একবার শীর্ষস্থানীয় এক মিডিয়া হাউসের প্রধান বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে দেশের প্রান্তিক এলাকার কোনো একটি স্টোরি আইডিয়া নিয়ে কথা বলছিলাম। ঢাকার বাইরের আইডিয়া শুনে প্রথমে ভ্রু কুঁচকালেন। তারপর আলোচনা-পর্যালোচনা, এবং অবশেষে আইডিয়া বাতিল। সেই স্টোরিটি আমার আর করা হলো না। অথচ ওই স্টোরিটির সঙ্গে প্রান্তিক জনপদের মানুষদের জীবন জীবিকার লড়াইয়ের প্রসঙ্গগুলো জড়িত ছিল। জড়িয়ে ছিল সেই মানুষদের বঞ্চনা ও বৈষম্যের কাহিনি। এটি গণমাধ্যমের কাছে প্রান্তিক মানুষদের অবহেলা-উপেক্ষার ছোট একটি উদাহরণ মাত্র। অথচ বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে গণমাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতিফলন ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। ‘গণমাধ্যম’ শব্দটির ভেতরে ‘গণ’ শব্দটি বেশ উপেক্ষিতই থাকছে। ‘পাঠক কী খাবে?’ অথবা ‘ভিউ কতটা বাড়বে?’- এসব প্রশ্নের আড়ালে গণমাধ্যমে গণমানুষের ঠাঁই মেলে খুব সামান্য। ফলে ‘না-বলা’ হাজারো গল্প গণমাধ্যমের বাইরেই থেকে যায়। নাগরিক কণ্ঠ আর কেন্দ্রে আসার পথ পায় না। গণমাধ্যমের উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারায় এই যুগে এসেও বড় প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়ায়- গণমাধ্যম কতটা সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখতে পারছে?
বৈষম্যমূলক সমাজ গড়তে প্রান্তজনের কণ্ঠস্বরের গুরুত্ব দিয়েছেন মনীষীগণ। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তারা প্রান্তিকের গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন এবং কাজে প্রতিফলন দেখিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী, রাজনৈতিক নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘প্রান্তিক মানুষের কথা না শুনলে, সমাজের প্রকৃত চিত্র অসম্পূর্ণ থেকে যায়।’ কালোত্তীর্ণ ইংরেজ সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক লেখক জর্জ অরওয়েল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ’গণমাধ্যমের কাজ হলো দুর্বলদের কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করা।’ আলবেনীয়-বংশোদ্ভূত ভারতীয় ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী এবং ধর্মপ্রচারক মাদার তেরেসা বলেছেন, ‘যে সমাজে প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না, সে সমাজ অসুস্থ।’ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘গণমাধ্যমকে হতে হবে নিরপেক্ষ এবং সকল মানুষের প্রতি সমান সংবেদনশীল।’
এই বাণীগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর গুরুত্ব প্রসঙ্গে ইঙ্গিত দেয়। এমন কি শেষ বাণীটি প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের দায়িত্ব মনে করিয়ে দেয়। আমরা বুঝতে পারি, গণমাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরা কতটা জরুরি। এবং এর মাধ্যমেই সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং সকলের জন্য গড়ে উঠতে পারে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ। গণমাধ্যমে প্রান্তিকের মানুষের কণ্ঠস্বর প্রতিফলন নিয়ে আলোচনা করার আগে প্রান্তিক বা প্রান্তজন নিয়ে খানিক আলোকপাত করা দরকার।
আরো পড়ুন:
গণমাধ্যমের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ নেই: তথ্য উপদেষ্টা
ফ্যাসিবাদের দোসর সাংবাদিকদের ক্ষমা চাওয়া উচিত: প্রেস সচিব
প্রান্তিক বা প্রান্তজন: উদাহরণ উপকূল
প্রান্তিক বা প্রান্তজনের উদাহরণ উপকূল অঞ্চল। প্রান্তিক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা প্রান্তজন শব্দ ভাবনায় এলেই আমাদের কল্পনায় দূরের কোনো সমাজ ভেসে ওঠে, যে সমাজ মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। কল্পনায় আসে এমন সমাজ, যেখানে রয়েছে বৈষম্য, অবহেলা, বঞ্চনা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি। এমন সমাজ, যা পিছিয়ে পড়া, সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত। প্রান্তিক বলতে আমরা এমন সমাজকে বুঝি, যে সমাজ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও পিছিয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রান্তিক সমাজে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। আমরা দেখতে পাই, প্রান্তিক সমাজে সুযোগের অভাব প্রকট। প্রান্তিক সমাজের মানুষেরা মৌলিক অধিকারের সাথে কখনো কখনো আপোস করতে বাধ্য হয়। সংবিধান এ দেশের মানুষকে কয়েকটি মৌলিক অধিকার চিহ্নিত কয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই মৌলিক অধিকারগুলো পেতেও প্রান্তিক সমাজের বহু মানুষকে লড়াই করতে হয়। শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবার অধিকার, কর্মসংস্থানের অধিকার মানুষের নাগালের বাইরে থাকে।
এই অধিকারগুলোর বিষয়ে তাদের সচেতনতাও নেই। সরকারি তরফে দেওয়া অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাগুলোও প্রান্তজনের কাছে পৌঁছায় না। প্রান্তিক সমাজ মূলধারা থেকে বৈষম্যের শিকার হয়। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, পেশা ভেদে তারা বৈষম্যের মধ্যে বসবাস করে। প্রান্তিক সমাজের মানুষদের একটি বড় অংশ দারিদ্র্যেও সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অভাব রয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এদের ভূমিকা থাকে না। সামাজিকভাবে তারা হেয় প্রতিপন্ন হয়। প্রান্তজনদের সামাজিক সুরক্ষা প্রক্রিয়া দুর্বল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো সংকটে এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরাই সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রান্তিক সমাজের উদাহরণ হিসাবে উপকূলকে হাজির করা যায়। আমরা যে বিচ্ছিন্নতার কথা বলি, বৈষম্যপূর্ণ সমাজের কথা বলি, প্রাকৃতিক বিপদের সংকটের কথা বলি, মৌলিক অধিকারের লড়াইয়ের কথা বলি- সব কিছুই উপকূল অঞ্চলে বিদ্যমান। গণমাধ্যমের জন্য উপকূল অঞ্চল সংবাদের বৃহৎ ক্ষেত্রও বটে। উপকূলের দিকে নজর দিলে আমাদের মনে পড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা। বারবার ঘূর্ণিঝড়ে নিঃস্ব হওয়া মানুষেরা আবার জীবনের সন্ধান করে এই উপকূলে। উপকূলে আছে সমস্যা-সংকট, মানুষের জীবন জীবিকার লড়াইয়ের গল্প। এর পাশাপাশি উপকূলজুড়ে আছে বৈচিত্র্যময় সম্ভাবনার নানান বিষয়। প্রাকৃতিক বিপদে বারবার হোঁচট খেয়ে উপকূল ঘুরে দাঁড়ায়, মাথা তোলে, আবার আমাদের সমৃদ্ধির পথ দেখায়। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূলের গুরুত্ব অপরিসীম। বিষয়টি সাদা চোখে ততটা অনুভব না হলেও যে কোনো বড় ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরে বিষয়টি আমাদের নজরে আসে খুব ভালোভাবে। কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে অজানা আরো অনেক বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমাদের সামনে আসছে নতুন নতুন সমস্যা। সেই সমস্যার প্রথম শিকার উপকূলীয় জনগোষ্ঠী। দেশের সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য, দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য উপকূল অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীমা। এখানেই উপকূল সাংবাদিকতা বা এ ধরনের প্রান্তিক গুরুত্ব পাওয়া সাংবাদিকতার গুরুত্বের কথা আসে।
প্রান্তিক, খবরের জন্মস্থান!
উপরে আলোচিত মনীষীদের কথাগুলোর রেশ ধরে উপকূলের দিকে তাকালে এটাই প্রান্তিক সাংবাদিকতার একটি বড় ক্ষেত্র, খবরের জন্মস্থান। এই আলোচনায় উপকূলকে উদাহরণ হিসাবে রেখে প্রান্তিক-নির্ভর সাংবাদিকতা গুরুত্ব তুলে ধরছি। বাংলাদেশের উপকূল নির্ধারণ করা হয়েছে তিনটি নির্দেশকের ভিত্তিতে। এগুলো হচ্ছে : ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস, জোয়ার-ভাটার বিস্তৃতি ও লবণাক্ততার প্রভাব। ১৯টি জেলা উপকূলের আওতাভূক্ত। এর মধ্যে তিনটি জেলা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁঁকিপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ। কিন্তু বাকি ১৬টি জেলার অধিকাংশ এলাকা সরাসরি উপকূল প্রভাবিত। উপকূল-ভিত্তিক সংকটগুলো এই জেলাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
বিষয় ও বৈশিষ্ট্যের নিরিখে উপকূল অঞ্চলকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো পূর্ব-উপকূল, মধ্য-উপকূল এবং পশ্চিম-উপকূল। ৫টি জেলা রয়েছে পূর্ব-উপকূলে। এগুলো হলো কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর। পূর্ব-উপকূলের একটি অংশ পাহাড় অধ্যুষিত। বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী, একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এই পূর্ব-উপকূলে অবস্থিত। পূর্ব-উপকূলের সঙ্গে আছে প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার সীমান্ত। সীমান্ত, পাহাড়, সমুদ্র সৈকতকেন্দ্রীক অনেক সংবাদের ইস্যু আছে উপকূলের এই অংশে।
এছাড়া নদীর ভাঙন, সমুদ্র, সমুদ্রকেন্দ্রীক জীবন, মাছধরা, পর্যটন ইত্যাদি ইস্যু রয়েছে এই অঞ্চলে। মধ্য-উপকূলের ৮টি জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, বরিশাল, চাঁদপুর এবং শরীয়তপুর। উপকূলের এই অংশে সবচেয়ে বড় ইস্যু দ্বীপ-চর, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি। ইলিশ আহরণের একটি বড় ক্ষেত্র এই অঞ্চল। নদীর ভাঙনও আছে এই অংশে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতসহ অনেক পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা আছে উপকূলের এই অংশে। পশ্চিম উপকূলে রয়েছে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা। উপকূলের এই অংশে আছে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে পরিচিত ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। সুন্দরবন ঘিরে আছে অনেক ধরনের খবরের ইস্যু। পশ্চিম উপকূলে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের খ্যাতি আছে। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় আঘাত করায় গোটা অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। আবাসন, জীবিকা, কৃষির ক্ষেত্রে নানান সংকট দেখা দিয়েছে। সুপেয় খাবার পানির সংকট ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। উপকূলের উন্নয়ন, সংকট সমাধান, সম্ভাবনা বিকাশ, পর্যটন শিল্প প্রসারসহ বিভিন্ন বিষয়ে গণমাধ্যম ভূমিকা রাখতে পারে।
সরকারের বিভিন্ন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের উপকূল অত্যন্ত গুরুত্বেও সঙ্গে স্থান পেয়েছে। ডেল্টা প্ল্যানের ৬টি হট স্পটের মধ্যে উপকূল অঞ্চল অন্যতম। ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় দেশের উপকূল অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। উপকূল অঞ্চলের জন্য সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে ‘উপকূল অঞ্চল নীতিমালা’ তৈরি হয়েছিল ২০০৫ সালে। এছাড়াও উপকূলের জন্য অনেক ধরনের নীতিমালা ও পরিকল্পনা আছে। এগুলোর সঠিক ও যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উপকূল সাংবাদিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রান্তজনের জন্য সাংবাদিকতা
আমাদের দেশের গণমাধ্যমে উপেক্ষিত প্রান্তজন। আমি নিজেই বহু বছর ধরে প্রান্তিক সাংবাদিকতার চর্চা করছি। আমার ফোকাস উপকূল, যা উপকূল সাংবাদিকতা নামে পরিচিত। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জন্য যে সাংবাদিকতা, সেটাই উপকূল সাংবাদিকতা। এক সময় শুধু ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি লক্ষ্য করে গণমাধ্যম উপকূলে নজর রাখতো। ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা কতটা, তার উপর নির্ভর করতো উপকূলের জন্য কতটুকু স্থান বরাদ্দ হবে। ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত পেয়ে কেন্দ্রীয় গণমাধ্যমের ক্যামেরা চোখ ফেরাতো উপকূলে। উপকূলের জন্য ছিল ইভেন্টভিত্তিক সাংবাদিকতা। কিন্তু এখন সেই ধারণা অনেকটাই বদলেছে। শুধু ঘূর্ণিঝড়ে নয়, স্বাভাবিক সময়েও উপকূলের মানুষের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, তা জানার আগ্রহ বেড়েছে মানুষের মাঝে। গণমাধ্যমও বিশেষ খবরের জন্য উপকূলের দিকে নজর দিচ্ছে।
উপকূল সাংবাদিকতা নিয়ে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সাংবাদিক ও গণমাধ্যমে আগ্রহ অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে তরুণ সাংবাদিকদের মধ্যে উপকূল ইস্যুতে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরির আগ্রহ অনেক বেড়েছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন এবং রেডিও মাধ্যমের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়, ‘উপকূল’ শব্দটির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। শিরোনামে আসছে শব্দটি। অথচ পাঁচ-দশ বছর আগে গণমাধ্যমে এই শব্দটির এতটা ব্যবহার আমরা দেখিনি। অঞ্চলভিত্তিক ইস্যু নিয়ে সাংবাদিকতার ধারণা অনেক পুরোনো হলেও ‘উপকূল সাংবাদিকতা’র ধারণা সূচিত হওয়ার সময়কাল খুব বেশিদিনের নয়। কিন্তু ইতোমধ্যে ধারণাটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আগ্রহী সাংবাদিকেরা বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ পেয়ে উপকূল সাংবাদিকতার বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশে উপকূল সাংবাদিকতার যাত্রা খুব দীর্ঘ না হলেও পৃথিবীজুড়ে উপকূল সাংবাদিকতার চর্চা অনেক পুরোনো। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডাসহ বিভিন্ন দেশে উপকূল সাংবাদিকতা অথবা উপকূলের ইস্যুতে গণমাধ্যমে ব্যাপক কাজ হচ্ছে অনেক আগে থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে পৃথকভাবে উপকূল ইস্যু নিয়ে অধ্যায় আছে। উপকূল অঞ্চলের ইস্যুর উপর ভর করে গড়ে উঠেছে অনেক গণমাধ্যম এবং সেগুলো যথারীতি জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন উপকূলে কমিউনিটি পর্যায়ে সংবাদপত্র, অনলাইন, টেলিভিশন, রেডিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি পাশের দেশ ভারতেও অনেকগুলো কমিউনিটি মিডিয়া প্লাটফরম গড়ে উঠেছে। এই গণমাধ্যমগুলো কমিউনিটির উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে কমিউনিটি মিডিয়া হিসাবে আমরা কয়েকটি রেডিও স্টেশন দেখতে পাই। সেগুলো নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ভূমিকা রাখছে। তবে ভবিষ্যতে উপকূল ইস্যুতে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা প্রসারের বড় সম্ভাবনা আছে।
প্রান্তিক সাংবাদিকতা: বিষয়-বৈচিত্র্য
বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্রে গা ঘেঁষে জেগে থাকা উপকূল অঞ্চল খবরের বৃহৎ ভাণ্ডার। খবরের জন্মস্থান উপকূলজুড়ে। অনুসন্ধান, ফিচার, বিশেষ প্রতিবেদন, সম্ভাবনা বিষয়ক প্রতিবেদন, জলবায়ু প্রতিবেদন, কৃষি প্রতিবেদন, শিক্ষা প্রতিবেদন, নারী-শিশু বিষয়ক প্রতিবেদন, দুর্নীতি-অপরাধ বিষয় প্রতিবেদন থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রতিবেদন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে উপকূল অঞ্চলে। ছোট পরিসরের এই আলোচনায় উপকূল অঞ্চলের সব বিষয় তুলে ধরা সম্ভব নয়। এখানে কিছু বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। এখান থেকে সাংবাদিকগণ নতুন নতুন স্টোরির ধারণা পেতে পারেন। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ ও বন। জলবায়ু পরিবর্তন এখন বিশ্বজুড়ে আলোচিত ইস্যু। এর সঙ্গে আছে পরিবেশ ও বন। পরিবেশ সাংবাদিকতা এক সময় খুব অবহেলিত ছিল। পরিবেশ বিটের সাংবাদিকদের বলা হতো কোনো খবর নেই বলে তারা ফুল-পাখির সংবাদ লিখে। পরিবেশের সঙ্গে জলবায়ু যুক্ত হয়ে এই বিট এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে পরিবেশ ও জলবায়ু সাংবাদিকতা এখন বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের এর প্রভাব পড়েছে। এগুলো নিয়ে স্টোরি তৈরির অনেক সুযোগ আছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে লক্ষণীয়, বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের উপকূলে উচ্চ জোয়ারের প্রভাবে জনজীবন ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। অনেকে সম্পদ হারায়, অনেকে বাড়িঘর স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে উপকূলের মানুষের জীবন ও জীবিকায়। জোয়ারের পানি কিংবা লবণ পানির তোড়ে নষ্ট হয় ফসল। নদী ও সমুদ্রকেন্দ্রীক জীবিকা ব্যাহত হয়। মানুষের উপার্জন কমে যায়। ফলে অনেক পরিবার শহরমুখী হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব আরো বাড়বে বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। আর এর প্রভাব সবার আগে উপকূল অঞ্চলেই পড়বে। উপকূল সাংবাদিকতায় এই বিষয়টি এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আগামীতে গুরুত্ব আরো বাড়বে।
এরপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা যদি বলি, প্রথমে আসে উপকূল। দেশ স্বাধীনের আগে ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় বা তারও আগে অনেক বার ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূল অঞ্চল। এর ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে। দুর্যোগের প্রভাব থেকে রেহাই পায়নি উপকূল; বরং সময় বদলের সাথে সাথে প্রাকৃতিক বিপদের মাত্রা বাড়ছে। উপকূলের প্রাকৃতিক বিপদকে কেন্দ্র করে অসংখ্য প্রতিবেদন ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
যুুগ যুগ ধরে উপকূলের মানুষের বিভিন্ন পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে আসছে; এখনো করছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে উপকূলের মানুষের জীবন জীবিকায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। উপকূল অঞ্চলের বিভিন্ন পেশাজীবীরা তাদের পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে শহরে চলে যাচ্ছে; যোগ দিচ্ছে ভারি কাজে। কৃষক টিকে থাকতে পারছে না চাষাবাদে, মৎস্যজীবীরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে না মাছধরা পেশায়। অধিকাংশ পেশাজীবীদের জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। পেশা এবং মানুষের জীবন ও জীবিকা বিষয়গুলো খবরের ইস্যু হতে পারে।
উপকূলজুড়ে বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকা- বিস্তৃত। এসব কাজে জড়িত আছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করেন নারীরাও। মাছ ধরা, কৃষি, চিংড়ি চাষ, লবণ চাষ, শুঁটকি শিল্প, পর্যটন শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে রয়েছে বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকা-। এসব নিয়ে সংকট যেমন আছে, তেমনি আছে বিপুল সম্ভাবনা। বিষয়গুলো উপকূল সাংবাদিকতার ইস্যু হতে পারে। উপকূল নিয়ে যারা কাজ করছেন, এই ক্ষেত্র থেকে তারা অনেক স্টোরির ধারণা পাবেন।
নাগরিক সেবা উপকূল অঞ্চলে সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি আছে নাগরিকদের জন্য। সরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে সেফটিনেট প্রোগ্রাম। প্রকল্পের সুবিধা প্রান্তিকের মানুষের কাছে কতটা পৌঁছাচ্ছে, না পৌঁছালে কী কারণে পৌঁছাচ্ছে না- এসব বিষয় নিয়ে স্টোরি হতে পারে। কোনো কর্মসূচি ইতিবাচক পরিবর্তন করলে তা নিয়েও স্টোরি হতে পারে।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা উপকূল সাংবাদিকতার জন্য একটি অন্যতম ইস্যু। ভৌগোলিক কারণেই উপকূলের অধিকাংশ এলাকায় যোগাযোগ অপ্রতুলতা রয়েছে। নৌপথ নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক সময় নাগরিকদের জীবন জীবিকা প্রভাবিত করে এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। যাতায়াত সংকটের প্রভাব পড়ে শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এগুলো অনুসন্ধান করলে দুর্দান্ত সব স্টোরি হতে পারে।
দুর্নীতি, অনিয়ম, অপরাধ অন্য এলাকার মতো উপকূল অঞ্চলেও বিদ্যমান। পূর্ব-উপকূলে এক সময় মানবপাচার বড় ইস্যু ছিল। মাদকের বাণিজ্য এখনো আছে। অপরাধী চক্র উপকূলের বন উজাড়ের সাথে জড়িত। দস্যুরা সমুদ্রগামী মৎস্যজীবীদের সর্বস্ব লুণ্ঠণ করে। সুন্দরবন এক সময় দস্যুদের অভয়ারণ্য ছিল। এখন যদিও অপরাধীর সংখ্যা কমেছে; কিন্তু একেবারে নির্মুল হয়নি। খাসজমিতে আছে ভূমিদস্যুর চোখ। উপকূল নিয়ে কর্মরত সাংবাদিকগণ এদিকে নজর রাখতে পারেন।
উপকূল অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন হচ্ছে। রাস্তাঘাট, ব্রীজ, কালভার্ট, ভবন ইত্যাদি নানান কিছু। এর পাশাপাশি আবার অপউন্নয়নও হচ্ছে। রাস্তাটি প্রয়োজন নাই, কিন্তু হচ্ছে। অথবা বেড়িবাঁধটি যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছে না। অনেক বড় বড় প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে মানুষের দুর্ভোগ কমেনি; বরং বেড়েছে। এসব নিয়ে স্টোরি পরিকল্পনা করা যেতে পারে।
উপকূলজুড়ে অনেক সম্প্রদায়/গোষ্ঠী রয়েছে। পশ্চিম-উপকূলে আছে বনজীবী; যারা সুন্দরবনকেন্দ্রীক জীবিকা নির্বাহ করে। বছরের কিছু সময় এরা কর্মহীন থাকে, কিছু সময় কাজ করে। বাঘবিধবা একটি ছোট জনগোষ্ঠী, যাদের স্বামী বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছে। এদের জীবনের লড়াই অনেক কঠিন। মধ্য-উপকূলে একটি ভাসমান জনগোষ্ঠী রয়েছে; যারা পরিবারসহ নৌকায় বসবাস করে এবং মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে আরেকটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায়- যারা বেদে নামে পরিচিত। পূর্ব-উপকূলে রয়েছে জলদাস সম্প্রদায়- যারা বংশপরম্পরায় মাছধরার উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও আছে আরো অনেক সম্প্রদায়। উপকূলের ক্ষুদ্র সম্প্রদায়গুলো অনেক বেশি সংকট মোকাবিলা করে। জলবায়ু পরিবর্তন তাদের সংকট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এগুলো নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্টোরি হতে পারে।
উপকূল সাংবাদিকতার জন্য সুন্দরবন একটি বড় ক্ষেত্র। বিশ্বঐতিহ্য এই ম্যানগ্রোভ বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলে দাঁড়িয়ে আছে প্রাকৃতিক ঢাল হিসাবে। বিগত এক-দেড় দশক ধরে ঘূর্ণিঝড়গুলো বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলে আঘাত করেছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত বুক পেতে সামলে নিয়ে সুন্দরবন তার প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ দেখিয়েছে। সুন্দরবন না থাকলে পশ্চিম উপকূলের জনজীবনের ব্যাপক ক্ষতি হতো। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপদের কারণে এবং অন্যান্য মানবসৃষ্ট বহুমুখী কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুন্দরবন ঘিরে অনেক স্টোরি করার সুযোগ আছে।
বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে অসংখ্য দ্বীপ-চর আছে। প্রাকৃতিকভাবেই এগুলো গড়ে ওঠে; আবার বিলীন হয়। দ্বীপ-চরগুলো সাংবাদিকদের জন্য খবরের বড় ক্ষেত্র। ভাঙ্গন কবলিত মানুষেরা দ্বীপে আশ্রয় নেয়। তারা সেখানে সম্পদ গড়ে। কিন্তু সেই সম্পদ হারিয়ে তারা আবার নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সম্পদশালী পরিবারগুলো বসবাসের স্থান খুঁজে ফেরে অন্যের বাড়িতে। দ্বীপ-চরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান। এর পাশাপাশি উপকূলের দ্বীপ-চরে সম্ভাবনাও আছে। কৃষি, খামার, মাছ চাষ, গবাদিপশুর বিচরণ ক্ষেত্র- ইত্যাদি অনেক ধরনের সম্ভাবনা আছে দ্বীপ-চর এলাকায়। এসব বিষয় নিয়ে অনেক স্টোরি তৈরি হতে পারে।
উপকূলের জন্য দিবসকেন্দ্রীক অনেক প্রতিবেদনের সুযোগ আছে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছিল বাংলাদেশের উপকূলে। নিশ্চিহ্ন হয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। এক একটি জনপদ মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় দশ লক্ষ মানুষ। গত কয়েক বছর ধরে এই দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে পালন করা হচ্ছে। সুতরাং এই দিনটি ঘিরে প্রতিবছর একটি ভালো প্রতিবেদন হতে পারে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্ফানসহ আরো অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় দিবস রয়েছে, সেগুলো নিয়ে প্রতিবেদন হতে পারে।
উপকূলের দিকে চোখ ফেরালে সম্ভাবনা ও সুযোগের চেয়ে সংকটের দিকেই আমাদের চোখ পড়ে বেশি। কিন্তু গোটা উপকূল অঞ্চল সম্ভাবনার বিরাট ক্ষেত্র। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপদের ফলে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলো বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানবসৃষ্ট অনেক কারণ রয়েছে সম্ভাবনাগুলো ধ্বংস হওয়ার। সম্ভাবনা বিকাশের চেয়ে সম্ভাবনা ধ্বংস হয়, এমন প্রকল্পের সংখ্যা অনেক বেশি চোখে পড়ে। এসব বিষয় নিয়ে অনেক স্টোরি তৈরির সুযোগ আছে।
চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তুতি
প্রান্তিক সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের। এখানে প্রস্তুতি যেমন দরকার, তেমনি বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশলও নিতে হবে। প্রান্তজনের কণ্ঠস্বর তুলে আনতে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিক উভয় পর্যায়েই সংকট ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেজন্য দুই ক্ষেত্রেই প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক ধরনের সমস্যা রয়েছে। কিন্তু সবার আগে মনোযোগ দিতে হবে গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বা নিউজ ম্যানেজমেন্টের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে না পারলে প্রান্তজনের কণ্ঠস্বর কেন্দ্রে আনা সম্ভব নয়। দৃষ্টিভঙ্গির পরে বাজেট-বরাদ্দ, জনবল, পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়গুলো আসে। গণতন্ত্র চর্চা, বৈষম্য নিরসন, সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, মানুষের অধিকারগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন ইত্যাদির ক্ষেত্রে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রান্তিকে নজর বাড়াতে হবে। এজন্য দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। একা সংবাদকর্মীর ওপর সব দায়দায়িত্ব ফেলে রাখলেও চলবে না।
প্রান্তিক সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি মোকাবিলায় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারণ ও রিপোর্টিং পরিকল্পনায় উপকূলের ইস্যুগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। গণমাধ্যমগুলো প্রান্তিক ইস্যু নিয়ে পৃথক বিট যেমন তৈরি করতে পারে, তেমনি বিভাগ চালু করতে পারে। পাশাপাশি প্রান্তিক ইস্যুতে কাজ করার জন্য সংবাদকর্মীদের পেশার মান উন্নয়নে নজর দিতে হবে।
গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সাংবাদিক পর্যায়ের প্রস্তুতিতেও আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রান্তিকের অনেক ইস্যুতে সাংবাদিকদের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু এটাকে কার্যকর পর্যায়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে। মানসম্পন্ন প্রতিবেদন করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কেউ যদি মন স্থির করে থাকেন, আমি এই কাজটি করবো, তাহলে প্রথমেই তাকে মানসিকভাবে প্রস্তত হতে হবে। তাকে দেখতে হবে প্রান্তিকের মানুষের কাছে কাজে যাওয়ার জন্য তার সব উপকরণ আছে কিনা, দীর্ঘ সময় প্রান্তিকে অবস্থান করা, দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটা, দুর্যোগের মুখে পড়লে তা মোকাবিলা করা, ইত্যাদি বিষয়ে প্রস্তুতি আছে কিনা। এক কথায়, একজন সাংবাদিককে প্রথমেই সামগ্রিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। উপকূল অঞ্চলে সাংবাদিকতা করার জন্য সাধারণ প্রস্তুতি নিয়ে আরো বেশি ভাবতে হবে। প্রান্তিকে কাজ করতে গেলে আপনাকে নদীপথ পেরোতে হবে। দুর্যোগের সময় নদীপথ অতিক্রম করতে হতে পারে। কাজ করতে হলে নিজের নিরাপত্তার জন্য একজন সাংবাদিকের সাঁতার জানা খুব জরুরি। প্রাকৃতিক বিপদের কথা বিবেচনায় রেখে লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখা যেতে পারে। প্রান্তিক সাংবাদিকতার জন্য সাংবাদিকের ভূগোল জ্ঞান থাকাটা গুরুত্বপূর্র্ণ।
গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিক পর্যায়ের দুই প্রস্তুতি প্রান্তিকের প্রান্তজনকে কেন্দ্রের সাথে সংযোগ করতে পারে। আসুন, প্রান্তজনের কণ্ঠস্বর শুনি- সমতা, ন্যায্যতা, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণমাধ্যমকে প্রস্তুত করি।
লেখক: আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত অনুসন্ধানী উপকূল ও জলবায়ু সাংবাদিক
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উপক ল প র ক ত ক ব পদ র উপক ল র ম ন ষ র প র ন তজন র ক ব ভ ন ন ধরন র ল দ শ র উপক ল ম ন ষ র জ বন ল র ঘ র ণ ঝড় র জ বন জ ব ক উপক ল র দ ক প র ব উপক ল বড় ক ষ ত র ন র ব হ কর ঘ র ণ ঝড় র অন ক স ট র জনগ ষ ঠ র স ন দরবন খবর র জন প রস ত ত ব দ কত র র জন য স দ র জ বন দ ব প চর ত র জন য র জন ত ক য উপক ল প রসঙ গ ই উপক ল উপক ল স এক সময় জ বন র অন ক ব ন র ভর পর ব শ ক জ কর অন ক প পর য য় আম দ র সমস য প রথম অপর ধ সরক র জলব য় ক সময় র একট
এছাড়াও পড়ুন:
কাপাসিয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীদের হামলায় ১২ সাংবাদিক আহত
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীদের হামলায় অন্তত ১২ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন।
শনিবার (১৭ মে) দুপুর ২টার দিকে উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের চেরাগ আলী মোড় এলাকায় এক মতবিনিময় সভায় এ হামলা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কাপাসিয়া উপজেলা বিএনপির একাংশের উদ্যোগে শনিবার একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি খলিলুর রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন গাজীপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাখাওয়াত হোসেন সেলিম।
দুপুর দেড়টার দিকে সভা শেষ হওয়ার পরপরই মোটরসাইকেলে করে ২০-২৫ জন ব্যক্তি শাহ রিয়াজুল হান্নানের নামে স্লোগান দিতে দিতে সমাবেশস্থলে এসে অতর্কিত হামলা চালান। তারা সভার চেয়ার, টেবিল, মাইক, সাউন্ডবক্স ও প্যান্ডেল ভাঙচুর করেন। একপর্যায়ে পাশের একটি কক্ষে অবস্থানরত সাংবাদিকদের ওপরও হামলা চালানো হয়।
হামলায় গুরুতর আহত হন যমুনা টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান রকি হোসেন (২৬)। ভিডিও ধারণ করতে গেলে তাকে সড়কে ফেলে বেধড়ক মারধর করা হয়। হামলাকারীরা তার ক্যামেরা, আইডি কার্ড, মাইক্রোফোন ও ল্যাপটপ ছিনিয়ে নেয়।
রকি হোসেনকে গুরুতর আহত অবস্থায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাখাওয়াত হোসেন সেলিম বলেছেন, “আমরা শান্তিপূর্ণভাবে একটি মতবিনিময় সভা করছিলাম। সভা শেষে হঠাৎ করে একটি দল এসে ভাঙচুর ও হামলা চালায়। তারা সাংবাদিকদের ওপরও হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করে। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।”
হামলার পর কাপাসিয়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে, এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত হামলার ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি।
ঢাকা/রফিক সরকার/রফিক