নির্বাচনী কৌশলই নির্ধারণ করবে এনসিপির ভবিষ্যৎ
Published: 4th, August 2025 GMT
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একাংশ উপলব্ধি করতে থাকে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি নতুন বিকল্প শক্তির প্রয়োজন রয়েছে।
পুরোনো পদ্ধতির রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন, গণমুখী, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রয়োজনীয়তা তখন প্রবল হয়ে ওঠে। এ ভাবনা থেকেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের একাংশ ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) গঠন করে।
এটা সত্য যে এই দলের শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন সেই তরুণেরাই, যাঁরা জুলাইয়ের আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন। ফলে গণ–অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী জনগণের অনেক প্রত্যাশা ও স্বপ্ন এই দলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
সেই স্বপ্নকে সফল করতে হলে এনসিপিকে শুধু শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করলেই হবে না, তাদের প্রয়োজন হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, ধৈর্য ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে হলে এনসিপিকে দীর্ঘ মেয়াদে একটি পরিণত ও সুসংগঠিত বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এনসিপির জনসমর্থন: সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ২০২৫ সালের মে-জুন সময়কালে সানেম নামে গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে এনসিপির জনপ্রিয়তা তুলনামূলক বেশি, বিশেষত তরুণ ও শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে।
জরিপে পুরুষ তরুণদের মধ্যে এনসিপির প্রতি সমর্থন ছিল ১৪ দশমিক ৪৪% এবং তরুণ নারীদের মধ্যে ১৭ দশমিক ৪৭%, যা ইঙ্গিত করে যে নারী ও যুবসমাজে তাদের প্রভাব বাড়ছে। তবে এই সমর্থন এখনো মূলত ইচ্ছা বা সম্ভাবনার পর্যায়ে রয়েছে। নির্বাচনী প্রচার, প্রার্থী বাছাই ও রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে এই পরিসংখ্যান পরিবর্তিত হতে পারে। যেহেতু এনসিপি একটি নবীন দল, সেহেতু তাদের এই আগাম সমর্থন কতটা ভোটব্যাংকে রূপান্তরিত হবে, তা আগামী নির্বাচনেই স্পষ্ট হবে।
নবীন দল হিসেবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাফল্যের শীর্ষে ওঠার ক্ষেত্রে এনিসিপির জন্য উদাহরণ হতে পারে ভারতের ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অথবা পাকিস্তানের ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। ভারতে বিজেপি ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, ১৯৮২ সালের নির্বাচনে মাত্র দুটি সিট পেয়েছিল। তবে মাত্র ১৪ বছর পর ১৯৯৬ সালে তারা প্রথমবার ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়।
অন্যদিকে পাকিস্তানে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ২০০২ সালের নির্বাচনে একটি মাত্র আসন লাভ করেছিল। তবে পরবর্তী ১৬ বছরে তারা পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে এবং বর্তমানে জনপ্রিয় ভোটের হিসাবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বৃহৎ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, বিজেপির ক্ষেত্রে কট্টর ধর্মীয় আদর্শ ও পিটিআইয়ের ক্ষেত্রে ইমরান খানের ক্যারিশম্যাটিক লিডারশিপ ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে এই দুটি বিষয়ের বাইরে গিয়ে এনসিপিকে নতুন কোনো কার্যকরী কৌশল খুঁজে বের করতে হবে, যা তাদের বৃহৎ দল হতে সহায়তা করবে।
এনসিপির চারটি নির্বাচনী কৌশলএকটি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আদলে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল ভবিষ্যতে কত দিন টিকে থাকবে, কতটা প্রভাব ফেলবে কিংবা রাষ্ট্র গঠনে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে তাদের নির্বাচনী কৌশলের ওপর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় মানুষ সাধারণত সেই দলকে সমর্থন করে, যার বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বা যে দল ক্ষমতার আশপাশে যেতে সক্ষম। কোনো দল যদি বারবার নির্বাচনে ব্যর্থ হয় বা দৃশ্যমান ফলাফল আনতে না পারে, তাহলে তার প্রতি জনগণের আগ্রহ ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
এই পটভূমিতে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনার দিকে তাকালে এনসিপির সামনে এক বড় চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়ায় তারা তাদের বিদ্যমান তরুণ ও সচেতন সমর্থক গোষ্ঠীকে কীভাবে কার্যকরভাবে কাজে লাগাবে। একটি নতুন দল হিসেবে এনসিপির একটি উঠতি ‘সাপোর্ট বেজ’ থাকলেও সেটিকে ভোটে রূপান্তর করা এবং নির্বাচনী মাঠে তা পরিণত ফলাফলে রূপ দেওয়াটা সহজ বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রে তাদের সম্ভাব্য চারটি কৌশল থাকতে পারে:
১.
নির্বাচন বয়কট:
প্রথম অপশন হিসেবে তারা নির্বাচন বয়কটের পথ বেছে নিতে পারে, বিশেষ করে যদি তাদের ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্য, যেমন নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন বা ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশ, বাস্তবায়িত না হয়। এনসিপি যেহেতু দাবি করেছে যে বিদ্যমান সংবিধানই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে এবং শেখ হাসিনার মতো নেতাদের হাতে নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করতে সহায়তা করেছে, সেহেতু যদি এই সংবিধানের কাঠামোতেই তারা নির্বাচনে অংশ নেয় বা মৌন থাকে, তাহলে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া এনসিপির একটি বড় দাবি ছিল আওয়ামী লীগের বিচার, বিশেষ করে অতীতে সংঘটিত দমন-পীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নিরপেক্ষভাবে নিরূপণ করা। আওয়ামী লীগের বিচারের বাস্তবায়ন যদি থেমে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার পুনরুদ্ধারে পুরোনো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ফিরে আসার আশঙ্কা থেকেই যায়। এসব বাস্তবতা মিলিয়ে যদি এনসিপি দেখতে পায় যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া তাদের কোনো রাজনৈতিক দাবি বাস্তবায়নে সহায়ক নয়, তাহলে তারা নির্বাচন বয়কটের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সেটা হলে তাতে অবাক হওয়ারও কিছু থাকবে না।
২. বিএনপির সঙ্গে জোট:
এনসিপির জন্য দ্বিতীয় সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে একটি নির্বাচনী জোট বা নির্বাচনী সমঝোতায় উপনীত হওয়া। এই পথ অবলম্বনের মধ্য দিয়ে এনসিপি দ্রুতই ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে এবং এতে তাদের তরুণ ভোটারদের মধ্যে একধরনের তাৎক্ষণিক আশাবাদ জন্ম নিতে পারে। সমর্থকেরা হয়তো ধরে নেবেন, তাঁদের সমর্থিত দল ক্ষমতার অংশ হতে চলেছে এবং অনেকেই সেটিকে রাজনৈতিক বাস্তববুদ্ধির অংশ হিসেবে গ্রহণ করবেন।
এই কৌশলের একটি বড় অন্তর্নিহিত ঝুঁকিও রয়েছে। এনসিপি শুরু থেকেই নিজেকে একটি ‘নতুন রাজনীতির’ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে, যেখানে পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বাইরে গিয়ে একটি ‘নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা’ ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিকের’ দাবি তারা তুলে ধরেছে। সেই পটভূমিতে যদি তারা অতীতের ক্ষমতাসীন বা পুরোনো প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যাত্রা শুরু করে, তাহলে জনগণের একটি বড় অংশের চোখে এনসিপির ‘নতুনত্ব ও রাজনৈতিক সততা’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান ঝাপসা হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে, অতীতে অনেক ছোট দল বৃহৎ রাজনৈতিক জোটে অংশগ্রহণ করে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। বড় দলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনৈতিক স্বকীয়তা হারিয়েছে। শুধু নির্বাচনের সময়ই নয়, আন্দোলন, দমন-পীড়নের সময় কিংবা কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর্যায়েও তারা বড় দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেনি। এ কারণে জোটে গেলেও তারা নেতৃত্ব দিতে পারেনি, বরং ধীরে ধীরে ছোট দল হিসেবেই ক্ষয়ে গেছে।
জুলাই-গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ ঘোষণা করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গতকাল রোববার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক দ র জন ত ক ব র র জন ত ক ও র জন ত ক দল হ স ব স প র জন এনস প র ব যবস থ ক ষমত র সমর থ র একট
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনী কৌশলই নির্ধারণ করবে এনসিপির ভবিষ্যৎ
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একাংশ উপলব্ধি করতে থাকে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি নতুন বিকল্প শক্তির প্রয়োজন রয়েছে।
পুরোনো পদ্ধতির রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন, গণমুখী, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রয়োজনীয়তা তখন প্রবল হয়ে ওঠে। এ ভাবনা থেকেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের একাংশ ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) গঠন করে।
এটা সত্য যে এই দলের শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন সেই তরুণেরাই, যাঁরা জুলাইয়ের আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন। ফলে গণ–অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী জনগণের অনেক প্রত্যাশা ও স্বপ্ন এই দলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
সেই স্বপ্নকে সফল করতে হলে এনসিপিকে শুধু শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করলেই হবে না, তাদের প্রয়োজন হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, ধৈর্য ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে হলে এনসিপিকে দীর্ঘ মেয়াদে একটি পরিণত ও সুসংগঠিত বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এনসিপির জনসমর্থন: সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ২০২৫ সালের মে-জুন সময়কালে সানেম নামে গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে এনসিপির জনপ্রিয়তা তুলনামূলক বেশি, বিশেষত তরুণ ও শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে।
জরিপে পুরুষ তরুণদের মধ্যে এনসিপির প্রতি সমর্থন ছিল ১৪ দশমিক ৪৪% এবং তরুণ নারীদের মধ্যে ১৭ দশমিক ৪৭%, যা ইঙ্গিত করে যে নারী ও যুবসমাজে তাদের প্রভাব বাড়ছে। তবে এই সমর্থন এখনো মূলত ইচ্ছা বা সম্ভাবনার পর্যায়ে রয়েছে। নির্বাচনী প্রচার, প্রার্থী বাছাই ও রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে এই পরিসংখ্যান পরিবর্তিত হতে পারে। যেহেতু এনসিপি একটি নবীন দল, সেহেতু তাদের এই আগাম সমর্থন কতটা ভোটব্যাংকে রূপান্তরিত হবে, তা আগামী নির্বাচনেই স্পষ্ট হবে।
নবীন দল হিসেবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাফল্যের শীর্ষে ওঠার ক্ষেত্রে এনিসিপির জন্য উদাহরণ হতে পারে ভারতের ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অথবা পাকিস্তানের ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। ভারতে বিজেপি ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, ১৯৮২ সালের নির্বাচনে মাত্র দুটি সিট পেয়েছিল। তবে মাত্র ১৪ বছর পর ১৯৯৬ সালে তারা প্রথমবার ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়।
অন্যদিকে পাকিস্তানে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ২০০২ সালের নির্বাচনে একটি মাত্র আসন লাভ করেছিল। তবে পরবর্তী ১৬ বছরে তারা পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে এবং বর্তমানে জনপ্রিয় ভোটের হিসাবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বৃহৎ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, বিজেপির ক্ষেত্রে কট্টর ধর্মীয় আদর্শ ও পিটিআইয়ের ক্ষেত্রে ইমরান খানের ক্যারিশম্যাটিক লিডারশিপ ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে এই দুটি বিষয়ের বাইরে গিয়ে এনসিপিকে নতুন কোনো কার্যকরী কৌশল খুঁজে বের করতে হবে, যা তাদের বৃহৎ দল হতে সহায়তা করবে।
এনসিপির চারটি নির্বাচনী কৌশলএকটি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আদলে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল ভবিষ্যতে কত দিন টিকে থাকবে, কতটা প্রভাব ফেলবে কিংবা রাষ্ট্র গঠনে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে তাদের নির্বাচনী কৌশলের ওপর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় মানুষ সাধারণত সেই দলকে সমর্থন করে, যার বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বা যে দল ক্ষমতার আশপাশে যেতে সক্ষম। কোনো দল যদি বারবার নির্বাচনে ব্যর্থ হয় বা দৃশ্যমান ফলাফল আনতে না পারে, তাহলে তার প্রতি জনগণের আগ্রহ ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
এই পটভূমিতে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনার দিকে তাকালে এনসিপির সামনে এক বড় চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়ায় তারা তাদের বিদ্যমান তরুণ ও সচেতন সমর্থক গোষ্ঠীকে কীভাবে কার্যকরভাবে কাজে লাগাবে। একটি নতুন দল হিসেবে এনসিপির একটি উঠতি ‘সাপোর্ট বেজ’ থাকলেও সেটিকে ভোটে রূপান্তর করা এবং নির্বাচনী মাঠে তা পরিণত ফলাফলে রূপ দেওয়াটা সহজ বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রে তাদের সম্ভাব্য চারটি কৌশল থাকতে পারে:
১. নির্বাচন বয়কট:
প্রথম অপশন হিসেবে তারা নির্বাচন বয়কটের পথ বেছে নিতে পারে, বিশেষ করে যদি তাদের ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্য, যেমন নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন বা ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশ, বাস্তবায়িত না হয়। এনসিপি যেহেতু দাবি করেছে যে বিদ্যমান সংবিধানই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে এবং শেখ হাসিনার মতো নেতাদের হাতে নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করতে সহায়তা করেছে, সেহেতু যদি এই সংবিধানের কাঠামোতেই তারা নির্বাচনে অংশ নেয় বা মৌন থাকে, তাহলে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া এনসিপির একটি বড় দাবি ছিল আওয়ামী লীগের বিচার, বিশেষ করে অতীতে সংঘটিত দমন-পীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নিরপেক্ষভাবে নিরূপণ করা। আওয়ামী লীগের বিচারের বাস্তবায়ন যদি থেমে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার পুনরুদ্ধারে পুরোনো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ফিরে আসার আশঙ্কা থেকেই যায়। এসব বাস্তবতা মিলিয়ে যদি এনসিপি দেখতে পায় যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া তাদের কোনো রাজনৈতিক দাবি বাস্তবায়নে সহায়ক নয়, তাহলে তারা নির্বাচন বয়কটের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সেটা হলে তাতে অবাক হওয়ারও কিছু থাকবে না।
২. বিএনপির সঙ্গে জোট:
এনসিপির জন্য দ্বিতীয় সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে একটি নির্বাচনী জোট বা নির্বাচনী সমঝোতায় উপনীত হওয়া। এই পথ অবলম্বনের মধ্য দিয়ে এনসিপি দ্রুতই ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে এবং এতে তাদের তরুণ ভোটারদের মধ্যে একধরনের তাৎক্ষণিক আশাবাদ জন্ম নিতে পারে। সমর্থকেরা হয়তো ধরে নেবেন, তাঁদের সমর্থিত দল ক্ষমতার অংশ হতে চলেছে এবং অনেকেই সেটিকে রাজনৈতিক বাস্তববুদ্ধির অংশ হিসেবে গ্রহণ করবেন।
এই কৌশলের একটি বড় অন্তর্নিহিত ঝুঁকিও রয়েছে। এনসিপি শুরু থেকেই নিজেকে একটি ‘নতুন রাজনীতির’ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে, যেখানে পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বাইরে গিয়ে একটি ‘নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা’ ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিকের’ দাবি তারা তুলে ধরেছে। সেই পটভূমিতে যদি তারা অতীতের ক্ষমতাসীন বা পুরোনো প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যাত্রা শুরু করে, তাহলে জনগণের একটি বড় অংশের চোখে এনসিপির ‘নতুনত্ব ও রাজনৈতিক সততা’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান ঝাপসা হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে, অতীতে অনেক ছোট দল বৃহৎ রাজনৈতিক জোটে অংশগ্রহণ করে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। বড় দলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনৈতিক স্বকীয়তা হারিয়েছে। শুধু নির্বাচনের সময়ই নয়, আন্দোলন, দমন-পীড়নের সময় কিংবা কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর্যায়েও তারা বড় দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেনি। এ কারণে জোটে গেলেও তারা নেতৃত্ব দিতে পারেনি, বরং ধীরে ধীরে ছোট দল হিসেবেই ক্ষয়ে গেছে।
জুলাই-গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ ঘোষণা করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গতকাল রোববার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে