উত্তরবঙ্গের মৎস্য ভান্ডার খ্যাত সিরাজগঞ্জের চলনবিল। বর্ষা মৌসুমে থইথই জলে পরিপূর্ণ থাকে এই বিল। বর্তমানে বিলের নদী, খাল ও জলাভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া শামুক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন নিম্ন আয়ের হাজারো মানুষ। তারা জানান, প্রতি বস্তা শামুক ব্যাপারীদের কাছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন। এ থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে মোটামুটি চলছে সংসার।
বর্ষা মৌসুমে বিল এলাকায় কাজ না থাকায় নিম্নআয়ের মানুষ বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে শামুক সংগ্রহকে বেছে নেন। শামুক প্রকৃতি ও কৃষি জমির জন্য উপকারী হলেও সে সম্পর্কে জানেন না তারা।
চলনবিল থেকে শামুক সংগ্রহের কাজ শুরু হয় জুলাই থেকে। এ কাজ চলে অক্টোবর পর্যন্ত। বিলের ১৬টি নদী, ৩৯টি বিল ও ২২টি খালসহ বিভিন্ন জলাভূমি থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৭০ থেকে ২০০ মেট্রিক টন শামুক সংগ্রহ করেন স্থানীয়রা। এসব জলাভূমি থেকে একজন নিম্ন আয়ের নারী ও পুরুষ প্রতিদিন দুই বস্তা শামুক সংগ্রহ করতে পারেন। প্রতি বস্তা শামুক ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা দরে কিনে নেন ব্যাপারীরা। এসব শামুক তারা ট্রাকযোগে পাবনা, নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া, খুলনা ও সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন হাঁস ও মাছের খামারে বস্তা প্রতি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করেন।
তাড়াশ উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের মাকড়শোন এলাকায় শামুক বেচাকেনার জন্য একটি ভাসমান হাট গড়ে উঠেছে। এই হাটে পাইকারি হিসেবে বেচাকেনা হয় বিভিন্ন ধরনের শামুক। পাবনা, নওগাঁ, রাজশাহী ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এখান থেকে শামুক কিনে হাঁসের খামারিদের কাছে বিক্রি করছেন।
মাকড়শোন এলাকার ভাসমান শামুকের হাটের ব্যবসায়ী শান্ত শেখ বলেন, “ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত এই হাটে পাইকারি দরে শামুক বেচাকেনা হয়। সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে বস্তা হিসেবে শামুক কেনা হয়। এলাকার দরিদ্র নারী ও পুরুষরা শামুক সংগ্রহ করে এখানে নিয়ে আসেন। তাদের কাছ থেকে কিনে আমরা বিক্রি করি।”
মাকড়শোন হাটে শামুক বিক্রি করতে আসা কুন্দইল গ্রামের শামীম বলেন, “এক সময় চলনবিলে অনেক মাছ পাওয়া যেত। সেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতাম। বর্তমানে বিলে পর্যাপ্ত মাছ না থাকায় সংসার চলে না। এ কারণে বাধ্য হয়ে শামুক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি। প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ বস্তা শামুক সংগ্রহ করতে পারি। বিক্রি করে আয় করি তাই দিয়ে ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছি।”
মাগুড়া বিনোদ গ্রামের জেলে হানিফ, রবিউল শেখ, মামুন হোসেন, সোলাইমান জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে ৬ থেকে ৭ জনের একটি দল নৌকা নিয়ে চলনবিলে যায়। নৌকায় করে মই জাল, হেসি জাল ও হাত জাল দিয়ে সারা রাত শামুক সংগ্রহ করা হয়। সকালে শামুকগুলো প্লাস্টিকের বস্তায় তুলে হাটে নিয়ে যায়। শামুক বেছে টাকা সবাই ভাগ করে নেন।
তাড়াশের মান্নান নগর গ্রামের শফিকুল বলেন, “শামুক সংগ্রহের জন্য একটি দল নৌকা ও জাল নিয়ে চলনবিলের নদ-নদীসহ বিভিন্ন খাল-বিলে ছুটে চলি। সারারাত জাল ফেলে শামুক সংগ্রহ করি। সকালে শামুক থেকে ময়লা ফেলে ৩৫ থেকে ৪০টি প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে পাইকারদের কাছে বিক্রি করি। এতে প্রতিদিন ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকার শামুক বিক্রি করা হয়। যে টাকা আয় হয়, তা সবাই ভাগাভাগি করে নেন।
নঁওগা থেকে তাড়াশের মাকড়শোন ভাসমান হাটে শামুক কিনতে আসা পাইকার সুজন মিয়া বলেন, “পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্য হওয়ায় হাঁসের খামারিদের কাছে শামুক ও ঝিনুকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই হাট থেকে শামুক সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন জেলার হাঁসের খামারি ও মাছের ঘের মালিকদের কাছে বিক্রি করি।”
শামুক ব্যবসায়ী মমিন তালুকদার বলেন, “চলনবিলাঞ্চলে ছোট-বড় সব মিলিয়ে ২৫ থেকে ৩০ জন ব্যবসায়ী আছেন। বিল থেকে তোলা শামুক ও ঝিনুক স্থানীয় সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে কিনে বিভিন্ন জেলার পাইকারি দরে আড়তে বিক্রি করা হয়। বর্ষার তিন থেকে চার মাস শামুক কেনাবেচা হয়।”
তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিদ্যুৎ কুমার বলেন, “অবাধে শামুক নিধনের ফলে মাটির উর্বতা ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “শামুক-ঝিনুক উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি বিশুদ্ধসহ খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ে বংশবিস্তার করে থাকে। মিঠা পানির মাছের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে শামুক। এই শামুক ধরে নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মাছের ঘেরের চিংড়িকে খাওয়ানো হচ্ছে, তবে, সেই চিংড়ি আমাদের দেশের মানুষ পাচ্ছে না। অথচ প্রতিদিন চলনবিল থেকে প্রায় ২০০ টন শামুক ধরা হচ্ছে। নির্বিচারে নিধনে জীববৈচিত্র মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে।”
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান বলেন, “শামুক প্রাকৃতিক সম্পদ। এখান থেকে নিয়ে যাওয়া শামুকের ভেতরের অংশ মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শামুকের অনেক পুষ্টিগুণ আছে। মাছ ও হাঁসের খাদ্য হিসেবে শামুক ব্যবহৃত হয়। শামুকের খোলস ব্যবহার হয় চুন ও সার তৈরিতে।”
তিনি বলেন, “নির্বিচারে শামুক নিধন এ অঞ্চলের জমির উর্বর শক্তি বৃদ্ধি ও খাদ্যশৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর। নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের জন্য শামুক নিধন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় শামুক ও ঝিনুক নিধনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঢাকা/মাসুদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর চলনব ল র জন য ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
সিরাজগঞ্জের গ্রামটি শত শত পাখিতে মুখর
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে উলিপুর গ্রাম। চলনবিলের শান্ত এ গ্রামে বহু শতাব্দী প্রাচীন শত বিঘা আয়তনের একটি দিঘির চারপাশে গড়ে উঠেছে মানুষের ঘরবসতি। এখানকার প্রাচীন একটি বটগাছসহ বিভিন্ন গাছে বাসা করেছে শত শত শামুকখোল পাখি। পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে গ্রামটি।
আলো ফুটতে না ফুটতেই অবারিত চলনবিলের বিভিন্ন এলাকায় খাবারের খোঁজে যেতে থাকে পাখির দল। তাদের এই ওড়াউড়ি মুগ্ধ করে আশপাশের বাসিন্দাদের।
গতকাল শনিবার পাখিদের গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, শামুকখোল পাখিদের কোনোটি বটগাছের কচি পাতায় ঠোকর দিচ্ছে, আবার কোনোটি ছানাদের আগলে রাখছে। এক ডাল থেকে আরেক ডালে ওড়াউড়ি করছে।
উলিপুর গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আরশেদ আলী বলেন, প্রায় এক যুগ আগে শামুকখোল পাখিরা এখানে এসে গাছে বাসা বাঁধে। এরপর প্রতিবছর প্রজনন মৌসুমে বাচ্চা ফোটায়। ফলে তাদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকায় গ্রামবাসী সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা কেউ পাখিদের বিরক্ত করবেন না। অন্যরা যেন না করেন, সেটাও নিশ্চিত করবেন। দর্শনার্থীরা এলে তাঁরা নিজেরাই মানুষকে সচেতন করেন।
মাহফুজা বেগম নামের এক গৃহবধূ বলেন, আগে শুধু তাঁদের আত্মীয়রা এ গ্রামে বেড়াতে আসতেন। এখন পাখি দেখতে অনেক মানুষ আসেন। পাখিদের বিশ্রামের জন্য গ্রামের মানুষ দিঘির পানিতে বাঁশ ও কঞ্চি দিয়ে গড়ে তুলেছেন আবাস। মাঝেমধ্যে খাবারও দেওয়া হয়।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘স্বাধীন জীবন’–এর পরিচালক মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, এ মৌসুমে তিনি একাধিকবার পাখি দেখতে উলিপুর গ্রামে গেছেন। শামুকখোলের দুটি প্রজাতির মধ্যে একটি এশীয়, আরেকটি আফ্রিকান। এই গ্রামে আসা শামুকখোল পাখিগুলো এশীয় প্রজাতির। এই শামুকখোল পাখি সংরক্ষিত প্রাণীর তালিকায় আছে।
শামুকখোল পাখিদের যাতে কেউ বিরক্ত না করেন, সেটা নিশ্চিত করেন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার উলিপুর গ্রামের বাসিন্দারা