যখন ছোট ছিলাম, বর্ষাকালে বৃষ্টির জন্য আমার মনে একটা অপেক্ষা কাজ করত। আমাদের বাড়ি ছিল চুয়াডাঙ্গা শহরে। বাড়ির সামনে উঠান ছিল, অনতিদূরে জলাশয়। আমার বন্ধুবান্ধবও নেহাত কম ছিল না। তারাও বৃষ্টিপাগল। একবার ভিজতে শুরু করলে সময়ের হিসাব থাকত না। দূর থেকে মা একসময় ডাকতে থাকতেন, এখনই চলে আয়, আয় বলছি! বাড়িতে গিয়েও বকুনি খেতাম। এখন ভাবি, আমাদের লালনপালনে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকা মায়ের সেই বকুনিতে কত মমতা জড়িয়ে থাকত। তাদের উদ্বেগ, বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ হবে।
অসুখ হওয়ার আশঙ্কা মিথ্যা নয়। তবে বৃষ্টিতে ভেজাসহ প্রাকৃতিক অনুষঙ্গগুলো যাপনের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে যে আত্মীয়তা হয়, তা না হলে কারও পক্ষে শিল্পী হওয়া যে কঠিন! এখনও যখন চারুকলায় বৃষ্টি নামে, দেখি ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস ফেলে নেমে যাচ্ছে উঠানে। আমরা নিষেধ করি না। সেখানে ঘাসের মাদুরে পা রেখে তারা ভিজতে ভিজতে হেঁটে বেড়ায়, দৌড়োয়, নাচে। কত কথা, কত গানের ভেতর দিয়েই-না তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায়। কেউ কেউ চলে যায় চারুকলার ছাদে। কখনও আমরাও থাকি। সেখানেও একই কাণ্ড। ওদের উৎসব বাঁধ মানে না। ছেলে-মেয়ে, ছোট-বড়– মিলনমেলা ডেকে আনে বৃষ্টি। বিদেশি ছাত্রছাত্রীও ভেজে। ওদের ঠান্ডা লেগে যায়। আসলে জলবায়ুর সঙ্গে দৈহিক অভ্যস্ততার তো একটা যোগ আছে।
একসঙ্গে যখন ভিজে সবাই, ওদের দেখে আমি দূর শৈশবের সেইসব সেই নিষ্পাপ-নির্ভার দিনে ফিরে যাই। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বন্ধুরা কত রকম দেশীয় খেলাই-না খেলেছি। কাছেই যে জলাশয় ছিল, সেখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে মাছেরা ওপরে উঠে আসত। দুরন্তও ছিলাম। এই মাছ ধরছি তো ওই গাছে উঠছি। ভেজা গাছের ভেজা ডাল। গাছ থেকে লাফিয়ে পড়তাম জলে। সহজ আনন্দ। বিপদ হতে পারত না তা নয়। মা-বাবার ভয় তো এখানেই। হয়নি তেমন কিছু। হলেও-বা কী। একটা অবাধ স্বাধীনতা উদযাপনের উপলক্ষ নিয়ে আসত বৃষ্টি। আনন্দ হতো খুব। এমন আনন্দের জন্য একটা অপেক্ষা তো থাকবেই!
তরুণ বয়সের একটি বৃষ্টিদিনের কথা মনে পড়ে। চুয়াডাঙ্গা থেকে দৌলতদিয়ায় এসেছিলাম, ফেরি ধরব। ফেরিতে ওঠার পর প্রবল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির ভেতর আমরা নদী পার হতে থাকি। কুয়াশায় যেমন চারদিক ঢেকে যায়, সেদিন বৃষ্টিতে তেমন চারপাশ ঝাপসা হয়ে উঠেছিল। অনেক স্মৃতিই মনে নেই স্পষ্ট। তবে অনুভবগুলো থেকে যায়। আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। ঘটনা মিশে গেছে, অনুভব জেগে আছে।
শৈশবে যে বৃষ্টি আনন্দের ও অপেক্ষার, তারুণ্যে সেই বৃষ্টি হৃদয়ে হাহাকারও কি জাগায় না? জাগায়। তবে তেমন হাহাকার জাগতে দেওয়ার সুযোগ খুব একটা দিয়েছি কি আমি? দিইনি বোধহয়। দেশে থাকতেও পড়াশোনা, আঁকা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। জাপানে যখন ছিলাম, বিদেশ হওয়ায় সেখানে একটা বাড়তি সংগ্রাম ছিল, তাই সেখানেও কোনো হাহাকারকে প্রশ্রয় দেওয়ার সময়-সুযোগ গ্রহণ করিনি। ব্যস্ত থেকেছি কাজে। অন্যরকম একটা মানবিক টানাপোড়েন ছিল। দেশে যখন দেখি, প্রেমিক-প্রেমিকা রিকশায় চড়ে বৃষ্টিতে ভিজছে, খুব ভালো লাগে। এমনটা করা হয়ে ওঠেনি আমার। আমাদের দেশের তরুণ-তরুণী কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে ভালোবাসা যাপন করতে জানে। এমনটা আমি দেশের বাইরে খুব কম দেখেছি।
আমার শিক্ষাজীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আমি কাটিয়েছি জাপানে। সেখানে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক হলে থাকতাম। আমার ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যেত। সাগরিক বৃষ্টি দেখেছি। জাপান ও বাংলাদেশের প্রকৃতিতে অনেক মিল যেমন আছে, অমিলও আছে। বৃষ্টি তো কম বা বেশি পৃথিবীর সব দেশেই হয়, অমিলটা তৈরি হয় বৃষ্টির ধরনে। আমাদের দেশে মুষলধারে বৃষ্টি হয়। কিন্তু জাপানে এমন মুষলধারে বৃষ্টি আমি দেখিনি। আমাদের দেশে যখন সাগরে ঘূর্ণিঝড় ঘনায়, তখন সারাদেশে যেমন একটানা ইলশেগুঁড়ি লেগেই থাকে, জাপানের বৃষ্টি অনেকটা তেমন। বাংলাদেশে বৃষ্টির পর আবার রোদ ওঠে। কিন্তু ওই দেশে এমন ব্যাপার নেই। ঝরছে তো ঝরছেই, ঝরা থামলেও রোদ হাসবে, তেমন প্রকৃতি নয়। এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সঙ্গেই, ঋতুভেদে, জাপানের তুষারপাত সম্পর্কিত। দেশটা ঠান্ডা বলেই তো সেই ঝিরিপতন তুন্দ্রাকণায় রূপ নিয়ে নেয়। বৃষ্টির একটি সুন্দর নাম আছে জাপানে। আমেফুরু! আমাদের দেশে শীতকাল শুরুর আগে একবার বৃষ্টি হয়, সেই বৃষ্টি শীত নামায়, এরপর গোটা শীতকাল থাকে শুষ্ক, বৃষ্টি আর হয় না। কিন্তু জাপানে? শীতকালেও বৃষ্টি হয় আর ওটাই বোধহয় সে দেশের মানুষকে, বৃষ্টিকে খুব একটা ভালোবাসতে দেয়নি। জাপানে ওই কাঁপানো শীতে যখন বৃষ্টি ঝরতে শুরু করে, ওরা বিরক্তই হয়। স্বাভাবিক। আমাদের দেশ নিরক্ষীয় হলেও গ্রীষ্মপ্রধান। এখানে বৃষ্টির আদর কিছুটা ভিন্ন তো হবেই। সে তো এখানে স্বস্তি নিয়ে আসে। বৃষ্টি নিয়ে ভাবালুতা আমাদের দেশেই তুলনামূলক বেশি। অন্যথা হলে আমাদের আবেগের কাঁটাও হয়তো আরেকদিকে হেলে পড়ত। যা হোক, আমি মুষলধারে বৃষ্টির দেশের ছেলে। জাপানও আমার কাছে দ্বিতীয় স্বদেশতুল্য। দুই দেশের বৃষ্টির আলাদা দুটি ধরন। দুটিই আমার ভালো লেগেছে। আমার ছবির জগতে প্রকৃতি, পরিবেশ অনুষঙ্গ হয়ে এলেও বৃষ্টি কি সেভাবে এসেছে? হয়তো আরও মনোযোগ পেতে পারত। বৃষ্টিপ্রধান ছবি তেমন আঁকা হয়ে উঠল না। হয়তো হবে ভবিষ্যতে। কারণ, বৃষ্টি আমার চিত্রকর সত্তাকে স্পর্শ করেছে তো বটেই। হয়তো কখনও ভেতরে পর্যাপ্ত বিভব জমবে এবং আঁকা হবে বৃষ্টির ছবি। v
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গল প আম দ র দ শ প রক ত আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
অভয়াশ্রমেই নিধনযজ্ঞ মাছের প্রজননে ঝুঁকি
দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য উল্লাপাড়ার ঘাটিনা রেল সেতুর পাশে করতোয়া নদীতে গড়ে তোলা হয়েছে অভয়াশ্রম। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা অমান্য করে অভয়াশ্রম থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মা ও পোনা মাছ ধরা হচ্ছে। এতে মাছের বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ঘাটিনা রেল সেতু ও সড়ক সেতুর মাঝে করতোয়া নদীর প্রায় দেড় কিলোমিটার অংশে প্রতিবছর মাছের অভয়াশ্রম তৈরি করে মৎস্য বিভাগ। এই অভয়াশ্রমেই বড়শি ও চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে অবৈধভাবে মাছ শিকার করা হচ্ছে। শিকারিরা রাতে কৌশলে নদীতে বাঁশের খুঁটি পুঁতে জাল ফেলে রাখে। ভোরে সবার অলক্ষ্যে নৌকা নিয়ে খুঁটি থেকে জাল খুলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বের করে আবারও একইভাবে জাল পেতে রাখে। খুঁটিগুলো এমনভাবে পোতা হয় যাতে মাথা এবং পানির উপরিভাগের স্তর সমান হয়। এতে দূর থেকে জাল ফেলার বিষয়টি কেউ সহজে বুঝতে পারে না।
অবৈধ এ কাজে বড় লক্ষ্মীপুর গ্রামের আব্দুল হালিম, খোদাবক্স প্রামাণিক, লক্ষ্মীপুর গ্রামের জাকারিয়া হোসেনসহ বেশ কয়েজন জড়িত বলে জানা গেছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে আব্দুল হালিম ও খোদাবক্স প্রামাণিকের ভাষ্য, এক সময় তারা অভয়াশ্রমে অবৈধভাবে মাছ শিকার করতেন। মৎস্য দপ্তরের এক অভিযানে ধরা পড়ার পর তাদের জাল বড়শি কেড়ে নেওয়া হয়। মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। এর পর আর সেখানে যাননা।
এ বিষয়ে কথা বলতে লক্ষ্মীপুর গ্রামের জাকারিয়া হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ পেয়ে মাঝেমধ্যে অবৈধ মাছ শিকার বন্ধে মৎস্য বিভাগ অভিযান চালালেও তেমন কাজে আসছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, লোকবলের অভাবে অভয়াশ্রমে সার্বক্ষণিক নজরদারি সম্ভব নয়। এ সুযোগে বছরে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার মাছ অবৈধভাবে শিকার করছে দুর্বৃত্তরা। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে খোদ উপজেলা মৎস্য অফিস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন জানান, বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ শিকারিদের আনাগোনা বেড়ে যায়। তারা অভয়াশ্রমে কখনও বড়শি আবার কখনও চায়না দুয়ারি জাল ফেলে রুই, কাতল, চিতল, ফলি, কালিবাউশ, বোয়াল, মিরকাসহ দেশি বড় আকারের মা মাছ ও ছোট মাছ শিকার করে। এতে অভয়াশ্রমে মাছের প্রজনন হুমকির মুখে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অভয়াশ্রম তৈরির উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আতাউর রহমান জানান, প্রতিবছর লক্ষাধিক টাকা খরচ করে অভয়াশ্রম তৈরি করা হয়। যাতে দেশি রুই, কাতল, বোয়াল, চিতলসহ বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছ নিরাপদে আশ্রয় নিয়ে ডিম ছাড়তে পারে। কিন্তু অসাধু ও লোভী মৎস্য শিকারিরা বড়শি বা চায়না দুয়ারি জাল ফেলে মা মাছগুলো নিধন করছে। এতে দেশের মৎস্য প্রজনন হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি আরও জানান, তাঁর দপ্তরে লোকবল খুব কম। তারপরও প্রতিবছর করতোয়া নদীতে অন্তত ১৫ বার অভিযান চালানো হয়। অভয়াশ্রমে সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য লোক নিয়োগ না করলে মাছ নিধন বন্ধ করা কঠিন।