেখে ভালুকটি কাইনপ্রে ম্রোকে ছেড়ে দিয়ে বনে পালিয়ে যায়। তাঁরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে কাইনপ্রে ম্রোকে উদ্ধার করে দুপুরে বান্দরবান সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পোড়াবাংলা পটোসিংপাড়া জেলা শহর থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরে। পাড়াটি রুমা উপজেলার গালেংগ্যা ইউনিয়নে পড়েছে।
বান্দরবান সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আহত কাইনপ্রে ম্রোর পেটে ও মাথায় গভীর ক্ষত আছে। এ জন্য তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
জানা যায়, থানচি তিন্দু ইউনিয়নে মেনপই ম্রো নামের একজন ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল প্রথম ভালুকের আক্রমণের শিকার হন। ওই একজনসহ ২০২১ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৫ বছরে ১০ জন ভালুকের আক্রমণে আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে থানচিতে দুজন, রুমাতে তিনজন, আলীকদমে একজন ও বান্দরবান সদর উপজেলা চিম্বুক পাহাড়ে চারজন রয়েছেন। কারও মৃত্যু না হলেও তাঁদের মধ্যে কেউ চোখ হারিয়েছেন, কারও হাত–পা পঙ্গু হয়েছে। আহত ব্যক্তিরা একজন মারমা ও একজন খুমি ছাড়া অন্যরা সবাই ম্রো।
বন বিভাগের বান্দরবানের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আবদুর রহমান জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল কেটে উদ্যান বাগান ও জুমচাষ করা এলাকাগুলোতে ভালুকের আক্রমণ বেড়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, বাগানের কারণে ভালুক ও অন্যান্য বন্য প্রাণীরা আবাসস্থল ও বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যসংস্থান হারাচ্ছে। জীবনের তাগিদে তারা মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হতে বাধ্য হচ্ছে। বন নির্ভর মানুষকে অন্যভাবে আয়ের সংস্থানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল সংরক্ষণ না হলে বন্য প্রাণীর সঙ্গে সহাবস্থান গড়ে উঠবে না। এভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা না হলে বন্য প্রাণী ও মানুষ কারও জন্য মঙ্গলজনক হবে না।