দাঁতের ব্যথা নিয়ে এক মাস আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। বহির্বিভাগ থেকে তাঁকে পাঠানো হয় ডেন্টাল ইউনিটে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রুট ক্যানেলের জন্য সময় দেওয়া হয় এক মাস পর। কিন্তু নির্ধারিত দিনে গিয়েও চিকিৎসা পাননি তিনি।

গত বুধবার ডেন্টাল ইউনিটের সামনে কথা হয় সাইফুদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজের দাবিতে আন্দোলন করছেন। আমাকে পরে আসতে বলা হয়েছে।’ পরে গতকাল রোববার যোগাযোগ করা হলে সাইফুদ্দিন জানান, তিনি এখনো চিকিৎসা নিতে পারেননি।

মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনের মতো শতাধিক রোগী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দাঁতের চিকিৎসার জন্য এক থেকে দুই মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও চিকিৎসক না থাকায় দ্রুত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের নেই পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, উন্নত সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের সুযোগও। এসব সমস্যার সমাধান ও পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজের দাবিতে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন।

১৯৮৯ সালে ৬০ আসন নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট চালু হয়। বর্তমানে ৩৫০ আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন। প্রতিদিন এখানে চার শতাধিক রোগী দাঁতের চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় তাঁদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি ওয়ার্ডের তিন কক্ষে দাঁতের ফিলিং ও রুট ক্যানেলের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এসব কক্ষে অপরিচ্ছন্ন যন্ত্রপাতি, ভাঙা ডেন্টাল চেয়ার ও পুরোনো সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৩টি চেয়ারের মধ্যে ৮টি নষ্ট; বাকিগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। কোনো চেয়ারের হেলান ভেঙে গেছে, আবার কোনোটি টুল দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে।

ইন্টার্ন চিকিৎসক ও কর্মচারীরা জানান, এসব চেয়ার কবে কেনা হয়েছিল, তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেন না। সব ওয়ার্ড মিলিয়ে অর্ধেকের বেশি চেয়ার অচল। জীবাণুমুক্ত করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় একই যন্ত্রপাতি একাধিক রোগীর ওপর ব্যবহার করতে হয়।

ডেন্টাল ইউনিটের প্রধান মনোজ কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘ইউনিটের সরঞ্জাম অনেক পুরোনো। ডেন্টাল চেয়ারসহ বেশ কিছু যন্ত্র নষ্ট। সব সমস্যা মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজের দাবিতে শিক্ষার্থীরা যে কথা বলেছেন, তা-ও আমরা জানিয়েছি।’

১৯৮৯ সালে ৬০ আসন নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট চালু হয়। বর্তমানে ৩৫০ আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন। প্রতিদিন এখানে চার শতাধিক রোগী দাঁতের চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় তাঁদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

ছয় ব্যাচের জন্য ক্লাসরুম মাত্র চারটি। পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিল নেই। যন্ত্রপাতি স্বল্প, জীবাণুমুক্ত করার সুযোগও নেই। রোগীদের চিকিৎসা দিতে হয় এক-দুই মাস পর। স্টাফদেরও পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা নেই।ফিরোজ আহমেদ, ইন্টার্ন চিকিৎসক

১৩ অক্টোবর থেকে পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজ গঠন, অবকাঠামো সংস্কার, যন্ত্রপাতি বৃদ্ধি ও চিকিৎসাসেবায় সীমাবদ্ধতা দূর করার দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি ঘোষণা করেন ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা। পরে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের আশ্বাসে জরুরি রোগীদের সেবা চালু রাখা হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে ছয়টি ওয়ার্ডে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়—পেডিয়াট্রিক ডেন্টিস্ট্রি, কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি, অর্থোডন্টিকস, ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি, প্রস্থোডন্টিকস ও পেরিওডন্টোলজি। এখানে দাঁতের স্কেলিং, রুট ক্যানেল, কৃত্রিম দাঁত বসানোসহ সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

শিক্ষকদের কক্ষেও পর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ ক্লাসরুমে লাইট-ফ্যান বিকল। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গরমে গাদাগাদি করে ক্লাস করতে হয়। চেয়ার-টেবিলও অন্য কক্ষ থেকে এনে ব্যবহার করতে হয়। এমনকি গ্যাস সিলিন্ডার রিফিলের খরচও দিতে হয় শিক্ষার্থীদের নিজেদের।

ডেন্টাল ইউনিটের ইন্টার্ন চিকিৎসক ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘ছয় ব্যাচের জন্য ক্লাসরুম মাত্র চারটি। পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিল নেই। যন্ত্রপাতি স্বল্প, জীবাণুমুক্ত করার সুযোগও নেই। রোগীদের চিকিৎসা দিতে হয় এক-দুই মাস পর। স্টাফদেরও পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা নেই।’

ডেন্টাল ইউনিটের চিকিৎসাসেবা অংশটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এবং শিক্ষা অংশটি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে। ফলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল তাঁরা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন।

মন্ত্রণালয় থেকে হাটহাজারী উপজেলায় নতুন কলেজের স্থান নির্ধারণ করা হলেও শিক্ষার্থীরা তাতে রাজি নন। তাঁদের দাবি, রোগীরা চিকিৎসার জন্য নগরের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আসেন। হাটহাজারীতে স্থানান্তর করা হলে রোগীদের ভোগান্তি আরও বাড়বে।

ডেন্টাল ইউনিটের সাবেক প্রধান ও চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল অনুষদের ডিন মো.

রহিম উল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ডেন্টাল কলেজের নকশা অনুমোদন হওয়ার পরও নির্ধারিত স্থানে বার্ন হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। বর্তমান ইউনিটকেই যদি কলেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তাহলে বাকি উন্নয়ন ধীরে ধীরে করা সম্ভব।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প র ণ ঙ গ ড ন ট ল কল জ ড ন ট ল ইউন ট র ড ন ট ল কল জ র পর য প ত ব সরঞ জ ম ম স পর র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

বাঙালি মুসলমান চিন্তার মেরুকরণ

কিস্তি: ১
কিস্তি: ২
কিস্তি: ৩
কিস্তি: ৪
দাড়ি তো বাহ্য, চিহ্নতান্ত্রিক অণু-শাসনের আরও বড় নিশানা ছিল বাঙালি মুসলমান নারী। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে বাংলার হিন্দু ও ব্রাহ্ম সমাজে নারীদের প্রকাশ্য উপস্থিতি নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়ে গেছে। আর বিশের দশক থেকে তুরস্ক, ইরান ও আফগানিস্তানে মুসলমান নারীর প্রকাশ্য বিচরণের দৃষ্টান্ত ধরে বাংলার মুসলমান সমাজেও এ প্রশ্ন উঁকি দেয়। নজরুল তখন শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন মিসেস এম রহমানের মতো নারী আন্দোলনের ভাবুককে। স্নেহাস্পদ সুফিয়া কামালের মতো ‘হেরেমের বন্দিনী বালিকা’কে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশে উৎসাহ জোগাচ্ছেন। আকৃষ্ট হচ্ছেন সমবয়সী ঢাবির প্রথম মুসলমান ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার প্রতি, যিনি ১৯২৮ সালে চলে যাচ্ছেন বিলেতে উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য। দেশভাগের পর তিনি হবেন ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ।

পর্দা ও সর্দা বিল

নজরুল বলেছেন, ‘আমাদের পথে মোল্লারা যদি হন বিন্ধ্যাচল, তাহা হইলে অবরোধ প্রথা হইতেছে হিমাচল।…আমাদের বাংলা দেশের স্বল্পশিক্ষিত মুসলমানদের যে অবরোধ…তাহাকে একেবারে শ্বাসরোধ বলা যাইতে পারে।…কন্যাকে পুত্রের মতোই শিক্ষা দেওয়া যে আমাদের ধর্মের আদেশ, তাহা মনেও করিতে পারি না। আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের শুধু অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া হতভাগিনীদের চিরবন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি।’

নব্যদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ আত্মকথায় লিখেছিলেন, ‘এই পর্দা–প্রথা মুসলমান সমাজকে পঙ্গু, অথর্ব, অসভ্য ও কৃষ্টিহীন করিয়া রাখিয়াছে। নারী জাতির পর্দার কড়াকড়ির সমর্থনে দিন-রাত শত হাদিস-কোরআন আওড়ান হইতেছে। যেন একমাত্র পর্দা-প্রথার উপরই ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করিতেছে। অথচ কার্যত এই পর্দা-প্রথা শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। চাষি-শ্রমিক, কুলি-মজুর ও ভিক্ষুক যারা মুসলমান সমাজের বিপুল মেজরিটি, তাদের মধ্যে পর্দা-প্রথা নাই…যুক্তিহীন স্ববিরোধী পর্দা–প্রথাই মুসলমান সমাজের অর্ধেক মানুষকে পঙ্গু, অসহায় ও পুরুষের কাঁধের বোঝা করিয়া রাখিয়াছে। এর জন্য দায়ী মোল্লাদের বিকৃত ইসলাম।’

বিশের দশক থেকে তুরস্ক, ইরান ও আফগানিস্তানে মুসলমান নারীর প্রকাশ্য বিচরণের দৃষ্টান্ত ধরে বাংলার মুসলমান সমাজেও এ প্রশ্ন উঁকি দেয়। নজরুল তখন শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন মিসেস এম রহমানের মতো নারী আন্দোলনের ভাবুককে। আকৃষ্ট হচ্ছেন সমবয়সী ঢাবির প্রথম মুসলমান ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার প্রতি।

বিপরীতে সেলবর্সীর পত্রিকা ১৯২৯ সালে কামালি সংস্কারের প্রভাবে পাছে বাঙালি মুসলমান নারীদের মধ্যেও পর্দাপ্রথা নড়বড়ে হয়ে পড়ে, এ নিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে চলেছে। আল মুসলিম পত্রিকায় এম ইদ্রিস ‘নব্য-তন্ত্রী’ নামের এক কবিতায় লিখেছেন, ‘পর্দ্দা ওরা ফাঁক করে রে ফাঁক করে-/ বক্তৃতায় ও রং বেরং এর অক্ষরে।…খসিয়ে ফেলো মা ভগিনীর ঘোমটাটী/ বেরিয়ে পড় শাস্ত্র বিধির জাল কাটি!’ তারপর সেই কবিতায় পর্দার বিরুদ্ধে নব্যদের ‘লক্ষ্মীছাড়া’ যুক্তির অসাড়তা নিয়ে আফসোস করা হয়েছে।

নারী–পুরুষ সম্পর্কটি আবার এ সময়ের ঘোর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আবহাওয়ায় হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের সঙ্গে আন্তবর্গীয় (ইন্টারসেকশনাল) জটিলতার জটে পাকিয়ে যায়। ভিন্ন সম্প্রদায়ের নারী হরণ ও বলাৎকার নিয়ে বিতর্ক ঘনিয়ে ওঠে। তবে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল অংশ একজোট হন বিবাহ আইনের সংস্কার প্রশ্নে। বাল্যবিবাহ নিরোধে সারদা বা সর্দা বিল নামে একটি আইন উত্থাপিত হয়। এই আইন নিয়ে বিতর্ক ঘনিয়ে ওঠে। আল মুসলিম পত্রিকায় সারদা বিলে বাল্যবিবাহ নিষেধের বিপরীতে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপা হতে থাকে। নানা এলাকায় মুসলমান এবং কোথাও কোথাও নমশূদ্র-মুসলমান একসঙ্গে সভা করে সারদা বিলের বিরুদ্ধে তথা বাল্যবিবাহ রীতি অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে জনমত গঠন করা হতে থাকে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল কাসিম, আবদুর রউফ দানাপুরী, মুনসী মজহরুল হক, রেয়াজুদ্দীন আহমদসহ অনেকেই এসব সভা-সমাবেশে প্রতিবাদে অংশ নেন।

অন্যদিকে নজরুল অকুণ্ঠে দাঁড়ান সারদা বিলের পক্ষে। তিনি ‘চানাচুরে’ এক রঙ্গচিত্র লেখেন, ‘টাউন হলে “বুড়ো ও পণ্ডিতের দল” সারদা বিলের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছিল। এই সময় যত সব টিকি-নিসূদন কালাপাহাড়ি তরুণের দল ক্ষুর কাঁচি নিয়ে তৈরি হয়েছিল। তারপর বুড়োদের ওপর তারা হামলে পড়ল। বুড়োরা পালাল, কিন্তু তাদের উৎপাটিত টিকি রয়ে গেল তরুণদের হাতে। “সবচেয়ে মজার ব্যাপার, এই টিকি ছেঁড়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিলেন শত শত মহিলা, যাদের উদ্ধারকল্পে এইসব টিকির দল জমায়েত হয়েছিলেন।”’ আরেক ‘চানাচুর’ লেখায় তিনি বলেছেন, ‘বুড়োরা বাল্যবিবাহ আইনের প্রতিবাদ করছে। কারণ “বেচারাদের তৃতীয় পক্ষ চতুর্থ পক্ষের যে দফা নিকেশ হলো”। মেয়েরা বুঝে ফেললে আর বুড়োদের বিয়ে করবে না।’ (নজরুল রচনাবলী)

হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল অংশ একজোট হন বিবাহ আইনের সংস্কার প্রশ্নে। বাল্যবিবাহ নিরোধে সারদা বা সর্দা বিল নামে একটি আইন উত্থাপিত হয়। এই আইন নিয়ে বিতর্ক ঘনিয়ে ওঠে। আল মুসলিম পত্রিকায় সারদা বিলে বাল্যবিবাহ নিষেধের বিপরীতে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপা হতে থাকে।

বাল্যবিবাহ নিরোধ ও জনপরিসরে নারীর বিচরণ এই উভয় প্রশ্নে নজরুলসহ নব্যপন্থীদের গরজ ছিল নারী যেন শিক্ষাসহ নানাবিধ মৌলিক আত্মগঠনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। অন্যদিকে সেলবর্সী প্রমুখের কাছে নারী প্রশ্নটি ছিল ট্র্যাডিশন রক্ষার প্রশ্ন।

ইবনে সউদ ও বাচ্চা সাকাও

নজরুল কামালি সংস্কারের পক্ষপাতী হলেও সেলবর্সী খেলাফতের পুনরুজ্জীবনের আশা ছাড়েননি। ১৯২৯ সালেও ‘আল মুসলিমে’ তিনি হিসাব কষছেন, খলিফা কে হবেন। তিনি বলছেন, দুনিয়ায় মুসলমান শাসক আছেন চারজন, যথা তুরস্কের কামাল, আফগানিস্তানের আমানুল্লাহ, ইরানের রেজা ও আরবের ইবনে সউদ। রেজা শিয়া, আর কামাল তো খেলাফত লুপ্ত করেছেন। এখন পাছে সংস্কারপন্থী রাজা আমানুল্লাহ খলিফা হয়ে যান, এটা সেলবর্সীর পছন্দ নয়। তিনি বললেন, খলিফা হওয়ার যোগ্য যদি কেউ হয়, তাহলে সে ইবনে সউদ। খলিফা বাছাইয়ে সেলবর্সী রাজনীতি নয়, বরং আকিদার ওপর গুরুত্ব দিলেন।

‘ইবনে সউদ ওহাবী, এ কথা সত্য। কিন্তু তিনি একজন খাঁটী মুসলমান। তিনি তাঁহার রাজ্যের মধ্যে ইসলামকে… সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিয়াছেন। …তিনিই মুসলিম কুলাঙ্গার ও দুর্বৃত্তদিগের হাত হইতে মক্কা-মুয়াজ্জমা ও মদিনা-মুনাওরাকে ছিনাইয়া লইয়া তাহা নিরাপদে রাখিতেছেন। দেশ হইতে সর্ব্বপ্রকার অত্যাচার, অবিচার, কুফার ও শেরেকীভাব তুলিয়া তাঁহার স্থলে খাঁটী ইসলামিয়াত প্রচার করিয়াছেন।…মুসলিম রাষ্ট্রচতুষ্টয়ের মধ্যে তিনি খলিফা হইবার একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি।’

আরেক লেখায় সেলবর্সী ইবনে সউদকে ‘দুনিয়ার মুসলিম নরপতিকুলের দীপ্ত ভাস্কর’ বলে অভিহিত করেছেন। হজ নিয়ে ইবনে সউদের সুব্যবস্থার তারিফ করেছেন। ইবনে সউদের খলিফা হওয়ার আশায় এভাবেই বুক বাঁধলেন সেলবর্সী।

অন্যদিকে নজরুলও ইবনে সউদের প্রশংসা করেছেন। তবে ভিন্ন জায়গা থেকে। ১৩৩১ সনে (১৯২৪ সালে) ‘সুবহ-উম্মেদ’ কবিতায় ইবনে সউদের উত্থানে দেখেছেন পরাস্ত জাতির পুনরুত্থান। তিনি লিখলেন:

সিজদা করিল নিজদ হেজাজ
আবার ‘কাবা’র মসজিদে।
আরবে করিল ‘দারুল-হারব’—
ধসে পড়ে বুঝি ‘কাবা’র ছাদ!
‘দীন দীন’ রবে শমশের-হাতে
ছুটে শের-নর ‘ইবনে সাদ’!
মাজার ফাড়িয়া উঠিল হাজার
জিন্দান-ভাঙা জিন্দা বীর!
গারত হইল করদ হুসেন,
উঁচু হলো পুন শির নবীর!
আরব আবার হলো আরাস্তা,
বান্দারা যত পড়ে দরুদ।
পড়ে শুকরানা ‘আরবা রেকাত’
আরফাতে যত স্বর্গ-দূত।

‘জুলফিকার’ গ্রন্থে কাজী নজরুল ইসলাম নতুন যুগের মুসলমান নেতাদের তালিকা করেছেন: গাজি মুস্তাফা কামাল, রেজা পহলবি, জগলুল, ইবনে সউদ, আমানুল্লাহ, করিম, ফয়সল। তাঁদের জাগ্রত নব্য–বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করে নজরুল আফসোস করেছেন—‘জাগে না কো শুধু হিন্দের দশ কোটি মুসলিম বে-খেয়াল’।

নজরুল কামালি সংস্কারের পক্ষপাতী হলেও সেলবর্সী খেলাফতের পুনরুজ্জীবনের আশা ছাড়েননি। ১৯২৯ সালেও ‘আল মুসলিমে’ তিনি হিসাব কষছেন, খলিফা কে হবেন। তিনি বললেন, খলিফা হওয়ার যোগ্য যদি কেউ হয়, তাহলে সে ইবনে সউদ। খলিফা বাছাইয়ে সেলবর্সী রাজনীতি নয়, বরং আকিদার ওপর গুরুত্ব দিলেন।

মোদ্দাকথা, একই চরিত্র সম্পর্কে নজরুল ও সেলবর্সী দুই আলাদা বুঝ বুঝেছেন। নজরুল ইবনে সউদের ভেতর দেখেছেন আরবের জাতীয় রুহানি পুনরুত্থান, যাকে দেখে ভারতের মানুষও জাগবে। আর সেলবর্সী খুঁজেছেন পরহেজগার খলিফা।

এরই মধ্যে ঘটল আরেক ঘটনা। আফগানিস্তানে বাচ্চা সাকাও নামের এক সরদার রাজা আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করল। আমানুল্লাহ সিংহাসনচ্যুত হলেন। সংস্কারপন্থী আমানুল্লাহর পতনে সেলবর্সী আনন্দিত হয়ে লেখেন, ‘“বাচ্চা সাক্কা” যে বংশের লোকই হউন না কেন, তিনি দীনদার মুসলমান। তাঁহার ঘোষণাবাণীতে ইসলামের বিপরীতে একটি কথাও নাই। তাঁহার কার্য্য-কলাপের উপর শত্রুপক্ষ যতই দোষারোপ করুক না কেন, তিনি কোরআন হাদীসের বিপরীত কোনও কাজ করেন নাই। আফগানিস্তানের প্রধান প্রধান পীর-দরবেশ, আলেম-ফাজেলের মতানুসারে শাসন-কার্য্য পরিচালন করেন।’

এই লেখায় সেলবর্সী নিজ দেশের হিন্দুসমাজকেও এক হাত নেন। তিনি বলেন, হিন্দুসমাজের ভয় এই যে ভারতের মুসলমান ও আফগানিস্তানের মুসলমান এক হয়ে আবার মুসলমান রাজত্ব কায়েম করবে, তাই ‘আফগানিস্তানে কোনও সুপ্রতিষ্ঠিত গবর্নমেন্ট থাকা তাহাদের জাতীয় স্বার্থের সম্পূর্ণ প্রতিকূলে। এ জন্য তাহারা চায় আফগানিস্তানে বিপ্লবানল জ্বলিতেই থাকুক, আফগান শক্তি চুর–মার ও ছারখার হইয়া যাউক।’ আফগান ও হিন্দুস্তানি মুসলমানের যে একতার কল্পনা সেলবর্সী করেছিলেন, তা অবশ্য ইতিহাসে পরিহাস হয়ে আছে।

কিন্তু বাচ্চাকে নিয়ে সেলবর্সী যত রকম প্রজেকশন বা ভাবক্ষেপণই করুন, সে উচ্ছ্বাস বেশি দিন টিকল না। সেনাপতি নাদির খান এসে বাচ্চাকে পরাস্ত করে রাজা হলেন। সেলবর্সীর উৎসাহ মাঠে মারা গেল।

ওদিকে নজরুল ছিলেন আমানুল্লাহর সংস্কার প্রচেষ্টার অনুরাগী। তিনি লিখেছেন:

কাবুল লইল নতুন দীক্ষা
কবুল করিল আপনা জান।…
‘আমানুল্লা’রে করি বন্দনা, কাবুল-রাজার গাহি না গান,
মোরা জানি ঐ রাজার আসন মানবজাতির অসম্মান!
…তোমার রাজ্যে হিন্দুরা আজো বেরাদর-ই-হিন্দ, নয় কাফের,
প্রতিমা তাদের ভাঙেনি, ভাঙোনি একখানি ইট মন্দিরের।

অর্থাৎ আমানুল্লাহ রাজা হলেও তাঁর রাজ্যে মানুষের মর্যাদা আছে—এ খবরই নজরুলের কাছে আকর্ষণের বিষয় হয়েছিল। আর বাচ্চা সাকাও? প্রথম থেকেই নজরুল বাচ্চা সাকাওয়ের তীব্র বিরোধী। তিনি সওগাত পত্রিকায় বাচ্চা সাকাওয়ের পরাজয়ের পর বাচ্চার বাঙালি মুসলমান ভক্তদের শ্লেষ করে লিখলেন:

কাবুলের ‘আঙুল-ফুলে-কলাগাছ’ বাচ্চা-ই-শাকা এখন নাদির খাঁর তরবারিতলে ‘নফসি নফসি’ করছে। যে ভিস্তিকে সেই ভিস্তি।…বাচ্চু মিঞাকে হয়তো আবার কাবুলের রাস্তায় মশক ঘাড়ে করে পানি দিতে হবে কিংবা কাবুলের শুকনো রাস্তা তার রক্তে ভিজাতে হবে। ও নিয়ে যাদের মাথা ব্যথা বেশি, তারাই ওর হেস্তনেস্ত করবে। কিন্তু যাদের এতদিন ‘মাথা নাই তার মাথা ব্যথা’ হচ্ছিল বাচ্চাকে নিয়ে, তাদের উপায় হবে কী? বেচারাদের ‘গাজি’ যে গাঁজিয়ে উঠল। ইসলাম রক্ষার উপযুক্ত ‘গাজি’ পেয়েছিল বটে। বেড়ালকে দিয়েছিল মাছ বাছবার ভার।…বেওকুফ আর কাকে বলে? আশা করি বাচ্চা মরবার সময় তার মশকটা এইসব ভক্ত মিঞা সায়েবদের পাঠিয়ে দেবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ