এবারের গ্রীষ্মে লোডশেডিং সীমিত রাখার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, গ্রীষ্মে ১৮ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ কারণে বাড়তি এলএনজি আনা হচ্ছে। জ্বালানি তেল এখন যেটা পিডিবি নিচ্ছে না, সেটাও নেওয়া হবে। পুরোপুরি লোডশেডিং–মুক্ত না হলেও সহনীয় মাত্রায় থাকবে।

‘জ্বালানি–সংকট: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক সেমিনারে আজ শনিবার দুপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের সহায়তায় বিদ্যুৎ ভবনের বিজয় হলে এ সেমিনারের আয়োজন করে জ্বালানি খাতের সাংবাদিকদের সংগঠন ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স অব বাংলাদেশ (এফইআরবি)।

বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, বকেয়া বিল নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তাই কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), জ্বালানি তেলের মতো প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করা যাবে। আশা করা হচ্ছে, পরিস্থিতি সামলানো যাবে। তবে খরচও কমাতে হবে। তাই জ্বালানি তেল ব্যবহারের বিষয়টাও হিসাবে রাখতে হবে। ইতিমধ্যে দিনে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। ওই সময় ১৭৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে। লোডশেডিংয়ে গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য থাকবে না। ঘাটতি শুরু হলেই পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) গ্রাম এলাকা দিয়ে লোডশেডিং শুরু করে; এবার এটা হবে না।

বকেয়া শোধ করতে গিয়ে ভর্তুকি বেড়েছে, এটি আরও বাড়বে কি না; সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, চলতি অর্থবছরে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাঁট করা হয়েছে। এতে অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো হয়েছে। সাশ্রয় করা অর্থ বকেয়া শোধে কাজে লেগেছে। আগামী বছর তো বকেয়ার দায় নেই। তাই যতটুকু আমদানি হবে, ততটুকুর বিল। ভর্তুকি বাড়বে না, আরও কমবে।

সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, সমুদ্রে তেল–গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র জমা না দেওয়ার বিষয়ে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে পেট্রোবাংলার কমিটি কথা বলেছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) সংশোধন করা হচ্ছে। এরপর নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হবে।

তবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) হাতে দেওয়ার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের বিষয়টি বিইআরসিতে দিতে চান। তবে হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে কি হবে? এখন তো সরকার ভর্তুকি দিয়ে সমন্বয় করে। তাই এটা নিয়ে এখনো বিতর্ক আছে। এখন তেলের দাম কম। প্রতিবেশী দেশের দাম বিবেচনায় কমানো হচ্ছে না। এ রকম নানা বিষয় চিন্তা করতে হয়। নাজুক পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করে কি না; সেটাও বিবেচনায় রাখতে হয়।

কাতারের জ্বালানিমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, বকেয়া শোধ করায় দাম কমানোর বিষয়ে বলা হয়েছিল। কাতার বলেছে, বিদ‍্যমান চুক্তিতে কিছু করা যাবে না। তবে ভবিষ্যতে আরও এলএনজি আমদানি করা হলে, তারা কম দামে দেবে।

শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, বেশি দামে গ্যাস নেওয়ার জন্য ৬০০ থেকে ৭০০ আবেদন জমা পড়েছে। তারা প্রতি ইউনিট ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দিয়ে গ্যাস নিতে চায়। অথচ সবাই বলেছে, বিনিয়োগ ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। আর বলছে বৈষম্য, কিসের বৈষম্য। যার প্রয়োজন সে যদি বেশি দামে নেয়, তাহলে কিসের বৈষম্য। গ্যাসের দাম বেশি হলে তারা বিকল্প জ্বালানি দেখবে।

বিদ্যুৎ খাত নিয়ে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বিদ্যুৎ খাতের মূল সমস্যা হলো ভোক্তাদের শোষণ করার জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তিগুলোতে ট্যারিফ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই ট্যারিফ পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি কাজ করছে। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচকে বেঞ্চমার্ক ধরা হয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক‍্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, এখন দেশে ব্যবহৃত গ্যাসের ২৫ শতাংশ আমদানি হয়। ২০৩০ সালে আমদানি করা এলএনজির অংশ হবে ৭৫ শতাংশ—এটা বলেই শিল্পে গ‍্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল পেট্রোবাংলা। পুরোপুরি আমদানির দিকে চলে যাচ্ছে জ্বালানি খাত। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুরো সক্ষমতা ব্যবহার না করে বেশি খরচের তেলচালিত কেন্দ্র চালানো হচ্ছে। জ্বালানি শুধু উন্নয়নের বিষয় নয়, ন‍্যায়ের বিষয়, যা প্রতিষ্ঠা করা যুদ্ধের মতো।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জ্বালানিনীতির সংস্কার দরকার। যেখানে জ্বালানি রূপান্তরের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে থাকবে। সংকট সমাধানে বর্তমান সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত জ্বালানি রূপান্তরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে আসছে। জ্বালানি চাহিদার প্রক্ষেপণ নতুন করে মূল্যায়ন করা দরকার। কোনোভাবেই এলএনজিকে উৎসাহিত করবেন না, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান বাড়াতে হবে।

সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন পিডিবির চেয়ারম্যান মো.

রেজাউল করিম ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম‍্যান মো. রেজানুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন এফইআরবির চেয়ারম্যান শামীম জাহাঙ্গীর ও সঞ্চালনা করেন নির্বাহী পরিচালক সেরাজুল ইসলাম।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উপদ ষ ট আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

এলএনজি আমদানি: ব্যয় হবে ১৬২০ কোটি ৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা

দেশের জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে গত কয়েক বছর ধরে স্পট মার্কেট থেকে আন্তর্জাতিক কোটেশনের মাধ্যমে এলএনজি আমদানি করছে সরকার।

এরই অংশ হিসেবে পৃথক তিনটি কোটেশনের মাধ্যমে আগামী মে, জুন ও জুলাই মাসের জন্য এই তিন কার্গো এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এতে মোট ব্যয় হবে এক হাজার ৬২০ কোটি ৫ লাখ ২৮ হাজার ৬৬৪ টাকা।

মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় প্রস্তাব তিনটিতে অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় কমিটির সদস্য ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আরো পড়ুন:

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল

নতুন বছরের আগ মুহূর্তে কেরোসিন-ডিজেলের দাম কমল

সভা সূত্রে জানা গেছে, ‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮’ অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক কোটেশন প্রক্রিয়ায় স্পট মার্কেট হতে ১ কার্গো (২২-২৩ মে ২০২৫ সময়ে ২০তম) এলএনজি আমদানির প্রত্যাশাগত অনুমোদনের জন্য সভায় উপস্থাপন করা হলে কমিটি তাতে অনুমোদন দিয়েছে।

সূত্র জানায়, পেট্রোবাংলার মে মাসের জন্য ১ কার্গো এলএনজি সরবরাহের জন্য মাস্টার সেল অ্যান্ড পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট (এমএসপিএ) স্বাক্ষরকারী চুক্তিবদ্ধ ২৩টি প্রতিষ্ঠানের  কাছ থেকে দরপ্রস্তব আহ্বান করা হলে ৫টি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দাখিল করে। দাখিলকৃত ৫টি প্রস্তাবই কারিগরি ও আর্থিকভাবে রেসপনসিভ হয়। দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সুপারিশে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর ভিত্তিক আরামকো ট্রেডিং সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের কাছ থেকে প্রতি এই এক কার্গো এলএনজি সংগ্রহ করবে। প্রতি এমএমবিটিইউ ১১.১৫ মার্কিন ডলার হিসেবে এক কার্গো সমান ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি ক্রয়ে মোট ব্যয় হবে ৫৩৪ কোটি ৭৬ লাখ ১১ হাজার ৩৬০ টাকা।

সূত্র জানায়, একই প্রক্রিয়ায় জুন মাসের অন্য এক কার্গো এলএনজির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে ৩টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে এবং প্রস্তাবই কারিগরি ও আর্থিকভাবে রেসপনসিভ হয়। দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে দরপ্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সুপারিশে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স গানভর সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড এই ১ কার্গো এলএনজি সরবরাহ করবে। প্রতি এমএমবিটিইউ ১১.২৭ মার্কিন ডলার হিসেবে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি ক্রয়ে মোট ব্যয় হবে ৫৪০ কোটি ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ১২৮ টাকা।

সভায় জুলাই মাসের জন্য ও এক কার্গো এলএনজি আমদানির একটি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে কমিটি। পেট্রোবাংলা কর্তৃক ১ কার্গো এলএনজি সরবরাহের জন্য এমএসপিএ স্বাক্ষরকারী চুক্তিবদ্ধ ২৩টি প্রতিষ্ঠানের  কাছ থেকে দরপ্রস্তাব আহ্বান করা হলে ৬টি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দাখিল করে। দাখিলকৃত ৬টি প্রস্তাবই কারিগরি ও আর্থিকভাবে রেসপনসিভ হয়। দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সুপারিশের প্রেক্ষিতে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ভিটল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেড নির্বাচিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এমবিটিইউ প্রতি এমবিবিইটএইউ ১১.৩৫৮৮ মার্কিন ডলার হিসেবে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি ক্রয়ে মোট ব্যয় হবে  ৫৪৪ কোটি ৭৭ লাখ ৫৩ হাজার ১৭৬ টাকা।

ঢাকা/হাসনাত/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গ্যাস খাতের পুরো বকেয়া শোধ করেছে পেট্রোবাংলা
  • আ’লীগ সরকার আমলের ৮ হাজার ৭০২ কোটি টাকার দেনা শোধ 
  • আ’লীগের রেখে যাওয়া ৮ হাজার ৭০২ কোটি টাকার দেনা শোধ 
  • গণ-অভ্যুত্থানের সময় অগ্নিসংযোগ, পুলিশের জন্য কেনা হচ্ছে ২০০ জিপ
  • এলএনজি আমদানি: ব্যয় হবে ১৬২০ কোটি ৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা
  • বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ বাড়ায় শিল্পে গ্যাস–সংকট