মরনে মরকেল মোহাম্মদ সিরাজকে বলেছেন ‘জাত নেতা’। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক পেসার মরকেল বর্তমানে ভারতের পেস বোলিং কোচ। তাঁর দলের কোনো বোলার ভালো করলে তিনি বন্দনা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু প্রতিপক্ষ দলের সবচেয়ে বড় তারকা যখন সিরাজকে প্রশংসায় ভাসান, হয়তো তখনই তাঁর পারফরম্যান্সের পরিপূর্ণ মূল্যায়ন হয়। ইংল্যান্ডের জো রুট ভারতীয় পেসারকে বলেছেন ‘সত্যিকারের যোদ্ধা’। বলারই তো কথা। কেউ যখনই ভেবে বসেন, যশপ্রীত বুমরাহীন ভারতের বোলিং আক্রমণ নখদন্তহীন বাঘের মতো, তখনই তাঁকে ভুল প্রমাণ করেন সিরাজ।

আজ শেষ হতে চলা অ্যান্ডারসন–টেন্ডুলকার ট্রফির কথাই ধরুন। পাঁচ টেস্টের এই সিরিজে চোটজর্জর বুমরাকে দুটি ম্যাচে বিশ্রামে রেখেছে ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট। যে দুই ম্যাচে বুমরা নেই, সেই দুটিতেই বল হাতে ঝলক দেখিয়েছেন সিরাজ। এজবাস্টনে ৭ উইকেট নিয়ে প্রথমবারের মতো ভারতকে এই মাঠে টেস্ট জয়ের স্বাদ পাইয়ে দিয়েছেন এই পেসার। ওভালে চলমান টেস্টেও এখন পর্যন্ত নিয়েছেন ৬ উইকেট।

শুধু কি তাই? খেলোয়াড়দের চোটে পড়ার মিছিলের এই সিরিজে সিরাজই একমাত্র পেসার, যিনি চোটমুক্ত থেকে পাঁচ টেস্টই খেলছেন। ২০ উইকেট নিয়ে সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি তিনিই, সিরিজে সবচেয়ে বেশি ওভার (১৮১.

২) বোলিংও করেছেন তিনি।

সিরিজের সব টেস্টে মাঠে নেমেছেন ক্রিস ওকসও। কিন্তু নিজেকে চোটমুক্ত রাখতে পারেননি। ওভালে গত বৃহস্পতিবার টেস্টের প্রথম দিনে বাউন্ডারি ঠেকাতে ডাইভ দিতে গিয়ে বাঁ কাঁধে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। প্রথম ইনিংসে ১৪ ওভার বল করার পর আর মাঠে নামতে পারেননি ইংল্যান্ডের এই পেস বোলিং অলরাউন্ডার।

৩–১ ব্যবধানে সিরিজ জিততে আজ ইংল্যান্ডের দরকার আর ৩৫ রান। ম্যাচটা জিতে সিরিজ ২–২ সমতায় শেষ করতে হলে ভারতের নিতে হবে ৪ উইকেট। নিয়ন্ত্রণ এখনো ইংল্যান্ডের হাতে থাকলেও লন্ডনের মেঘলা আবহাওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে সিরাজ ম্যাচ জমিয়ে তুলবেন, ভারতের সমথর্কেরা নিশ্চয় এখন সেই আশাতেই আছেন।

অথচ সর্বশেষ বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফির পর ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়েছিলেন সিরাজ। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি ও ওয়ানডে সিরিজের পর জায়গা হয়নি আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দলেও। তবে সিরাজ দমে যাননি। দলে ফিরতে অনুশীলন চালিয়ে গেছেন নিয়মিত। গত আইপিএলে বল হাতেই জবাবটা দিয়ে আবারও দলে জায়গা করে নিয়েছেন।

পরিসংখ্যান বলছে, টেস্টে বুমরাকে ছাড়াই ভালো করেন সিরাজ। ৩১ বছর বয়সী সিরাজ ৪১ টেস্টের ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ১২০ উইকেট নিয়েছেন। বুমরাকে বোলিং সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন, এমন ২৫ ম্যাচে ইনিংসপ্রতি সিরাজের উইকেট ১.৫৭টি। গড় ৩৫.০০, ইকোনমি রেট ৩.৬৫। বুমরা ছিলেন না, এমন ১৬ ম্যাচে ইনিংসপ্রতি তাঁর উইকেট ১.৫৯টি। গড় ২৬.৫৪, ইকোনমি রেট ৩.৪১।

ভারতের নতুন টেস্ট অধিনায়ক শুবমান গিল এই সিরিজে উইকেট পাওয়ার আশায় যখনই সিরাজের হাতে বল তুলে দিয়েছেন, তখনই ব্রেক থ্রু এনে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কখনো সফল হয়েছেন, কখনো হননি। কিন্তু তাঁর মনোভাব বরাবরই ছিল জাত পেসারের মতো। অতিরিক্ত আগ্রাসন দেখাতে গিয়ে জরিমানাও গুনেছেন। তবে দলের জন্য এই ‘অর্থ বিয়োগ’ তিনি স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন।

সিরাজের মধ্যে এমন যোদ্ধা যোদ্ধা ভাব অনেক আগে থেকেই। বুমরা খেলেননি, এমন একাধিক টেস্টে ম্যাচের ভাগ্য ভারতের দিকে হেলে দিয়েছে তাঁর বোলিং।
এর একটি ২০২১ সালের ব্রিসবেন টেস্ট। সেবারের বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফি দিয়েই তাঁর টেস্ট অভিষেক হয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া সফরে যাওয়ার পর খবর আসে, সিরাজের অটোরিকশাচালক বাবা মোহাম্মদ গাউস মারা গেছেন!

তখন করোনাকালীন সময়। একবার জৈব সুরক্ষাবলয় ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার পর আবার ফিরতে চাইলে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। সেটা ভেবে বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে যাননি। বুকে পাথর চাপা দিয়ে সেই সিরিজে খেলেছেন। ব্রিসবেনে বুমরার অনুপস্থিতিতে ৬ উইকেট নিয়ে ভারতকে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জেতাতে অবদান রেখেছেন।

২০২৩ সালে পোর্ট অব স্পেন টেস্টের কথাও বলা যায়। অপেক্ষাকৃত ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে ৫ উইকেট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসে ধস নামিয়েছিলেন সিরাজ। সেই টেস্টে ক্যারিবীয়দের ৩৬৫ রানের লক্ষ্য দিয়েছিল ভারত। হাতে ৮ উইকেট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে শেষ দিনে করতে হতো আরও ২৯১ রান। কিন্তু বৃষ্টির কারণে ওই দিন একটি বলও মাঠে না গড়ানোয় ম্যাচ ড্র হয়।

এরপর ২০২৫ সালের অ্যান্ডারসন–টেন্ডুলকার ট্রফি। বুমরাহীন এজবাস্টন টেস্টে বল হাতে সিরাজের নায়ক হয়ে ওঠার কথা আগেই বলা হয়েছে। আজ ওভালেও নিশ্চয় সেটার পুনরাবৃত্তি করতে চাইবেন। বহু বাঁক বদলের এই সিরিজে ব্যাট হাতেও নায়ক হতে পারতেন। লর্ডসে রবীন্দ্র জাদেজার সঙ্গে শেষ উইকেট জুটিতে ঐতিহাসিক জয়টা প্রায় এনেই দিয়েছিলেন। কিন্তু শোয়েব বশিরের বলটা ভালোভাবে ব্লক করেও দুর্ভাগ্যবশত হয়ে যান বোল্ড। ফলে ব্যাটিং বীরত্বগাঁথার বদলে হতে হয়েছে ট্র্যাজেডির পার্শ্বনায়ক।

তবে ভারত আজ সিরিজ হেরে গেলে দায় কিছুটা হলেও সিরাজকে নিতে হতে পারে। কাল ১৯ রানে থাকতে হ্যারি ব্রুককে ‘জীবন’ দেন সিরাজ। প্রসিধ কৃষ্ণার শর্ট লেংথের বলে পুল করেছিলেন ব্রুক। কিন্তু টাইমিং ঠিকঠাক না হওয়ায় বল চলে যায় লং লেগে দাঁড়ানো সিরাজের হাতে। তিনি বলটা ঠিকঠাকভাবে তালুবন্দী করলেও শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর ডান পা স্পর্শ করে সীমানারেখা সঙ্গে। ব্যস, ‘জীবন’ পাওয়ার পাশাপাশি ছক্কাও পেয়ে যান ব্রুক। সেই ব্রুক পরে আউট হন ৯৮ বলে ১১১ রান করে।

কিন্তু মানুষ মাত্রই তো ভুল। সিরাজের এই ভুলকেও হয়তো তাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হবে। তিনি যে এরই মধ্যে সবার মন জিতে নিয়েছেন!

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উইক ট ন য় এই স র জ র র মত

এছাড়াও পড়ুন:

মানুষ যখন ভালোবাসতে শুরু করবে, তখনই মানুষের সফলতাটা আসবে: মোশাররফ করিম

ছবি : অভিনয়শিল্পীর সৌজন্যে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইনজুরির শঙ্কা, উত্তেজনার ঝড়: শেষ হাসি হাসল মেসিহীন মায়ামি
  • মানুষ যখন ভালোবাসতে শুরু করবে, তখনই মানুষের সফলতাটা আসবে: মোশাররফ করিম