রক্তকরবী নাটকের আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে শত-সহস্র, অযুত-নিযুতবার, অযুত-নিযুতভাবে। এসব আলোচনা-সমালোচনায় দেশজ শিল্পানুষঙ্গ কালেভদ্রে থাকলেও পরাশ্রয়ী শিল্পশাস্ত্রের নানা কৌশল প্রয়োগের আধিক্য রবীন্দ্রনাথ কিংবা রক্তকরবীকে স্বতন্ত্র মহিমায় উত্তীর্ণ করে পাঠকের মন থেকে এরূপ ভ্রান্তি-বিভ্রান্তির অপনোদন ঘটাতে রবীন্দ্রনাথেরই শরণাপন্ন হই আমরা। রক্তকরবী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন: “কর্ষণজীবী এবং আকর্ষণজীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে, এ সম্বন্ধে বন্ধুমহলে আমি প্রায়ই আলাপ ক’রে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে কেবলি উজাড় ক’রে দিচ্ছে। তাছাড়া, শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধা-তৃষ্ণা দ্বেষ-হিংসা, বিলাস বিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মতো।” তাঁর এ বক্তব্যেই রক্তকরবীর দ্বন্দ্ব চিহ্নিত। রক্তকরবী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন: “রাম হ’লো আরাম, শান্তি; রাবণ হ’লো চীৎকার, অশান্তি। একটিতে নবাঙ্কুরের মাধুর্য্য, পল্লবের মর্মর, আর-একটিতে শান বাঁধানো। রাস্তার উপর দিয়ে দ্বৈত রথের বীভৎস শৃঙ্গধ্বনি। কিন্তু তৎসত্ত্বেও রামায়ণ রূপক নয়, আমার রক্তকরবীর পালাটিও রূপক নাট্য নয়।” নাট্যকারের এমন স্বীকারোক্তির পরও রক্তকরবীকে ‘রূপক’ বা ‘সাংকেতিক’ নাটক হিসেবে প্রমাণের জন্য আমরা কী কুস্তিই-না করে চলেছি, সে ইতিহাসও প্রায় শতবর্ষের! এ নাটকের যক্ষপুরীর রাজা আর মানবী নন্দিনী সম্পর্কিত এর চেয়ে উৎকৃষ্ট বক্তব্য আর কোথায়? রক্তকরবী রচনার শতবর্ষ উদযাপন বা উত্তীর্ণের কালেও আমরা নাটকটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনায় শিল্পশাস্ত্রের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির নৈয়ায়িক নিরিখ প্রয়োগ করি না। অর্থাৎ দেশীয় নাট্যদর্শন ও নাট্যভঙ্গি নির্মাণে রবীন্দ্রনাথ যে স্পষ্ট বয়ানে আমাদের সচেতন করার প্রয়াস পেয়েছিলেন, এ কালের নাট্যনন্দন ভাষ্যকারদের আলোচনা-সমালোচনায় তার প্রকাশ বা প্রমাণের অভাব এখনও স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাট্য আলোচনায় আমরা ঘুরেফিরে পাশ্চাত্য শিল্পশাস্ত্রের আনুকূল্য নিই।
তথাকার চশমার রঙিন ফ্রেমেই নাটক দেখি, ব্যাকুলও হই। বিভ্রান্তও যে হই তা কোনোক্রমেই বুঝতে চাই না। কী এক অদ্ভুত ও আশ্চর্য কারণে রবীন্দ্রনাটক মূল্যায়নে ইউরোপাগত বাঁধাধরা ছককেই সমালোচকগণ যেন বা রক্ষাকবচ হিসেবে বেছে নেন! কিন্তু এ আত্মরক্ষা না আত্মহনন সে-সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার অবকাশটুকুও আমাদের নেই! বাংলা নাটক প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আমাদের বিবেক ও বিবেচনাবোধকে যে মাত্রায় সজ্ঞান করে গেছেন আমরা দিনদিন তার ওপর থেকে আলো সরিয়ে নিচ্ছি। উপরন্তু, বর্ণিত বিষয়ে নিজেদের চারপাশকে ক্রমাগত অন্ধকারে ছেয়ে ফেলছি। আর দূরবর্তী দৃষ্টিভঙ্গির খোরপোশ বহন করে চলেছি অনবরত। নিজস্ব নাট্যবোধ সম্পর্কে বাঙালির আত্মবিশ্বাস এতটাই নড়বড়ে যে, এখনও সে আত্মরক্ষার জন্য ধার করা শিল্পবোধেরই শরণ নিতে থাকে নিত্যনৈমিত্তিক। তাই বাংলা নাটক, নাট্যতত্ত্ব, প্রয়োগশৈলী, এমনকি নাটককেন্দ্রিক সমালোচনা শাস্ত্রটিও নানারূপ ভ্রান্তি-বিভ্রান্তির ঘূর্ণিপাকে দ্বিধাগ্রস্ত। রবীন্দ্রনাথ যা বলেননি আমরা তাই বলি, তিনি যা করেননি আমরা তাই করি। বরং বিভ্রান্ত কর্মযজ্ঞে গতি সঞ্চারে আমরা তিলমাত্র পিছপা হই না! আমরা এতটাই তড়িৎকর্মা যে, শতবর্ষ পরেও রক্তকরবী নাটক প্রসঙ্গে বিভ্রান্তির অপচ্ছায়াকেই আলিঙ্গন করি, এ বড় বিস্ময়কর! অর্থাৎ রক্তকরবীর আলোচনায় এখনও আমরা জোরপূর্বক ইউরোপাগত শিল্পশাস্ত্রের রূপক-সাংকেতিকতার অস্ত্রই তাক করে বসে থাকি! আমরা জানি, প্রথম জীবনে পাশ্চাত্য শিল্পরীতির অনুশীলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অল্প ক’টি নাটক লিখলেও পরবর্তীকালে (শারদোৎসব রচনার পর থেকে অবশ্যই) তিনি তাত্ত্বিক অবয়বসহ আমাদের নাটককে সাঙ্গীকৃত করেছেন হাজার বছরের বাংলা নাট্যধারার প্রবহমান স্রোতের সঙ্গে। এ বিষয়ে শঙ্খ ঘোষের উপলব্ধি এরূপ: ‘জাতীয় জীবনের স্মৃতির মধ্যে কীভাবে তিনি জড়িয়ে নিয়েছিলেন তাঁর নাট্যগঠনকে, বিষয় এবং বিন্যাসের সমন্বয়ে কেমন করে তিনি পাচ্ছিলেন এক দেশীয় নাট্যধরন।’
সহস্রবর্ষের বাংলা নাটকের ইতিহাসের ধারা অস্বীকার করে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এ অঞ্চলে ইউরোপীয় আঙ্গিকের নাট্যচর্চার সূচনা। ইংরেজ আগমন ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিদের চর্চিত নাট্যধারা আধুনিককালের নাট্যচর্চা হিসেবে চিহ্নিত। উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন প্রবর্তনের পর রাশিয়ার পর্যটক লেবেদেফ প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’-এর কার্যক্রম থেকে এই অঞ্চলে প্রোসিনিয়াম মঞ্চে ইউরোপীয় ঢঙে বাংলা আধুনিক নাট্যধারার সূচনা। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে ইংরেজি-আদলে আধুনিক সাহিত্যচর্চারও শুরু। তথাকথিত এই আধুনিককালের নাট্যধারায় বিশেষ স্থান দখল করেছিল ইউরোপীয় নাট্যআঙ্গিকের অনুসরণ ও অনুকরণ। অপরদিকে, হাজার বছর ধরে বাহিত বঙ্গভূমির বিচিত্র আঙ্গিকের ঐতিহ্যবাহী নাট্যসমূহ অপাঙ্ক্তেয় ও গ্রামীণ মানুষের শিল্পরূপে অবহেলিত হতে থাকে। উপরন্তু, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সেসব নাট্যআঙ্গিক জাতীয়তাবোধের জায়গায় স্থানলাভেও সমর্থ হয়নি। বলা বাহুল্য, সমকালীন কলকাতাকেন্দ্রিক নাট্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক প্রয়াস অনেকটা সে রকমই ছিল। তাই তাঁর রাজা ও রানী এবং বিসর্জন নাটকে শেক্সপিয়রীয় নাট্যরীতির অনুশীলন দেখা যায়। কিন্তু ‘রঙ্গমঞ্চ’ নামক প্রবন্ধে দেশজ নাট্যের স্বকীয়তা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট মত ব্যক্ত হয়। ‘রঙ্গমঞ্চ’ পরবর্তী নাট্যরচনায় তিনি বাঙালির নিজস্ব নাট্যআঙ্গিকের এক নবতর প্রতিফলনে প্রয়াসী ছিলেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাট্যের অবয়ব গঠনে ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যআঙ্গিকের সাঙ্গীকরণ ও নবীকরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অথচ আশ্চর্য কারণে অধিকাংশ সমালোচকই সে প্রসঙ্গ বিস্মৃত হন!
দুঃখজনক হলেও রবীন্দ্রনাট্যসমূহের ওপর ‘রূপক, সাংকেতিক, তত্ত্ব’ এরূপ নানা অভিধার সমালোচনাসূচক পোশাক চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাই অত্যধিক। শুধু তাই নয়, আমাদের সমালোচনা সাহিত্য এবং গবেষণায় অনেকটা জোরপূর্বক উক্ত ধারণা প্রচার-প্রসারেই অনেককে উদ্ভ্রান্ত ও তৎপর দেখা যায়। এতে রবীন্দ্রনাটক স্বচ্ছন্দ হয় না আড়ষ্টতায় আচ্ছন্ন হয় তা নিয়ে ভাববার ফুরসত নেই!
কলকাতাকেন্দ্রিক সমকালীন নাট্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত নাট্যধারার বিপরীতে যে নতুন আবহ সৃষ্টিতে মনোযোগী ছিলেন তা সাধারণ রঙ্গালয়ের ইউরোপাগত প্রয়োগকৌশলে অভ্যস্ত নাট্যকুশীলব, এমনকি দর্শকের কাছেও সমাদৃত হয়নি। তাই সাধারণ রঙ্গালয়ে রবীন্দ্রনাটক উপেক্ষিত এবং স্বল্প-চর্চিতই থাকে। লক্ষণীয়, এ সময় তিনি প্রচলিত নাট্যধারার বিপরীতে দেশীয় ‘পালা’, ‘যাত্রা’, ‘ব্রতকথা’, ‘নাটগীত’, ‘পাঁচালি’ প্রভৃতির প্রেরণাসম্ভূত সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক আধুনিক নাট্যধারা সৃজনে সচেষ্ট হন। রবীন্দ্রনাথের এ প্রয়াস ও তাঁর নাট্যভাবনা সম্পর্কে শারদোৎসব, মালিনী, আমার ছেলেবেলা, রক্তকরবী, রঙ্গমঞ্চ (প্রবন্ধ) প্রভৃতি রচনার মধ্যে বিস্তৃত পরিচয় রয়েছে। রক্তকরবী নাটকের নন্দিনী, রঞ্জন, কিশোর, রাজা, সর্দার, ফাগুলাল, অধ্যাপক সকলেই ঐতিহ্যচেতনারই উৎসজাত। রবীন্দ্রনাথ কোনো কোনো নাটককে একাধিকবার ‘পালা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এসবের মধ্যে রক্তকরবী উল্লেখযোগ্য। রক্তকরবী নাটকের ‘প্রস্তাবনা’য় রবীন্দ্রনাথ এভাবে ‘পালা’ শব্দের প্রয়োগ করেছেন: “আজ আপনাদের বারোয়ারী সভায় আমার ‘নন্দিনী’র পালা অভিনয় .
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: রব ন দ র আম র প ল প রসঙ গ নন দ ন কর ছ ন আম দ র ন টক র ইউর প
এছাড়াও পড়ুন:
ঘাস খেতে খেতে সীমান্তের ওপারে ১০ গরু, ফেরত দিল বিএসএফ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়া ১০টি গরু আটক করেছিল বিএসএফ। পরে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে গরুগুলো বাংলাদেশে ফেরত দেওয়া হয়। রবিবার (১৫ জুন) দুপুর ১টার দিকে গরুগুলো বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে বিএসএফ।
বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সকাল ৯টার দিকে আখাউড়ার কালিকাপুর এলাকায় কাঁটাতারের কাছাকাছি ঘাস খাওয়ানোর জন্য স্থানীয়রা গরু চড়ান। এসময় কয়েকটি গরু ঘাস খেতে খেতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের অংশে ঢুকে পড়ে। পরে বিএসএফ সদস্যরা ১০টি গরু ধরে নিয়ে গিয়ে কাঁটাতারের কাছে বেঁধে রাখেন। স্থানীয়রা বিজিবির সঙ্গে যোগাযোগ করলে গরুগুলো ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বিজিবি ৬০ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘‘শূন্য রেখার কাছে গরু চড়ানোর কারণে সম্প্রতি প্রায়ই গরু ভারতের অংশে ঢুকে পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে বিএসএফের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল। আজ কিছু গরু ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ায় বিএসএফ তা আটক করেছিল। পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে গরুগুলো ফেরত আনা হয়েছে।’’
আরো পড়ুন:
ঠাকুরগাঁও সীমান্ত দিয়ে আরো ২৩ জনেকে ঠেলে দিল বিএসএফ
চার ভারতীয়সহ ১৬ জনকে ঠেলে দিল বিএসএফ
ঢাকা/পলাশ/রাজীব