সাকরাইন উৎসব: ঘুড়ির দখলে পুরান ঢাকার আকাশ
Published: 14th, January 2025 GMT
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উৎসব সাকরাইন। এদিন বাতাসে উড়তে থাকা রঙিন ঘুড়ির দখলে থাকে গোটা পুরান ঢাকার আকাশ। পরিণত হয় এক জীবন্ত উৎসবে।
এবারের সাকরাইন উপলক্ষেও ঘুড়ি আর আতশবাজির ঝলকে মেতে উঠেছে হাজারো মানুষ। তবে অন্যান্য বছর থেকে এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। উৎসবের আমেজ কম। বিগত বছরগুলোর মতো জাঁকজমক নেই। কমেছে ঘুড়ি-নাটাই-সুতার বেচাকেনাও।
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ, ধূপখোলা ঘুরে সাকরাইন উৎসব উপলক্ষে তেমন আমেজ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে দোকানে দোকানে আগের মতোই নানা রঙের, নানা আকারের ঘুড়ি, নাটাই, সুতা দেখা গেছে, নেই বিকিকিনির ভিড়।
অন্যান্য বছর উৎসবের আগে থেকেই ছাদে ছাদে কিশোর-তরুণদের ঘুড়ি ওড়াতে দেখা গেলেও এবার তেমনটা চোখে পড়েনি। গতকাল সোমবারও (১৩ জানুয়ারি) সাকরাইনের প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়নি পুরান ঢাকায়।
সাকরাইন বা পিঠাপুলির দিন মূলত পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে পালিত একটি লোকজ উৎসব। কিন্তু এ উৎসবের রঙ, রীতি ও পরম্পরা পুরান ঢাকাবাসীর জীবনে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এদিনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হচ্ছে ঘুড়ি কাটাকাটির খেলা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এ খেলা।
সাকরাইন উৎসবের দিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাসাবাড়ির ছাদ সাজানো হয়েছে বাহারি রঙের আলোকসজ্জায়। ছাদের ওপর শিশুদের মেলা, আছে বড়রাও। তাদের সবার হাতে নাটাই ও ঘুড়ি। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয়েছে পিঠা। কিছু কিছু বাড়ির ছাদে আয়োজন করা হয়েছে ডিজে পার্টির। ঘুড়ি ওড়ানোর সময় ঘুড়ি কেটে গেলে চিৎকার আর হাসাহাসি। বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজন মিলে সে এক অন্যরকম উল্লাস। এ যেন এক মেলবন্ধন।
বাসার ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছিলেন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া সবুজ। বিকাল পর্যন্ত সে তিনটি ঘুড়ি কেটেছে। অন্যরাও তার ঘুড়ি কেটেছে কয়েকবার। এবারের ঘুড়ি উৎসবের জন্য সে ১০টি ঘুড়ি কিনেছে। তার সবচেয়ে পছন্দের ঘুড়ি ‘পতেঙ্গা’।
ছেলে-মেয়েদের ঘুড়ি উড়ানোর আবদারে ধূপখোলা মাঠে এসেছেন শফিক আহমেদ। তিনি পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা। কাজের ফাঁকে সময় বের করে তিনি সন্তানদের নিয়ে মাঠে এসেছেন।
তিনি বলেন, “ছোটবেলায় সাকরাইন উৎসবে আমিও ঘুড়ি উড়াতাম। ঘুড়ি কাটাকাটিতে সবচেয়ে মজা। এখন কাজের চাপে ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। ছেলে-মেয়েদের আবদারে ওদের এখানে নিয়ে আসা।”
পুরান বিভিন্ন গলির দোকানগুলোতে ঘুড়ি পাওয়া গেলেও। ঘুড়ির সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয় শাঁখারীবাজারে। দোকানগুলোতে সাজানো রয়েছে নানা রং, আকৃতি ও নকশার ঘুড়ি-নাটাই-সুতা। ক্রেতারা আসছেন দেখছেন। আর পছন্দ হলেই দামাদামি করে কিনছেন। কিন্তু দোকানিরা বলছেন, বিগত বছরের তুলনায় এবার বিক্রি কম হচ্ছে।
শাঁখারী বাজারের বিক্রেতারা জানান, চারবুয়া বা কাউটা, টানা চোখ, গোল চোখ, মৌসুমী, লাভ, লাইলাসহ বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি এসেছে। পাঁচ টাকা থেকে ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় এ ঘুড়িগুলো। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সুতা ও নাটাই রয়েছে। আকৃতিভেদে নাটাইয়ের দামেও রয়েছে ভিন্নতা। সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
তারা আরো জানান, মোটা-চিকনভেদে বিক্রি হচ্ছে নানা রংয়ের সুতা। সর্বনিম্ন ৭০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা দামের সুতাও আছে। এসব সাজিয়ে রাখলেও তেমন বিক্রি না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন তারা।
শাঁখারী বাজারের গোপাল স্টোরের মালিক সুজিত কর বলেন, “আগের তুলনায় এবার বিক্রি কম। কয়েক হাজার ঘুড়ি অর্ডার দিয়েছিলাম। যা এসেছে তার অর্ধেকও বিক্রি হয়নি। আগের মতো ছেলেরা সাকরাইনে ঘুড়ি উড়ায় না। এরা গান বাজায়, বাজি ফুটায়। এবার সেটাও কম।”
তিনি আরও বলেন, “সাকরাইনের সঙ্গে পঞ্জিকার একটা পার্থক্য তৈরি হয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি পঞ্জিকার একদিন আগে বা পরে হয় সাকরাইন। এ দ্বিধার কারণেই এবার সাকরাইনের আমেজ কম।”
ঢাকাবাসী সংগঠনের সভাপতি শুকুর সালেক বলেন, “সাকরাইন মূলত একটি পারিবারিক উৎসব। সবাই পরিবারের সঙ্গে পিঠাপুলি আর ঘুড়ি উড়িয়ে এ উৎসব পালন করেন। কিন্তু ডিজে পার্টির নামে উচ্চ স্বরে গান বাজানো, এটা আমাদের কালচার না। মুড়ি, খই, বাতাসা, মিষ্টি খাওয়া, একে অপরকে দাওয়াত দেওয়া, এগুলোই আমাদের উৎসবের অনুষঙ্গ। সাকরাইনের নামে অপসংস্কৃতি সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।”
প্রায় ২ হাজার বছর আগে চীনে প্রথম ঘুড়ির উৎপত্তি। ইউরোপ বা আমেরিকায় ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ থাকলেও মূলত চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারত আর বাংলাদেশের মতো এশিয়ার দেশগুলোতেই এ খেলার জনপ্রিয়তা বেশি।
ঢাকা/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
১৬ কোটি টাকায় সারা দেশে ফুটবলের তিন টুর্নামেন্ট
তারুণ্যের উৎসবের অংশ হিসেবে সারা দেশে তিনটি ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। এই প্রকল্পের আওতায় আয়োজন করা হবে আন্তজেলা হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ফুটবল টুর্নামেন্ট, ছেলেদের অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্ট এবং মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল।
তিনটি টুর্নামেন্ট মিলিয়ে বাফুফের বাজেট প্রায় ১৬ কোটি টাকা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সূত্র জানিয়েছে, এর মধ্যে সরকার পর্যায়ক্রমে দেবে ১০ কোটি টাকা, যা বাফুফে আগামী সপ্তাহ থেকে পেতে পারে। বাকি অর্থ স্পনসরদের কাছ থেকে সংগ্রহ করবে বাফুফে। মাঠ সংস্কার, দলগুলোর অংশগ্রহণ ফি, পুরস্কারসহ নানা খাতে এ অর্থ ব্যয় হবে। প্রকল্পটি এরই মধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে উপস্থাপন করেছে বাফুফে।
সবচেয়ে বড় আয়োজন আন্তজেলা ফুটবল টুর্নামেন্ট, যেখানে দেশের ৬৪টি জেলা অংশ নেবে। বাফুফে সূত্র জানিয়েছে, প্রতিটি জেলা খেলবে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে। প্রথম রাউন্ডে দলগুলোকে আটটি ‘পটে’ ভাগ করা হবে। প্রতি ‘পটে’ থাকবে আটটি করে দল। প্রথম রাউন্ডের জয়ী দলগুলো যাবে দ্বিতীয় রাউন্ডে। দ্বিতীয় রাউন্ডেও থাকবে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে পদ্ধতি। এভাবে ধাপে ধাপে এগোতে থাকবে টুর্নামেন্ট।
চতুর্থ রাউন্ডের খেলা হবে নকআউট ভিত্তিতে। আন্তজেলা ফুটবল টুর্নামেন্টে বয়সের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। ২৫ থেকে ২৯ আগস্টের মধ্যে এই টুর্নামেন্ট শুরুর পরিকল্পনা বাফুফের। প্রায় চার মাসের এই মেগা টুর্নামেন্টে ফাইনাল হবে ঢাকায়।
বাফুফে এবার সারা দেশে আয়োজন করবে অনূর্ধ্ব-১৭ ছেলেদের টুর্নামেন্ট। আন্তজেলা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ শেষ হলে মাঠে গড়াবে অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্ট, এটিও শুরুর দিকে হবে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে।১৯৭৪ সালে শুরু হওয়া শেরেবাংলা কাপ আন্তজেলা ফুটবল একটানা হয়েছিল ১৯৮৬ পর্যন্ত। এরপর দীর্ঘ সময় নানা বিরতির মধ্য দিয়ে চলেছে এর যাত্রা। ১৯৮৭-৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৫, ২০০১–০৩, ২০০৫ সালে টুর্নামেন্ট হয়নি। ২০০৬ সালের পর দীর্ঘ ১৩ বছর বিরতি পড়ে শেরেবাংলা কাপে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে টুর্নামেন্টটি আবার মাঠ ফেরে। তবে সেটি শেরেবাংলা কাপ নামে নয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের’ জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর নামে।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম রাউন্ডেও জেলাগুলোকে আটটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছিল। শুরুর দিকে খেলা হয়েছে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে। আটটি অঞ্চলের চ্যাম্পিয়ন দল উঠেছিল মূল পর্বে।
আরও পড়ুনটিকিট বিক্রির ‘ডিজিটাল স্বাদ’ নিতে গিয়ে লেজেগোবরে বাফুফে২৭ মে ২০২৫বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের ইতিহাসে শেরেবাংলা কাপ স্মরণীয় হয়েই আছে। সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী কাপ অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবলও। এই দুই আয়োজন ছিল তৃণমূলে প্রতিভা খুঁজে বের করার অন্যতম প্রধান মঞ্চ। এই দুই টুর্নামেন্ট থেকে উঠে এসে অনেক ফুটবলারই গায়ে তুলেছেন জাতীয় দলের জার্সি।
সোহরাওয়ার্দী কাপ অনূর্ধ্ব-১৯ যুব ফুটবল আজ শুধুই স্মৃতি। তবে বাফুফে এবার সারা দেশে আয়োজন করবে অনূর্ধ্ব-১৭ ছেলেদের টুর্নামেন্ট। আন্তজেলা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ শেষ হলে মাঠে গড়াবে অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্ট, এটিও শুরুর দিকে হবে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে। এরপর মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্ট, যা হবে নকআউট–ভিত্তিক।
আরও পড়ুনবাংলাদেশের ফুটবলারদের বাজারদর কার কত২০ জানুয়ারি ২০২৫বাফুফের সহসভাপতি ওয়াহিদ উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনটি টুর্নামেন্ট আয়োজনের ব্যাপারে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। এগুলো তারুণ্যের উৎসবের অংশ হিসেবে করা হবে। এই প্যাকেজের জন্য আমাদের বাজেট প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ কোটি টাকা দেবে মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের নীতিগত সিদ্ধান্ত আমরা জানতে পেরেছি। বাকি টাকা স্পনসরের মাধ্যমে সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে টুর্নামেন্টগুলো শুরুর সময় ঠিক করা হবে।’
বড় পরিসরে আন্তজেলা ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনের সম্ভাবনার কথা প্রথম শোনা যায় গত ১১ এপ্রিল ঢাকার একটি হোটেলে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির বার্ষিক ক্রীড়া পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেছিলেন, ‘জেলা থেকে খেলাধুলা শুরু হওয়া উচিত। আশা করছি, ২-৩ মাসের মধ্যেই জেলা ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারব।’
গত ডিসেম্বরে শুরু হওয়া তারুণ্যের উৎসব এখনো চলমান। এই উৎসবের অংশ হিসেবেই বাফুফে সারা দেশে অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করছে, যার চূড়ান্ত পর্ব এখনো বাকি।