নন্দনতত্ত্বের সুন্দরের অনুষঙ্গে কাম, কোমল, বীর, করুণ ইত্যাদি রসকে বিভাজনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আবিষ্ট ভাবের বাহক ও উদ্দীপক হিসেবে চিহ্নিত করে এ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের সংকট, সম্ভবনা, স্বার্থপরতা, স্বপরিভ্রমণ, বিকৃত মানসিকতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সবকিছুকেই সুমন সাজ্জাদ তাঁর গোলাকধাঁধার গল্প গ্রন্থে ঠাঁই দিয়েছেন। গত শতাব্দীর ধর্মীয় বিভাজনের রেখা এ গোলকধাঁধায় গল্পের পরিধিকে ব্যাপ্ত করেছে। ফলত পাঠক সত্যি সত্যি পাজলের মীমাংসায় নিমগ্ন হতে বাধ্য হয়, যা এ বইয়ের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দিক। সুমন সাজ্জাদের প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তাই গল্পের শরীরে কবিতার পঙ্ক্তি পাঠককে করে নিবিড়ভাবে জীবন ও সময়ঘনিষ্ঠ। যেমন ‘যার হাতের ভেতর কালো বিন্দুর মতো তিল ছিল, তার হাতের ভেতর নাক ডুবিয়ে তুলে নিলেন সমস্ত পৃথিবীর মিষ্টি গন্ধ।’
‘খড়ের পুতুল’ এ বইয়ের প্রথম গল্প। এতে লেখক পাঠককে অনুরোধ করছেন বইটি না–পড়তে। লেখকের অভিমত, আপনি নিজেই একটি গল্প। তো পাঠক যদি ধাঁধায় জিততে চান, তাহলে গল্পকারের অনুরোধ ফেলে দিয়ে বইটি হাতে নিন। পড়তে থাকুন। একসময় আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন ‘ঝুলন’ গল্পে লিফটে আটকে থাকা গল্পের নায়কের সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবে গল্প বলার রীতিতে গল্পটি লেখক আমাদের বলছেন। অজস্র চরিত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। শুধু জানাচ্ছেন না, প্রধান চরিত্রটির নাম। গোলকধাঁধায় যাতে পাঠক এ চরিত্রে নিজেকে খুঁজে পান। একইভাবে ‘মুকুলের বউ’ ও ‘ভবচক্র’ গল্পে দেশভাগোত্তর উপমহাদেশের মানচিত্রের অবয়বে লেখক মানবচিত্রের ছবি এঁকেছেন। যদিও গল্প দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। আপনি যদি কবি কিংবা কবিতা ভালোবাসেন, ‘ভবচক্র’ গল্পে আটকা পড়ে যাবেন। মাঝে ঘুরে আসবেন গত শতাব্দীর ফেলে আসা গ্রামের মেঠো পথে, হাটবারের দিন মাছ হাতে নিয়ে ঘরে ফেরার সময়ে।
‘টিয়া পাখি’ গল্পে আব্বাস মেম্বারবাড়ি-তালুকদার বাড়ি থেকে দেওয়া কোরবানির মাংসের বাসি তরকারি খেয়ে হজম করতে না পেরে ঢাকার পথে বাসযাত্রায় বমি চেপে বসে থাকে। একসময়ের হৃদয়ের সহযাত্রী মনিকাকে একই বাসে তার বরসহ আবিষ্কার করে। মনিকা যে কিনা ঠোঁটে মেরুন রঙের লিপস্টিক পরে আছে। যেমনটি ‘ঝুলন’ গল্পে নিনার ঠোঁটেও মেরুন রঙের লিপস্টিক। দুটি ভিন্ন গল্পের এই মিল আমাদের হতাশ করে। গল্পের পটভূমি বর্তমান সময়। ফ্যাশন ট্রেন্ডে মেরুন রঙের লিপস্টিক যে খুব একটা ঝড় তুলেছে, তা কিন্তু নয়। গল্পকার নিজের পছন্দকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন, এটা সহজেই অনুমেয়। পুরো বইয়ে এটি একটি দুর্বলতা হয়ে থাকল।
অতিপ্রাকৃত রসের নির্যাস সুমন সাজ্জাদের গল্পে নেই, রয়েছে সংকট ও নিরাসক্ততার শৈল্পিক প্রদর্শনী। পাঠককে বুঝতে না দিয়ে গভীর অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক চেতনায় অভ্রান্ত জীবনবোধের প্রসঙ্গ শুনিয়েছেন প্রায় প্রতিটি গল্পে। ‘খাবনামা’ গল্পে পাশের বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাট, ছাদ—এসব মোটিফ আমাদের নিয়ে যায় ফেলে আসা সময়ের বারান্দায়। কিন্তু আয়েশ করে বসে থাকার উপায় নেই। আতিশ, মিস্ট্রি, বরফ-পাহাড় গল্পগুলোর মতো প্রতিটি গল্পে আরও অনেক উপগল্প জুড়ে দিয়ে লেখক আমাদের স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন, কেন বইয়ের নাম গোলকধাঁধার গল্প। কোথায় যেন ফিরে যাওয়ার অদ্ভুত তাড়না নিয়ে লেখক গল্পগুলো লিখেছেন। পাশাপাশি বেশ কিছু সফল উপন্যাসকে অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এর অনন্য উদাহরণ ‘তুই যা’ গল্পটি। আরও দীর্ঘ হলে পাঠক দিবারাত্রির কাব্য–এর মতো অসাধারণ একটি উপন্যাসের সাক্ষী হতে পারত। তা না, কিছু কাব্যিক শব্দের মধ্যে ডুবে যায় গল্পটি। গ্রামের বাড়ির পাতাঝরা পুকুরপাড়ের পুরোনো কবরের পাশে লেখকের সঙ্গে আমরাও দাঁড়িয়ে পড়ি। নিজের দেখা কোনো পুরোনো সিনেমাকে কাকলি সিনেমা হলে দেখা দোস্ত-দুশমন–এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে আবিষ্কার করি, ‘এই মুহূর্তে আপনি নিজেই একটা গল্প।’
গোলকধাঁধার গল্প
সুমন সাজ্জাদ
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশনা: কথাপ্রকাশ
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
মূল্য: ৪০০ টাকা
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স মন স জ জ দ ধ র গল প আম দ র চর ত র গল প র
এছাড়াও পড়ুন:
ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন
কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ।
এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।
একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।
দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।
পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।
ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।
এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।
বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।
এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”
যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।
বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।
নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”
তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।
প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।
এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।
ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”
শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
ঢাকা/এস