Samakal:
2025-11-03@19:08:30 GMT

বৃষ্টিযাপন

Published: 3rd, July 2025 GMT

বৃষ্টিযাপন

যখন ছোট ছিলাম, বর্ষাকালে বৃষ্টির জন্য আমার মনে একটা অপেক্ষা কাজ করত। আমাদের বাড়ি ছিল চুয়াডাঙ্গা শহরে। বাড়ির সামনে উঠান ছিল, অনতিদূরে জলাশয়। আমার বন্ধুবান্ধবও নেহাত কম ছিল না। তারাও বৃষ্টিপাগল। একবার ভিজতে শুরু করলে সময়ের হিসাব থাকত না। দূর থেকে মা একসময় ডাকতে থাকতেন, এখনই চলে আয়, আয় বলছি! বাড়িতে গিয়েও বকুনি খেতাম। এখন ভাবি, আমাদের লালনপালনে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকা মায়ের সেই বকুনিতে কত মমতা জড়িয়ে থাকত। তাদের উদ্বেগ, বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ হবে। 
অসুখ হওয়ার আশঙ্কা মিথ্যা নয়। তবে বৃষ্টিতে ভেজাসহ প্রাকৃতিক অনুষঙ্গগুলো যাপনের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে যে আত্মীয়তা হয়, তা না হলে কারও পক্ষে শিল্পী হওয়া যে কঠিন! এখনও যখন চারুকলায় বৃষ্টি নামে, দেখি ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস ফেলে নেমে যাচ্ছে উঠানে। আমরা নিষেধ করি না। সেখানে ঘাসের মাদুরে পা রেখে তারা ভিজতে ভিজতে হেঁটে বেড়ায়, দৌড়োয়, নাচে। কত কথা, কত গানের ভেতর দিয়েই-না তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায়। কেউ কেউ চলে যায় চারুকলার ছাদে। কখনও আমরাও থাকি। সেখানেও একই কাণ্ড। ওদের উৎসব বাঁধ মানে না। ছেলে-মেয়ে, ছোট-বড়– মিলনমেলা ডেকে আনে বৃষ্টি। বিদেশি ছাত্রছাত্রীও ভেজে। ওদের ঠান্ডা লেগে যায়। আসলে জলবায়ুর সঙ্গে দৈহিক অভ্যস্ততার তো একটা যোগ আছে। 
একসঙ্গে যখন ভিজে সবাই, ওদের দেখে আমি দূর শৈশবের সেইসব সেই নিষ্পাপ-নির্ভার দিনে ফিরে যাই। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বন্ধুরা কত রকম দেশীয় খেলাই-না খেলেছি। কাছেই যে জলাশয় ছিল, সেখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে মাছেরা ওপরে উঠে আসত। দুরন্তও ছিলাম। এই মাছ ধরছি তো ওই গাছে উঠছি। ভেজা গাছের ভেজা ডাল। গাছ থেকে লাফিয়ে পড়তাম জলে। সহজ আনন্দ। বিপদ হতে পারত না তা নয়। মা-বাবার ভয় তো এখানেই। হয়নি তেমন কিছু। হলেও-বা কী। একটা অবাধ স্বাধীনতা উদযাপনের উপলক্ষ নিয়ে আসত বৃষ্টি। আনন্দ হতো খুব। এমন আনন্দের জন্য একটা অপেক্ষা তো থাকবেই! 
তরুণ বয়সের একটি বৃষ্টিদিনের কথা মনে পড়ে। চুয়াডাঙ্গা থেকে দৌলতদিয়ায় এসেছিলাম, ফেরি ধরব। ফেরিতে ওঠার পর প্রবল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির ভেতর আমরা নদী পার হতে থাকি। কুয়াশায় যেমন চারদিক ঢেকে যায়, সেদিন বৃষ্টিতে তেমন চারপাশ ঝাপসা হয়ে উঠেছিল। অনেক স্মৃতিই মনে নেই স্পষ্ট। তবে অনুভবগুলো থেকে যায়। আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। ঘটনা মিশে গেছে, অনুভব জেগে আছে। 
শৈশবে যে বৃষ্টি আনন্দের ও অপেক্ষার, তারুণ্যে সেই বৃষ্টি হৃদয়ে হাহাকারও কি জাগায় না? জাগায়। তবে তেমন হাহাকার জাগতে দেওয়ার সুযোগ খুব একটা দিয়েছি কি আমি? দিইনি বোধহয়। দেশে থাকতেও পড়াশোনা, আঁকা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। জাপানে যখন ছিলাম, বিদেশ হওয়ায় সেখানে একটা বাড়তি সংগ্রাম ছিল, তাই সেখানেও কোনো হাহাকারকে প্রশ্রয় দেওয়ার সময়-সুযোগ গ্রহণ করিনি। ব্যস্ত থেকেছি কাজে। অন্যরকম একটা মানবিক টানাপোড়েন ছিল। দেশে যখন দেখি, প্রেমিক-প্রেমিকা রিকশায় চড়ে বৃষ্টিতে ভিজছে, খুব ভালো লাগে। এমনটা করা হয়ে ওঠেনি আমার। আমাদের দেশের তরুণ-তরুণী কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে ভালোবাসা যাপন করতে জানে। এমনটা আমি দেশের বাইরে খুব কম দেখেছি।

আমার শিক্ষাজীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আমি কাটিয়েছি জাপানে। সেখানে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক হলে থাকতাম। আমার ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যেত। সাগরিক বৃষ্টি দেখেছি। জাপান ও বাংলাদেশের প্রকৃতিতে অনেক মিল যেমন আছে, অমিলও আছে। বৃষ্টি তো কম বা বেশি পৃথিবীর সব দেশেই হয়, অমিলটা তৈরি হয় বৃষ্টির ধরনে। আমাদের দেশে মুষলধারে বৃষ্টি হয়। কিন্তু জাপানে এমন মুষলধারে বৃষ্টি আমি দেখিনি। আমাদের দেশে যখন সাগরে ঘূর্ণিঝড় ঘনায়, তখন সারাদেশে যেমন একটানা ইলশেগুঁড়ি লেগেই থাকে, জাপানের বৃষ্টি অনেকটা তেমন। বাংলাদেশে বৃষ্টির পর আবার রোদ ওঠে। কিন্তু ওই দেশে এমন ব্যাপার নেই। ঝরছে তো ঝরছেই, ঝরা থামলেও রোদ হাসবে, তেমন প্রকৃতি নয়। এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সঙ্গেই, ঋতুভেদে, জাপানের তুষারপাত সম্পর্কিত। দেশটা ঠান্ডা বলেই তো সেই ঝিরিপতন তুন্দ্রাকণায় রূপ নিয়ে নেয়। বৃষ্টির একটি সুন্দর নাম আছে জাপানে। আমেফুরু! আমাদের দেশে শীতকাল শুরুর আগে একবার বৃষ্টি হয়, সেই বৃষ্টি শীত নামায়, এরপর গোটা শীতকাল থাকে শুষ্ক, বৃষ্টি আর হয় না। কিন্তু জাপানে? শীতকালেও বৃষ্টি হয় আর ওটাই বোধহয় সে দেশের মানুষকে, বৃষ্টিকে খুব একটা ভালোবাসতে দেয়নি। জাপানে ওই কাঁপানো শীতে যখন বৃষ্টি ঝরতে শুরু করে, ওরা বিরক্তই হয়। স্বাভাবিক। আমাদের দেশ নিরক্ষীয় হলেও গ্রীষ্মপ্রধান। এখানে বৃষ্টির আদর কিছুটা ভিন্ন তো হবেই। সে তো এখানে স্বস্তি নিয়ে আসে। বৃষ্টি নিয়ে ভাবালুতা আমাদের দেশেই তুলনামূলক বেশি। অন্যথা হলে আমাদের আবেগের কাঁটাও হয়তো আরেকদিকে হেলে পড়ত। যা হোক, আমি মুষলধারে বৃষ্টির দেশের ছেলে। জাপানও আমার কাছে দ্বিতীয় স্বদেশতুল্য। দুই দেশের বৃষ্টির আলাদা দুটি ধরন। দুটিই আমার ভালো লেগেছে। আমার ছবির জগতে প্রকৃতি, পরিবেশ অনুষঙ্গ হয়ে এলেও বৃষ্টি কি সেভাবে এসেছে? হয়তো আরও মনোযোগ পেতে পারত। বৃষ্টিপ্রধান ছবি তেমন আঁকা হয়ে উঠল না। হয়তো হবে ভবিষ্যতে। কারণ, বৃষ্টি আমার চিত্রকর সত্তাকে স্পর্শ করেছে তো বটেই। হয়তো কখনও ভেতরে পর্যাপ্ত বিভব জমবে এবং আঁকা হবে বৃষ্টির ছবি। v 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গল প আম দ র দ শ প রক ত আনন দ

এছাড়াও পড়ুন:

প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত

বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ। 

সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।

আরো পড়ুন:

একা বাস করতে পারে যে পাখি

কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?

সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।

তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না। 

এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস। 

তিনি জানেন,  প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে।  বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।

সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন। 

একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।

সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।

চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।

গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কারা বেশি কাঁদেন? 
  • বর্তমান সংকটের জন্য সরকার দায়ী, দলগুলোর চাপে সিদ্ধান্ত বদল
  • প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত