টেলিযোগাযোগ নামেই অধিদপ্তর, বাস্তবে ‘ঢাল-তলোয়ারহীন’
Published: 15th, April 2025 GMT
টেলিযোগাযোগ–সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় এবং নিরাপদ ইন্টারনেট ও টেকসই টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্য–উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয় টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর। তবে যাত্রা শুরুর ১০ বছর পরও উল্লিখিত কোনো কাজেই অধিদপ্তরের তেমন সংশ্লিষ্টতা নেই, বরং ওই সব কাজের জন্য সরকারের পৃথক সংস্থা রয়েছে। বিটিটিবির কর্মীদের চাকরির ধারাবাহিকতা রক্ষা ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো কার্যক্রমের নজির পাওয়া যায় না। যদিও অধিদপ্তরের দাবি, মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী তারা দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট।
বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি) বিলুপ্ত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির কয়েক হাজার কর্মীর চাকরির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য ২০১৫ সালে টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর গঠন করে সরকার। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন এ অধিদপ্তরের কর্মীদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডে (বিটিসিএল) প্রেষণে কর্মরত। এ ছাড়া টেলিটক, টেশিস, কেব্ল শিল্প সংস্থা, সাবমেরিন কেব্লস কোম্পানিতেও রয়েছেন কিছু কর্মী। প্রেষণে থাকা কর্মীরা অবসরের আগে অধিদপ্তরে এসে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শেষ করেন। টেলিকম ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই এখানে কাজ করেন।
টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরের বিষয়ে অবগত আছেন উল্লেখ করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব প্রথম আলোকে বলেন, বিটিআরসির সঙ্গে টিম হয়ে কাজ করা যায় কি না, সে ব্যাপারে অধিদপ্তরকে চিন্তা করতে বলা হয়েছে। টেলিকম খাতের অপারেটরদের সেবার মান পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের যুক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে। এখানে টেলিকম খাতের মেধাবীরা কাজ করেন এবং তাঁদের এই মেধাকে কাজে লাগাতে না পারলে এটা সংকুচিত হয়ে যাবে।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে যাঁদের বসানো হয়, তাঁরা চাকরিজীবনের শেষে এখানে যোগ দেন। এ ছাড়া তাঁদের বরাদ্দের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় বেতন–ভাতা বাবদ।বিটিটিবির কর্মীদের ‘পুনর্বাসনকেন্দ্র’
অধিদপ্তরের কার্যক্রম, বিভিন্ন প্রতিবেদন ও তাদের দেওয়া তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মূলত বিটিটিবির কর্মীদের পুনর্বাসনকেন্দ্র। টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর গঠনের পটভূমি, উদ্দেশ্য ও প্রধান কাজের শুরুতেই রয়েছে বিটিটিবির কর্মীদের চাকরি রক্ষা এবং তাঁদের বদলি, প্রেষণ, পদোন্নতি, অবসর প্রস্তুতি ছুটি, পেনশন ইত্যাদির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা।
টেলিযোগাযোগ খাত ও মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমিউনিকেশনসের (ডিওটি) আদলে দেশে একটি সংস্থা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়া বিটিটিবির কর্মীদের অনেকে কোম্পানিতে চাকরি করতে চাননি। তাই তাঁদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর হয়। কিন্তু তাঁদের কাজ অন্য সংস্থা করায় অবসরের অপেক্ষা করা ছাড়া উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মীর তেমন কিছু করার থাকে না। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে যাঁদের বসানো হয়, তাঁরা চাকরিজীবনের শেষে এখানে যোগ দেন। এ ছাড়া তাঁদের বরাদ্দের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় বেতন–ভাতা বাবদ।
বিটিআরসির সঙ্গে টিম হয়ে কাজ করা যায় কি না, সে ব্যাপারে অধিদপ্তরকে চিন্তা করতে বলা হয়েছে। টেলিকম খাতের অপারেটরদের সেবার মান পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের যুক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছেফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী‘অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ’
টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরের দুটি প্রকল্পের একটি সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স (সিটিডিআর)। প্রথম পর্যায়ে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল মেয়াদে ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। এর আওতায় ক্ষতিকর ওয়েবসাইট শনাক্ত ও সেগুলো ব্লক করতে আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) ও নিক্সে ফায়ারওয়াল ধরনের সরঞ্জাম বসানো হয়।
অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে ব্যান্ডউইডথ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্থাপিত সরঞ্জামের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল মেয়াদে সিটিডিআর প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় হাতে নেওয়া হয়। এতে ব্যয় হয় ৪২ কোটি টাকা।
মন্ত্রণালয় ও আইআইজি সূত্রে জানা যায়, সিটিডিআর প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউবের নির্দিষ্ট কোনো আধেয় (কনটেন্ট) ব্লক করে দেওয়া। কিন্তু প্রযুক্তিগত দিক থেকে তা সম্ভব নয়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মাধ্যমগুলোর ওপরই নির্ভর করতে হয়। এ অবস্থায় তারা পুরো ওয়েবসাইট ধরে ব্লক করার কার্যক্রম হাতে নেয়। মূলত পর্নো ও জুয়ার সাইট বন্ধ করে থাকে তারা।
অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে ব্যান্ডউইডথ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্থাপিত সরঞ্জামের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল মেয়াদে সিটিডিআর প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় হাতে নেওয়া হয়। এতে ব্যয় হয় ৪২ কোটি টাকা।আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (আইআইজিএবি) মহাসচিব আহমেদ জুনায়েদ প্রথম আলোকে বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথমে এটা শুরু হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সাইট ব্লক করার জন্য যে কাজ, তা আইআইজিগুলোই পারে। এ জন্য এত টাকা খরচ করার প্রয়োজন ছিল না।
দেশে যে পরিমাণ জুয়ার সাইট ও অ্যাপের ব্যবহার বেড়েছে, তাতে তো এই প্রকল্পের বিনিয়োগ অর্থহীন। যেসব সাইট বন্ধ করার কথা বলা হয়, তা ভিপিএন (ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) দিয়ে সহজেই ব্যবহার করা যায়। সাইট বন্ধের মতো সেন্সরশিপ না করে বরং সচেতনতা বাড়ানো দরকার ছিলতথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবিরআইআইজি কোম্পানিগুলো জানায়, আইআইজি থেকে আইএসপিতে (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার বা গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবাদাতা) ব্যান্ডউইডথ যাওয়ার পথেই অধিদপ্তরের ফায়ারওয়ালগুলো বসানো। অর্থাৎ দেশের গ্রাহকের কাছে যত আধেয় যায়, সেগুলো এর মধ্য দিয়ে যায়। এসব যন্ত্রপাতি বসানোয় বিদ্যুতের ব্যবহারও বেশি হয় এবং ইন্টারনেটের মানও পড়ে যায়।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির প্রথম আলোকে বলেন, দেশে যে পরিমাণ জুয়ার সাইট ও অ্যাপের ব্যবহার বেড়েছে, তাতে তো এই প্রকল্পের বিনিয়োগ অর্থহীন। যেসব সাইট বন্ধ করার কথা বলা হয়, তা ভিপিএন (ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) দিয়ে সহজেই ব্যবহার করা যায়। সাইট বন্ধের মতো সেন্সরশিপ না করে বরং সচেতনতা বাড়ানো দরকার ছিল।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ট ট ব র কর ম দ র প রকল প র স ট ড আর ব যবহ র ক জ কর ট ল কম র জন য স ইট ব কর র ক পর য য় প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
ক্যাম্পাসে বিনা মূল্যে রাউটার ও ৫০০ টাকায় ১৫ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট দেবে বিটিসিএল, পাবেন যেভাবে
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫০০ টাকায় ১৫ এমবিপিএস (মেগাবিট পার সেকেন্ড) ইন্টারনেট দেবে; সঙ্গে বিনা মূল্যে রাউটার দেবে তারা।
প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব গতকাল মঙ্গলবার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বিটিসিএলের ইন্টারনেট–সেবার বিষয়ে একটি পোস্ট দেন।
সেখানে বিটিসিএলের নতুন প্যাকেজটি তুলে ধরেন বিশেষ সহকারী। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য বিশেষ প্যাকেজ দেবে বিটিসিএল।
জিপন নামে বিটিসিএলের প্যাকেজের আওতায় ক্যাম্পাস–১৫ নামের একটি ইন্টারনেট প্যাকেজ চালু করা হচ্ছে। এতে ১৫ এমবিপিএস গতিতে মাসিক ৫০০ টাকায় ক্যাম্পাসে ইন্টারনেট দেওয়া হবে। সেবাটি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হবে।
বিটিসিএল টেলিফোন সেবা পরিচালনাকারী সরকারি সংস্থা। ২০০৮ সালের আগে এটি বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি) নামে পরিচিত ছিল। পরে একটি কোম্পানিতে পরিণত করা হয়, নাম হয় বিটিসিএল।
বিটিসিএল এখন টেলিফোন, ইন্টারনেট, ডোমেইন, ব্যান্ডউইডথ সঞ্চালন ইত্যাদি সেবা দেয়। অবশ্য তাদের ইন্টারনেট–সেবার গ্রাহক অনেক কম। বেসরকারি ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বা আইএসপিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে বিটিসিএল।
জিপন ইন্টারনেট প্যাকেজের আওতায় তারা ১ লাখ ১৩ হাজার ১৭৬ গ্রাহককে সেবা দেয়।
নতুন প্যাকেজ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিটিসিএলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নেটওয়ার্ক থাকা সাপেক্ষে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বিটিসিএল ৫০০ টাকায় ১৫ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট দেবে। তাদের সেবা পেতে টেলিসেবা অ্যাপ বা মাইবিটিসিএল সাইটে গিয়ে নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) করে প্রয়োজনীয় নথিপত্র দিতে হবে। সাধারণত তিন দিনের মধ্যেই সংযোগ দেওয়া হয়।
সংযোগ দেওয়ার পর কোনো সমস্যা দেখা দিলে, সে ক্ষেত্রে তাদের হটলাইন ১৬৪০২ নম্বরে অথবা অ্যাপের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে হয়। ২৪ ঘণ্টা সেবা পাওয়ার বিষয়টি তাদের জনবল ও সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।
বিটিসিএল টেলিফোন লাইন ও আইএসপিদের মতো তারের মাধ্যমে ইন্টারনেট–সেবা দেয়। গ্রাহক চাইলে দুভাবেই ইন্টারনেট সংযোগ নিতে পারবেন।
বিটিসিএল জানায়, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই তারা ৫০০ টাকায় ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট–সেবা দিয়ে আসছে। ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, ///////////১৫ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট দিতে তারা নিত ১৫ টাকা। ২০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট–সেবার মূল্য ১ হাজার ৫০ টাকা।////////////
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ফেসবুক পোস্টে জানান, ইন্টারনেট ও টেলিফোনের সংযোগ নিলে মাসিক চার্জের সঙ্গে অতিরিক্ত ১০০ টাকা যোগ হবে। টেলিফোন কল চার্জের ক্ষেত্রে বিটিসিএলের ‘অফিশিয়াল চার্জ’ প্রযোজ্য হবে। এই সেবা শুধু প্রিপেইড সেবা হিসেবে পাওয়া যাবে এবং অফার সীমিত সময়ের জন্য। এলাকাভিত্তিক সংযোগ ফি প্রযোজ্য।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ফেসবুক পোস্টে বিটিসিএলের আরও সেবার ব্যাপারে জানান। তিনি বলেন, বিটিসিএল তাদের ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) শ্রেণিতে কেনা ব্যান্ডউইডথের অতিরিক্ত ৪৫ শতাংশ বেনাপোলে ও ৪০ শতাংশ প্রণোদনা হিসেবে সারা দেশে দেবে।
আইএসপি শ্রেণিতে অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ, সরকারি বা করপোরেট শ্রেণিতে ইন্টারনেট গ্রাহকদের অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ, শিক্ষা শ্রেণিতে অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ ও ডেটা সেন্টার শ্রেণিতে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ ব্যান্ডউইডথ প্রণোদনা হিসেবে দেবে বিটিসিএল।