হাওর অঞ্চলে মহররম-সংস্কৃতির নিজস্ব রূপান্তর
Published: 6th, July 2025 GMT
কিশোরগঞ্জের সর্বপূর্বের উপজেলা অষ্টগ্রাম। পুব দিকের একই কাতারে (উত্তর-দক্ষিণ) আছে আরও দুই উপজেলা—ইটনা ও মিঠামইন। সবই হাওর-অধ্যুষিত। একসময় অষ্টগ্রামে যে পনিরের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল, তার মূল কারণ মহিষের আধিক্য। বিস্তীর্ণ চারণভূমিতে তখন পালকে পাল, অগণন মহিষ চরে বেড়াত। অধুনা নগরবাসী অষ্টগ্রামের যে পনির দ্বারা রসনা তৃপ্ত করেন, সম্প্রতি তাতে গরুর দুগ্ধজাত পনিরও যুক্ত হয়েছে।
এই জনপদে মহররমের শোকানুষ্ঠান এক ভিন্নমাত্রা লাভ করেছিল। এই বৈশ্বিক সংস্কৃতিটি বাংলাদেশে একটি জাতীয় অবয়ব পেয়েছে। তার মধ্যে অষ্টগ্রামে ঘটেছে এর বিশিষ্ট এক স্থানীয়করণ। সবই প্রাবল্য, বাহুল্য ও আতিশয্য। মহররমের ট্রেনযাত্রায় ছিলাম একা, অন্য সময় কেউ না কেউ সহযাত্রী হন। বই-খাতার ভারে নুইয়ে পড়া বোঁচকা আর ডিএসএলআরের ওজন কুলিয়ারচর ঘাটে গিয়ে বোঝা হয়ে গেল। আজ অষ্টগ্রাম থেকে কোনো স্পিডবোট আসবে না, যেগুলো গেছে সেগুলো যাত্রী না পেয়ে ঘুমাচ্ছে আটগাঁওয়েই। হেতু জিজ্ঞাসা না করেই জানতে পারি কাল আশুরা, অষ্টগ্রাম থেকে কারও কোনো নড়নচড়ন নেই।
অষ্টগ্রামের আশুরা.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মৌলভীবাজারে আশুরার দিনে গায়েবি মোকামে মাতম-বিলাপের জারি
কবে থেকে পবিত্র আশুরার দিনে মৌলভীবাজারে গায়েবি মোকাম ঘিরে মাতম-বিলাপ করা, জারি গাওয়া শুরু হয়েছিল, তার নির্দিষ্ট কোনো সাল-তারিখ কারও জানা নেই। পূর্বপুরুষেরা ওই দিনে গায়েবি মোকাম প্রাঙ্গণে এ রকম জারি করেছেন, মাতম করেছেন। ঐতিহ্য হিসেবে সেই ধারাবাহিকতা এখনো সীমিত পরিসরে হলেও টিকিয়ে রেখেছেন তাঁদের উত্তরাধিকার, স্থানীয় মানুষ। মহররমের ১০ তারিখ আশুরার দিন, যা অনেকের কাছে কতলের দিন নামে পরিচিত। সেই দিনে একদল তরুণ-প্রবীণ জারি গেয়ে দিনটিকে স্মরণ করেন, করুণ কাহিনি নিয়ে বিলাপ করেন।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের গয়ঘরে খোজার মসজিদ এলাকায় রয়েছে এই গায়েবি মোকাম। আশুরার দিন বিকেলে আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেক নারী-পুরুষ এখানে সমবেত হন। তরুণ-প্রবীণ মিলে জারি গাইতে গাইতে বিলাপ করেন, শোক প্রকাশ করেন। ১০ মহররম সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেন (রা.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে শহীদ হয়েছিলেন।
গতকাল রোববার বিকেলে ঝমঝমে বৃষ্টি নামে। আগে থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল, এই মেঘ, এই রোদের কিছুটা খেলা ছিল। ওই সময় গয়ঘর খোজার মসজিদের কাছাকাছি গায়েবি মোকামের কাছে জারি গাওয়ার জন্য অনেকে সমবেত হতে শুরু করেছেন। অনেকে জারি শুনতে, অংশ নিতে নানা জায়গা থেকে আসছেন। এখানে আশুরার দিনে জারি গাওয়ার প্রচলন আছে শত বছরের। আগের সেই জমজমাট অবস্থা এখন আর নেই। তারপরও প্রচলিত ধারায় ছেদ পড়েনি। স্থানীয় অপেশাদার জারিশিল্পীরা তা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। বৃষ্টি থামতেই অনেকে ছুটে আসেন। ভিড় করেন গায়েবি মোকামের কাছে। সবাই মিলে গায়েবি মোকাম ঘিরে কয়েক চক্কর দিয়ে একটা সময় শুরু হয় জারি গাওয়া। কারবালার প্রান্তরের শহীদদের জন্য বুকের কান্না তাঁরা ঢেলে দেন জারির কথা ও সুরে। কারবালার কাহিনির নানা অংশ গাইতে গাইতে মাতম করেন। এ উপলক্ষে নানা পণ্যের কিছু দোকানও বসেছিল স্থানটিতে।
গয়ঘর গ্রামটি খোজার মসজিদের নামে অনেকের কাছে পরিচিত, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কারণে অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচশত বছর আগের এই ‘গয়ঘর ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ’। মসজিদটি নির্মাণ করা হয় সুলতান বরবক শাহের পুত্র সুলতান শামস উদ্দীন ইউছুফ শাহের আমলে। হাজী আমীরের পৌত্র ও মুসার পুত্র বিখ্যাত মন্ত্রী মজলিস আলম ৮৮১ হিজরিতে (১৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) এই মসজিদ নির্মাণ করান। এই খোজার মসজিদের পূর্ব দিকেই একটি ছোট মোকাম আছে, যা স্থানীয় মানুষের কাছে গায়েবি মোকাম নামে পরিচিত। গায়েবি টাকায় মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল বলে লোকমুখে গায়েবি মোকাম নামে এই মাজারের পরিচিতি আছে।
স্থানীয় জারিশিল্পী আছকর মিয়া জানান, মহররম মাসে গয়ঘরের গায়েবি মোকামের কাছে পূর্বপুরুষ থেকে জারি গাওয়া হয়ে আসছে। কবে, কখন থেকে এই জারি গাওয়া শুরু হয়েছে, কেউ বলতে পারেন না। তবে এখন আর আগের মতো জারির আয়োজন জমজমাট হয় না। আগে তাঁবু বসানো হতো, আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক লোকজন আসতেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে, স্থানীয় এক ব্যক্তির ঘরে গায়েবি টাকা ওঠে। ওই বাড়ির কেউ একজনকে স্বপ্নে মোকাম তৈরির জন্য বলা হয়। তখন মোকামের স্থানটিতে বিশাল একটি বটগাছ ছিল। সেই গাছ একসময় গোড়াসহ উপড়ে পড়ে। তারপর গায়েবিভাবে পাওয়া টাকা দিয়ে বটগাছের স্থানটিতে এই মোকাম তৈরি করা হয়েছে। কারও নামে এই মোকাম তৈরি হয়নি।
আছকর মিয়া বলেন, ‘জারি কারবালার কাহিনি। বিষাদ সিন্ধু থেকে জানছি। কারবালার ইতিহাস পড়ছি। জারিটা হলো বিলাপ। কারবালার কাহিনি বলতে গিয়ে লোকজন বিলাপ করছে, কাঁদছে। এটারে আমরা একটু জারি হিসেবে গাই। আমরা যত জারি গাই, তার অর্থ আছে। এই কাহিনি “বিষাদ–সিন্ধু”, “জমজমা”, “জঙ্গে কারবালা”তে পাওয়া যাবে।’
আরেক জারিশিল্পী কনর মিয়া বলেন, ‘আমরার জন্মের আগে থেকে ময়-মুরব্বিরা এখানে (গায়েবি মোকাম) জারি গাইছেন। এখন আমরা গাই। আমরা শুনছি এটা কারবালার ইতিহাস, সেই ইতিহাসটারে আমরা স্মরণ করি। ৫ মহররম থেকে শুরু হয়, ১০ মহররম কতলের দিনে (আশুরা) জমজমাট হয়। এরপরে কেউ যদি বলে, গাওয়া হয়। তবে আগে গাওয়া যেত, এখন গাওয়ার মানুষ নাই।’
রোববার বিকেলে যখন তরুণ ও প্রবীণরা মিলে জারি গাইছিলেন, মাতম করছিলেন। তখন পশ্চিমের আকাশে মেঘের কোলে লাল রং ছড়িয়ে দিয়েছিল বিদায়বেলার সূর্য। এ যেন কাজী নজরুল ইসলামের মহররম কবিতার মতো ‘কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে/সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে!’ গায়েবি মোকামের প্রাঙ্গণ তখন একটুকরা ফোরাতের তীরই যেন হয়ে উঠেছিল। সবাই মিলে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার মুহূর্তটিকে মনে করে প্রকৃতই কাতর হয়ে উঠেছিলেন। বুকের কান্নাকে তাঁরা জারির পঙ্ক্তি, তাল ও লয়ে প্রকাশ করতে থাকেন। তখন ধীরে ধীরে বিকেলটা সন্ধ্যার দিকে ঝুঁকছে, অন্ধকারের পর্দা নামছে চরাচরে। জারির আহাজারিতে সেই অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠছে, আরও ইতিহাস–কাতর হয়ে উঠছে।