চট্টগ্রাম বন্দরে বে-টার্মিনাল নির্মাণ আর কতদূর
Published: 18th, April 2025 GMT
জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালটিংয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০৩৬ সালে ২০ ফুট দীর্ঘ ৫৬ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডল করতে হবে চট্টগ্রাম বন্দরকে। প্রতি বছর ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে এমন পূর্বাভাস তাদের। ক্রমবর্ধমান সমুদ্রবাণিজ্য সামাল দিতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে সক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ রয়েছে তাদের প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষায়। জাহাজ ও কনটেইনারজট দূর করে বন্দরকে আরও গতিশীল করতে কর্ণফুলীর মোহনায় বে-টার্মিনাল নামে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয় সংস্থাটি। এ পরামর্শ মেনে ২০১৬ সালে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করে বন্দর। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের ৭ বছর পরও শুরু হয়নি প্রকল্পের মূল কাজ। নির্মাণ হয়নি কোনো স্থাপনা। অথচ ২০২৬ সালের মধ্যে কার্যক্রমে যাওয়ার কথা ছিল সম্ভাবনাময় টার্মিনালটির।
ভূমি অধিগ্রহণ, বিনিয়োগকারী বাছাই, নকশা সংশোধন, অর্থায়নসহ নানা জটিলতায় বার বার পিছিয়েছে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ। অথচ ৯০৭ একর জমির ওপর ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এ টার্মিনাল নির্মিত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ত তিনগুণ। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতিশীলতা বাড়ত। কারণ, এখনকার জেটিতে শুধু দিনের জোয়ারের সময় গড়ে ৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫ মিটার গভীরতা এবং সর্বোচ্চ ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ নোঙ্গর করতে পারে। আবার শীত মৌসুমে এ গভীরতার জাহাজও জেটিতে ভিড়তে পারে না। নতুন টার্মিনাল মোহনার কাছাকাছি স্থানে হওয়ায় সেখানে দিন-রাত জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ থাকত। আবার বর্তমানের চেয়ে বেশি গভীরতা ও দৈর্ঘ্যের জাহাজও পেত সরাসরি নোঙ্গরের সুযোগ। ২০১৬ সালে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ আশা করেছিল, ২০২১ সালের মধ্যে ১৭৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের মাল্টিপারপাস টার্মিনাল এবং ১২৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করতে পারবে। বন্দরের সে আশা পূরণ হয়নি। এখনও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয়নি মূল প্রকল্প।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘নানা কারণে অনেক দেরি হয়েছে। একনেক-পূর্ববর্তী অনুমোদন হয়ে গেছে। এখন একনেকে অনুমোদনের জন্য উঠবে প্রকল্পটি। এজন্য তাদের কাছে কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। তারা সেগুলো দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) একনেকে অনুমোদন হওয়ার পরপরই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের ঋণচুক্তি হবে। এরপর পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করবেন তারা। শিগগির মূল কাজ শুরু করতে পারবে চট্টগ্রাম বন্দর।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো.
একনেকে উঠছে আগামীকাল
নানা জটিলতা কাটিয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আগামীকাল রোববার একনেকে উঠতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল প্রকল্প। একনেকে অনুমোদন পেলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৬৫ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি সই করবে বাংলাদেশ। নতুন টার্মিনালে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার অপেক্ষায় আছে সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড। সব জটিলতা নিরসন করে এরই মধ্যে প্রি-একনেক অনুমোদন হয়ে গেছে প্রকল্পের। এখন ডিপিপি অনুমোদনের জন্য উঠবে একনেকে।
সরকার ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে বে-টার্মিনাল নির্মাণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। একই বছরে জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালট্যান্ট প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে। এরপর ২০১৭ সালে পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও মাস্টারপ্ল্যান তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে ২০২১ সালে কুনহুয়া নামে কোরিয়ান কোম্পানিকে আবার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং মাস্টারপ্ল্যান তৈরির জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় চলে যায় জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে। একপর্যায়ে চট্টগ্রাম বন্দরকে ৫০০ একর জায়গা প্রতীকী মূল্যে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের স্বার্থে বিগত সরকারের আমলে ৩ হাজার কোটি টাকা মূল্যের জায়গা মাত্র ৩ কোটি টাকায় দেওয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সর্ববৃহৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন হয় ২০১৮ সালে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছরের ১ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এরই অংশ হিসেবে জেলা প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে বন্দর কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছিল প্রকল্প স্থান। প্রকল্প এলাকায় থাকা ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ বাবদ বন্দর থেকে ৩৬৪ কোটি টাকা পাওয়ার পর জমি বুঝিয়ে দেয় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন।
কী থাকবে নতুন টার্মিনালে
৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বে-টার্মিনালের তিনটি অংশের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব জেটি দেড় হাজার মিটার। সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি এবং ডিপি ওয়ার্ল্ডের জন্য প্রস্তাবিত জেটির দৈর্ঘ্য হচ্ছে এক হাজার ২২৫ মিটার করে। চট্টগ্রাম বন্দরে শুধু জোয়ারের সময় জাহাজ আসা-যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বে-টার্মিনাল নির্মিত হলে থাকবে না এমন বাধা। ব্রেক ওয়াটার সুবিধা থাকায় ভাটার সময়েও ১৪ মিটার গভীরতার যে কোনো আকৃতির জাহাজ সহজে নোঙর করার সুবিধা পাবে বে-টার্মিনালে।
বছরে ৫০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতার বন্দর এখন বছরে হ্যান্ডল করছে ৩০ থেকে ৩২ লাখ কনটেইনার। ১২ কোটি টন কার্গো পণ্যও হ্যান্ডল করছে। বে-টার্মিনাল হলে সক্ষমতা আরও তিনগুণ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিকভাবে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি কনটেইনার টার্মিনাল ও একটি মাল্টিপারপাস। প্রতিটি টার্মিনালের সঙ্গে যুক্ত থাকবে রাস্তা, রেললাইন, ড্রেনেজ সিস্টেম ও অন্যান্য লজিস্টিক সুবিধা। এসব অবকাঠামোকে কেন্দ্র করে বাড়বে বন্দরের সক্ষমতা।
১৪ হাজার ৯০৮ কোটি টাকার প্রকল্প
বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ১৪ হাজার ৯০৮ কোটি টাকার সহায়ক প্রকল্প অনুমোদন দিতে যাচ্ছে সরকার। বে-টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (বিটিএমআইডিপি) শীর্ষক প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় একটি ব্রেকওয়াটার ও নেভিগেশন অ্যাকসেস চ্যানেল নির্মাণ করা হবে। এছাড়া কমন ফ্যাসিলিটিজ, সংযোগ সড়ক, রেলপথ, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ স্থাপন, টার্মিনালের অভ্যন্তরীণ রাস্তা এবং একটি সার্ভিস জেটি নির্মাণ করা হবে। পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি ২০৩১ সালের জুনের মধ্যে সম্পন্নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে তার আগেই তিনটি টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হবে।
কোন খাতে খরচ হবে কত টাকা
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পে ব্রেকওয়াটার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। নেভিগেশন অ্যাকসেস চ্যানেলের জন্য ১ হাজার ৯৭৯ কোটি এবং রেল, সড়ক সংযোগসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামোতে ব্যয় হবে ৩ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া নেভিগেশনে সহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপনে সম্ভাব্য খরচ ৫৭ কোটি টাকা।
স্বাক্ষর হয়েছে সমঝোতা স্মারক
তিনটি টার্মিনালের মধ্যে দুটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) ব্যবস্থায় নির্মিত হবে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে পিপিপি কর্তৃপক্ষ এবং এন্টারপ্রাইজ অব সিঙ্গাপুরের মধ্যে টার্মিনাল ১-এর জন্য একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে টার্মিনাল-২ নির্মাণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে আরেকটি এমওইউ স্বাক্ষর হয়। এছাড়া একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আবুধাবি পোর্টস গ্রুপের একটি এমওইউ সই হয়েছে গত বছরের মে মাসে। প্রকল্পের জন্য মোট ৮৫ কোটি ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণের প্রয়োজন হবে বলে ধারণা করা হয়েছে। অতিরিক্ত ঋণও বিশ্বব্যাংক দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। সম্প্রতি প্রকল্পটি নিয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রস ত ব ত প রকল প র র জন য একন ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
গুম করা হতো তিনটি ধাপে
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিদের কীভাবে গুম করা হতো, সেটি গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কমিশন বলেছে, ‘তিন স্তরের পিরামিড’–এর মাধ্যমে গুমের বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হতো।
এই পিরামিডের সর্বোচ্চ স্তরে ছিল ‘কৌশলগত নেতৃত্ব’। যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ছিলেন।
পিরামিডের দ্বিতীয় স্তরে ছিলেন বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। আর পিরামিডের তৃতীয় স্তরে থাকা বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ ৩৪৫ জন।
আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থায় গত সাড়ে ১৫ বছরে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, যেখানে গুমের ঘটনায় নীরব সম্মতি থাকার বিষয়টি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিল বিষয়টি (গুমের মতো গুরুতর অপরাধেও নীরব থাকা)। গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি তখন অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হতো না।
■ গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে ১,৮৫০ অভিযোগ এসেছে। ■ যাচাই-বাছাই হয়েছে ১,৩৫০টি। ■ এখনো নিখোঁজ ৩৪৫ জন।গুমের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার মধ্যে নীরবতা কেন ছিল, তা খুঁজেছে কমিশন। এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে তখন বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার ভেতরে বিষয়টি (গুম) অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো না। বরং সেগুলোকে হয়তো একটি বৃহত্তর অভিযানের অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে, যা বাহিনীর অভ্যন্তরে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ এবং ‘জনশৃঙ্খলা রক্ষার’ প্রয়োজনে স্বাভাবিক ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এসব কাজকে বিচ্যুতি নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ অনুযায়ী নিয়মিত দায়িত্ব হিসেবেই পালন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত একজন কর্মকর্তার নথিতে তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের (পরে পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে অবসরে যান, এখন পলাতক) মূল্যায়ন ছিল, ওই কর্মকর্তা কর্মদক্ষতার দিক থেকে ‘খুবই সন্তোষজনক’ এবং তাঁর নেতৃত্বগুণ ‘উচ্চমানের’।
ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে বেনজীর আরও লিখেছিলেন, তিনি ‘ভদ্র’, ‘সৎ স্বভাবের’ এবং ‘অত্যন্ত দক্ষ’। ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে নথিতে কোনো নেতিবাচক তথ্য লেখা হয়নি। যদিও তিনি গুমের ঘটনায় জড়িত ছিলেন।
অবশ্য অন্য একজন কর্মকর্তার বিষয়ে নথিতে দুর্নীতি ও অসদাচরণের অনেক অভিযোগ লেখা আছে। এমনকি সেখানে বিস্তারিতভাবে বলা আছে, ওই কর্মকর্তা নিয়মিতভাবে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন পরিচালক জিয়াউল আহসানের (পরে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার বা এনটিএমসির মহাপরিচালক হন, এখন কারাগারে) কাছে ‘ফিশ থেরাপি’ (মাছ উপহার) পাঠাতেন। তবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে তাঁর জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো তথ্য নথিতে উল্লেখ নেই।
গণ–অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে। এই কমিশনকে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয় গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। সেখানে গত ১৫ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
কমিশনের প্রতিবেদনে একটি বন্দিশালায় প্রহরীর দায়িত্ব পালন করা একজনের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। বন্দিশালায় প্রথম গিয়ে ওই প্রহরী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘বন্দীদের সাথে কখনো স্বাভাবিক আচরণ করা যাবে না, যেটা স্বাভাবিক মানুষের সাথে করা হয়। তাদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখতে হবে, সব অধিকার থেকে। যাতে সে কষ্ট অনুভব করতে পারে।’
ওই প্রহরী কমিশনকে বলেছেন, বন্দিশালার দায়িত্ব থেকে তিনি অব্যাহতি চেয়েছিলেন। তখন তাঁকে বলা হয়েছিল, দায়িত্ব পালন না করলে তাঁর প্রাণের ঝুঁকি আছে।
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে গুমগত ৬ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুমে জড়িত ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনই ডিজিএফআইয়ের (প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর) সাবেক মহাপরিচালক এবং একজন সাবেক পরিচালক। তাঁরা হলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদীন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ তৌহিদ-উল-ইসলাম।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ছয় কর্মকর্তা যখন ডিজিএফআইয়ের উচ্চ পদে ছিলেন, তখন সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও হাসিনুর রহমান এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান গোপন বন্দিশালায় আটক ছিলেন।
মেজর জেনারেল পদমর্যাদার একজন সেনা কর্মকর্তা গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে স্বীকার করেছেন, তিনি যখন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (সিটিআইবি) পরিচালক ছিলেন, তখন আমান আযমীর গুমের বিষয়ে তিনি সাইফুল আলম ও আহমেদ তাবরেজ শামসকে জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া ডিজিএফআইয়ের একজন কর্মকর্তা কমিশনকে বলেছেন, আমান আযমী ও মাইকেল চাকমাকে গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা ডিজিএফআইয়ের অন্তত তিনজন কর্মকর্তা গত নভেম্বর পর্যন্ত পিআরএলে (অবসরোত্তর ছুটি) ছিলেন। তাঁরা তখনো সেনা আইনের অধীন ছিলেন। বিশেষ করে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে তাঁদের সেনাবাহিনীর অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ত। এখন তাঁদের হদিস নেই।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সমন্বিতভাবে অন্যায় নির্দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। কারণ, কর্মকর্তারা অন্যায় আদেশ মানতে বাধ্য নন। এই নীতির কথা সবাই জানতেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কর্তব্যে চরম অবহেলা ছিল। তাঁরা অধস্তনদের দিকনির্দেশনা বা মানসিক সহায়তার কোনো উদ্যোগ নেননি।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের ন্যায়সংগত আদেশ পালন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে কোনো অন্যায় আদেশ পালনে কেউ বাধ্য নন। গুম–খুনের আদেশ যাঁরা বাস্তবায়ন করেছেন, তাঁদের বিচক্ষণতার অভাব রয়েছে। এসব অন্যায় আদেশ বাস্তবায়ন করা তাঁদের দায়িত্ব নয়, সেটি তাঁরা অনুধাবন করতে পারেননি। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বিচারহীনতার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।