Risingbd:
2025-09-18@04:58:16 GMT

দাদনের শেকলে বন্দী যে জীবন

Published: 15th, January 2025 GMT

দাদনের শেকলে বন্দী যে জীবন

একান্তই গরিব যারা, তারাই ধরে রেখেছেন এই পেশা। যারা সুযোগ পেয়েছেন, তারাই বদলে ফেলেছেন বাপ-দাদার পেশা। নতুন করে যারা এই জেলে পেশায় যুক্ত হচ্ছেন, তারাও নিতান্তই গরিব। বছরে কোটি টাকার মাছ শিকার করেও ভাগ্য বদলায় না এসব জেলেদের। দারিদ্রতার সাথে লড়াই করতে একই পরিবারের প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটিয়ে দিচ্ছেন জেলে পেশায়। তবে, কেন বদলায় না জেলেদের ভাগ্য? 

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে কোল ঘেঁষা। এই উপজেলার চার ভাগের তিন ভাগ মানুষ জেলে পেশায় জড়িত ছিলেন। তবে, সময়ের সাথে সাথে অনেকেই পেশা বদল করেছেন। গোটা উপজেলার জেলেদের কেন এই দশা? এমন প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে। এর কারণ হলো- মহাজনের দাদন! এই উপকূলের জেলেরা জানান, মহাজনের দাদনের শেকলে বন্দি তাদের জীবন।

৬২ বছর ধরে গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করেন পাথরঘাটার পদ্দা এলাকার ৭২ বছরের বৃদ্ধ আলম ফিটার। প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় তার। 

আলম ফিটার বলেন, “অভাবের তাড়নায় বাবা আজম আলীর সাথে ১০ বছর বয়সে গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করা শুরু করি। তখন জাল টানার মতো শক্তি ছিল না। তবে জাল থেকে মাছ ছুটিয়ে বরফ দেওয়ার কাজ করতে পারতাম।” 

তিনি বলেন, “যখন মাছ বেশি ধরা পড়তো, তখন আমি খুব খুশি হতাম। কিন্ত বাবাসহ সবাই থাকতো চুপচাপ। তাদের মধ্যে আনন্দ দেখতাম না। তখন বাবার চুপচাপ থাকার কারণ বুঝতে না পারলেও যখন বড় হয়েছি, তখন বুঝেছি। মাছ কম পেলে বেতন সামান্য। কিন্তু বেশি পেলেও লাভ নেই। সবটাই চলে যাবে দাদন নেওয়া মহাজনের কাছে।”

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একসময় নীল চাষিদের অগ্রিম অর্থ প্রদান করে যে দাদন প্রথা চালু করেছিল, সে দাদনের ধারাবাহিকতা যেন অব্যাহত রেখেছে মৎস্য আড়তদার কিংবা মহাজনরাও।

পাথরঘাটার কালমেঘা এলাকার মোবাস্বের মিয়ার ট্রলার এফবি বাপ্পি। ২০১৬ সালে দেড় কোটি টাকা ব্যায়ে ট্রলারটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি। মোবাস্বের মিয়া বলেন, “লাভের আশায় সাগরে গিয়ে একবার মাছ পাই তো ১০ বার পাই না। ১৮ জন জেলের বেতন দেওয়াই দায় হয়ে ওঠে। এরপর থেকে শুরু করলাম দাদন নেওয়া। সাগরে যাওয়ার আগে মহাজনের (আড়ৎদার) কাছ থেকে দাদন নিয়ে ট্রলার পাঠাই মাছ শিকারে। চুক্তি হলো- সাগর থেকে এসে মাছ যা পাই সবটাই দিতে হবে মহাজনকে। সে পছন্দমতো একটা দামে মাছ সব নিয়ে যাবে।” 

ট্রলারের মাঝি সোহায়েল হোসেন বলেন, “মাছ যদি ১০ জনের কাছে দামাদামি করে বিক্রি করতে পারতাম, তাহলে বেশি দামে বিক্রি করতে পারতাম। কিন্তু যার কাছ থেকে মালিক দাদন নিয়েছে, তার কাছেই বিক্রি করতে হবে।” 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রলার মালিক বলেন, “রূপালী ইলিশের জোগান দিচ্ছি আমরা। অথচ আমাদের জীবনেই আনন্দ নেই। আমরাই দাদনের মারপ্যাঁচে আটকে আছি। একজন আড়ৎদার সমুদ্রগামী ট্রলারে ৫ থেকে ১০ লাখ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দাদন হিসেবে দেন। আমরা সেই টাকা ট্রলারের জেলেদের দাদন হিসেবে দেই। তবে, শর্ত থাকে দাদনের টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত নির্দিষ্ট আড়তেই দিতে হবে মাছ।”

অন্যদিকে, নদ নদীতে যে-সব জেলেরা মাছ শিকার করেন তারাও ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা দাদন নিয়ে থাকেন আড়ৎদার বা মহাজনের কাছ থেকে। সেই টাকায় ট্রলার মেরামত বা নতুন ট্রলার নির্মাণ করে মাছ ধরতে নেমে পড়েন নদ-নদীতে। 

নদীতে মাছ শিকার করা জেলেরা জানান, প্রতিদিন যে পরিমাণ মাছ শিকার করেন, সেগুলো শর্ত অনুযায়ী বিক্রি করতে হয় নির্দিষ্ট আড়ৎদারের কাছে। এক্ষেত্রে, প্রতিবারে মাছের দাম নির্ধারণ করেন আড়ৎদার নিজেই। পাশাপাশি কাটেন মোটা দাগে কমিশন। অন্যদিকে দাদনের মূল অংক ঠিকই স্থির থাকে।

বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, “সাগরে মাছ কম ধরা পড়ায় জেলে ও ট্রলার মালিকরা লোকসানের মুখে। বাধ্য হয়ে ট্রলার মালিকরা দাদনের দারস্থ হয়। মৎস্যজীবীদের কোনো ব্যাংক অথবা এনজিও লোন দেয় না। কারণ হিসেবে কোনো দালিলিক ব্যাখ্যা না দিলেও লোন দাতারা দাবি করেন, সাগরে ট্রলার ডুবে গেলে লোন গ্রহীতার লোন পরিশোধের আর কোনো উপায় নাই। তাই বাধ্য হয়ে ট্রলার মালিক ও জেলেরা দাদনে জড়িয়ে পড়েন।”

তথ্য বলছে, উপকূলীয় জেলা বরগুনার প্রতি ১০০ জন জেলের মধ্যে ৯৫ জনই দাদন নিয়েছেন। যাদের মধ্যে ৮০ জনই দাদনের মারপ্যাঁচে শ্রমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত। এদের অনেকেই আবার দায় মেটাতে না পেরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন পেশা পরিবর্তনের। আবার অনেকে পেশা পরিবর্তন করে এলাকা ছেড়েছেন।

অর্থনীতিবিদ ড.

শহিদুল জাহিদ বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক বা অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু একটি সার্কুলার জারি করে উপকূল কেন্দ্রিক ব্যাংক ও এনজিওর মাধ্যমে সেসব মৎস্যজীবীদের স্বল্প আকারে আর্থিক সহযোগিতা দিতে পারে। যেন বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেই রিফাইন্যান্স করতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “উপকূলীয় এলাকা বা জেলেদের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্পসুদে বা সুদবিহীন ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে কোনো বাধা নেই। তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে এ সংক্রান্ত তহবিলও গঠন করতে পারে।”

এভাবেই দাদনের দুষ্টচক্রে জেলেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রতারিত হয়। বঞ্চিত হয় শ্রমের সঠিক মূল্য থেকে। অন্যদিকে আড়তদাররা ইলিশের নতুন নতুন সিন্ডিকেট তৈরি করে চাহিদা বা যোগানের হেরফের দেখিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের ফেলেন বিপাকে।

বরগুনার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, “জেলেদের স্বাবলম্বী করতে বিনামূল্যে বকনা বাছুর বিতরণ করি। পাশাপাশি ছাগল ও খাবার দিয়ে থাকি যেন তারা বিকল্প আয় করতে পারেন। এছাড়া আমরা নানা ধরনের প্রশিক্ষণও দিই। এছাড়া নগত অর্থ দিয়ে জেলে অথবা মৎস্যজীবীদের সহায়তার কোনো সুযোগ নেই।”

বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, “দাদন প্রথা থেকে জেলেদের বের করে আনতে মৎস্য অধিদপ্তরকে সাথে নিয়ে কার্যকরী কিছু পরিকল্পনা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো।”

টেকসই মৎস্য আহরণে প্রয়োজন একটি পরিকল্পিত কার্যকরী পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ নীতি নির্ধারকদের এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে দাদনের এই ফাঁস জালে পড়ে একটি বিরাট সম্ভাবনাময় খাত নষ্ট হবে দেশের। নষ্ট হবে এই পেশায় জড়িত থাকা হাজারও মানুষের জীবন।

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম ছ শ ক র কর প রজন ম উপক ল

এছাড়াও পড়ুন:

অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক

অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।

বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক। 

আরো পড়ুন:

রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী

‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত

সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের  প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।

জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে  বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।

লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ