‘যে কোনো পরিস্থিতিতে সঠিক কাজটা করো। যেটি সবার জন্য ভালো।’ বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সূত্র মতে, এটিই কোচ পিটার বাটলারের সিগনেচার ট্যাগ লাইন!
দলীয় সভা বা ঋতুপর্ণা চাকমা, আফেইদাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় কথাটি বারবার স্মরণ করিয়ে দেন ইংলিশ এই কোচ। তাঁর সিগনেচার টাইপ বাক্যে ‘সবাই’ কারা? আর ‘সবার জন্য ভালো’ বলতেই বা কী বোঝায়? দুটি প্রশ্নের উত্তরই তো আমার-আপনার জানার কথা!
পিটার বাটলারের কাছে ‘সবার’ হলো বাংলাদেশ দল আর ‘সবার জন্য ভালো’ মানে বাংলাদেশ দলের জন্য ভালো। হয়তো এই দুটি বিষয়ের সঙ্গে আপস করেন নাই বলেই বাটলার আর বাটলারের বাংলাদেশ নিয়ে লিখতে বাধ্য হওয়া।
টানা দুটি সাফ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। চ্যাম্পিয়ন নারী ফুটবলারদের জয়গান সবার মুখে মুখে। কিন্তু সারা জীবন কি ফুটবল মানচিত্রে তলানিতে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের গর্ব নিয়েই বুক ফুলিয়ে হাঁটবে বাংলাদেশ? সেই গণ্ডি পার হওয়ার তরিকাটাই বা কী? তাই নিজের চাকরির মায়া না করে সাফের বাইরে শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে খেলতে চাইলেন বেশি করে ম্যাচ। দ্রুতই ধরা দিল ফলাফল।
বুধবার সন্ধ্যায় দক্ষিণের সেই মানচিত্র থেকে বের হয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়ার বুকে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে দিল বাটলারের বাংলাদেশ।
কত অবলীলায় বলে ফেললাম বাটলারের বাংলাদেশ! হ্যাঁ, এই মেয়েরা আগেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এশিয়ান মঞ্চে গিয়ে এমন দাপুটে বাংলাদেশকে কি আগে কখনও দেখা গিয়েছে? অবশ্যই না।
আগে দুবার বাছাইপর্বে অংশ নিয়েও ন্যূনতম ড্র ছিল না। এবার ৩৬ ধাপ এগিয়ে থাকা বাহরাইনকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাদেশের শুরু। দ্বিতীয় ম্যাচে ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা স্বাগতিক মিয়ানমারকে হারিয়ে এশিয়ান কাপ খেলার ছাড়পত্র আদায় করে নেওয়া। রক্ষণভাগ, মিডফিল্ড, আক্রমণভাগ– প্রতিটি ডিপার্টমেন্টই এখন পরবর্তী স্টেজের জন্য তৈরি। এই সাহসী ও দুর্দান্ত বাংলাদেশকে আলাদা করে বাটলারের বাংলাদেশ না বলে উপায় আছে!
বাফুফের এলিট একাডেমির দায়িত্ব নিয়ে গত বছরের শুরুতে বাংলাদেশে আসেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা এই কোচ। একই বছর চায়নিজ তাইপের বিপক্ষে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচকে সামনে রেখে মে মাসে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় নারী দলের দায়িত্ব। অতীতে আফ্রিকার লাইবেরিয়া ও বতসোয়ানার দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা থাকায় জাতীয় দলকে হ্যান্ডল করার পাঠটা তাঁর ভালোই জানা। বাংলাদেশ দলেও নিজের প্রসেসের ওপর আস্থা রাখলেন ইংলিশ মাস্টারক্লাস।
শুরুতেই বুঝিয়ে দেন দলে কারও জায়গা নিশ্চিত নয় আর পুরো ৯০ মিনিট সমান তালে খেলতে না পারলে তাঁর তো জায়গায় নেই। তাঁর বিপক্ষে বিদ্রোহ করা খেলোয়াড়দের সঙ্গে আপস করলেন না। আবার ঠেলে দিলেন না দূরেও। ব্রিটিশ মানেই নাক উঁচু বলে যে একটা আপ্ত বাক্য আছে, তার ছিঁটেফোঁটাও বাটলারের মধ্যে নেই বলে বিদ্রোহীদের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় খেলোয়াড়দের দলে টেনে নিলেন। পরে শৃঙ্খলা ও পারফরম্যান্সের মানদণ্ডের ওপর ভর করেই গড়ে তুললেন এশিয়ান মঞ্চের দল।
বাটলার নিজে ব্রিটিশ হলেও তাঁর দলের খেলায় প্রথাগত ‘ডিরেক্ট স্টাইলে’ ব্রিটিশ ফুটবলের ছাপ নেই। ‘হাই প্রেসিং’ করে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখে, বল দখলে এলে বিল্ডআপ, কখনও ‘ওয়ান টু ওয়ান’, আবার কখনও ‘উইং প্লে’ করে ঝড়ের গতিতে আক্রমণে ওঠেন ঋতুপর্ণা, শামসুন্নাহার জুনিয়ররা। বাটলারযুগের আগে থেকেই বাংলাদেশের ফুটবলাররা টেকনিক্যালি ভালো।
এখন যোগ হয়েছে ট্যাকটিক্যাল আর ফিজিক্যালি সক্ষমতা। ফুটবলে ‘থ্রি এস’ বলে একটা মৌলিক বিষয় আছে—স্পিড (গতি), স্ট্রেংথ (শক্তি) ও স্ট্যামিনা (দম)। তারুণ্যনির্ভর বাটলারের দলের খেলোয়াড়দের ‘থ্রি এস’ তুঙ্গে। তবে উন্নতির জায়গাও আছে অনেক। প্রত্যাশামাফিক উন্নতি করতে পারলে এশিয়ান মঞ্চ ছাপিয়ে ধরা দিতে পারে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নও।
লেখক: রাশেদুল ইসলাম, সাবেক ফুটবলার, জাতীয় দল
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন র ফ টবল র জন য ভ ল ফ টবল র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত
বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ।
সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।
আরো পড়ুন:
একা বাস করতে পারে যে পাখি
কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?
সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।
তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না।
এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস।
তিনি জানেন, প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে। বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।
সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন।
একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।
সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।
চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।
গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা/লিপি